বাগ মানছে না সিংহ, নাস্তানাবুদ কংগ্রেস

ভোগাচ্ছে পশুরাজ! ওই চেহারা! ওই হাঁ, কেশর, সরু পেট, বলিষ্ঠ থাবা... ল্যাজেগোবরে অবস্থা উত্তর ২৪ পরগনার সাধারণ কংগ্রেস কর্মী-সমর্থকদের! বামেদের সঙ্গে জোট হওয়ায় কিছুটা বলভরসা পেয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু একা সিংহই যে কংগ্রেস কর্মী-সমর্থকদের ঘুম কেড়ে নেবে কে ভেবেছিল!

Advertisement

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য ও বিতান ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০১৬ ০১:১৮
Share:

ভোগাচ্ছে পশুরাজ!

Advertisement

ওই চেহারা! ওই হাঁ, কেশর, সরু পেট, বলিষ্ঠ থাবা... ল্যাজেগোবরে অবস্থা উত্তর ২৪ পরগনার সাধারণ কংগ্রেস কর্মী-সমর্থকদের!

বামেদের সঙ্গে জোট হওয়ায় কিছুটা বলভরসা পেয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু একা সিংহই যে কংগ্রেস কর্মী-সমর্থকদের ঘুম কেড়ে নেবে কে ভেবেছিল! অনেক সহজ ‘হাত’। পটু-অপটু সব হাতে সেই হাত এঁকে মিলছিল হাততালি। এ বার কাস্তে-হাতুড়ি-তারা বা কাস্তে-ধানের শিসও সহজে আঁকা যাচ্ছে। কিন্তু সিংহ!

Advertisement

‘‘উফ্, প্রতীক বটে একটা!’’— দিন কয়েক আগেই মহা আতান্তরে পড়তে হয়েছিল জগদ্দলের এক কংগ্রেসকর্মীকে। কারণ, সেখানকার জোটপ্রার্থী বাম শরিক ফরওয়ার্ড ব্লকের। আর ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রতীক ‘সিংহ’ আঁকতে গিয়েই যত গোলমাল! হাঁ ঠিক হচ্ছে, তো কেশর হচ্ছে না! লেজ হয়ে যাচ্ছে সরু। যেন টিকটিকির! হাল ছেড়ে ওই কংগ্রেসকর্মী শেষমেশ বামেদের বলে দেন, ‘‘আমরা রং, তুলি সব দেব। দেওয়াল লিখবেও আমাদের কর্মীরা। কিন্তু প্রতীক আপনারা আঁকুন। সিংহ আমাদের কম্ম নয়।’’

শুধু কি জগদ্দল? একই দশা উত্তর ২৪ পরগনার বারাসত, দেগঙ্গা, বা বনগাঁ উত্তরের কংগ্রেসকর্মীদের। জেলার এই পাঁচ আসনেই যে জোটের প্রার্থী ফরওয়ার্ড ব্লকের।

দেগঙ্গার কংগ্রেসকর্মীরা অবশ্য প্রথমে সাহস করেছিলেন সিংহ আঁকার। কিন্তু পেট রোগা হয়ে তা শেষমেশ নেকড়ের মতো হয়ে দাঁড়ায়। সমস্যা রয়েছে আরও। কংগ্রেসকর্মীরা জানাচ্ছেন, এই অবস্থায় যে তাঁদের কোনও দিন পড়তে হবে তা স্বপ্নেও ভাবেননি। বস্তুত, কংগ্রেস-বাম জোট এ রাজ্যে এই প্রথম। প্রচারেও দু’পক্ষ পরস্পরের দিকে হাত বাড়িয়েছে। কংগ্রেসের দেওয়াল লিখছে বামেরা। বামেদের কংগ্রেস। কিন্তু ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রতীক আঁকতে যে যথেষ্ট শিল্প-নৈপুণ্য দরকার, তা এত দিনে টের পেয়েছেন কংগ্রেসকর্মীরা।

কেমন সেই শিল্প-নৈপুণ্য?

এক কংগ্রেসকর্মী জানান, সিংহী আঁকলে চলবে না। তাতে বাঘ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রতীক চেনাতে চাই কেশরওয়ালা সিংহ। তা-ও যেমন-তেমন ভাবে আঁকা যাবে না। ‘সাইড ফেস’। মুখটা অল্প হাঁ করা। লেজ তোলা। তাঁর কথায়, ‘‘একটি দেওয়ালে আঁকতে গিয়ে সিংহ এমন দেখতে হল যে আমাদের কর্মীরাই ছি ছি করল। শেষমেশ চুন এনে দেওয়ালে লেপে দিতে হল।’’ বারাসতের এক কংগ্রেসকর্মীও সিংহ আঁকার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘উরিব্বাবা, কেমন একটা বিদেশি কুকুরের মতো হয়ে গেল! হাল ছেড়ে দিই।’’ রীতিমতো চর্চা বা অভ্যাস না থাকলে সিংহকে দেওয়ালে যে বাগ মানানো যায় না তা অকপটেই বলছে কংগ্রেস।

জোটসঙ্গীর সমস্যা বুঝতে পেরেছেন ফরওয়ার্ড ব্লকের জেলা নেতারা। তাঁরা মানছেন, দলীয় প্রতীক আঁকা কিছুটা শক্ত। বারাসতের ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থী সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘কিছু কিছু জায়গায় সমস্যা হচ্ছে শুনেছি। তেমন হলে আমরাই শিল্পী পাঠিয়ে দিচ্ছি।’’

হচ্ছেও তাই। কংগ্রেসকর্মীরা ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রার্থীর জন্য দেওয়ালে সব কিছু লিখে শুধু প্রতীক আঁকার জায়গা ছেড়ে রাখছেন। সেই শূন্যস্থান ভরাটের জন্য ডাক পড়ছে দমদমের পরিমল চক্রবর্তী ওরফে পকাইবাবু বা জগদ্দলের স্বপন বসু, স্বপন দাসদের। ৫০ ছুঁই ছুঁই পকাইবাবু এখন একাই তুড়ি মেরে দিনে দেড়শো সিংহ আঁকছেন। জেলা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক সজল দে-র কথায়, ‘‘আগে দেওয়ালে কথাগুলো লিখে রাখছি। পরে শিল্পী এসে পরপর সিংহ এঁকে দিয়ে যাচ্ছেন।’’

ফরওয়ার্ড ব্লকেরও আগে সিংহকে প্রতীক হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন টিপু সুলতান। তাঁর পতাকায় থাকত পশুরাজের ছবি। কিন্তু তখন তো আর ভোটের ব্যাপার ছিল না। তাই দেওয়ালে-দেওয়ালে সিংহ আঁকার দরকারও পড়ত না। ফরওয়ার্ড ব্লকের ভারপ্রাপ্ত রাজ্য সম্পাদক বরুণ মুখোপাধ্যায় জানান, ১৯৪০ সালের ২২ জুন নাগপুরে ফরওয়ার্ড ব্লককে স্বতন্ত্র দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। ১৯৫২ সাল থেকে সিংহকে প্রতীক করে ভোট-লড়াইয়ে নামে দল।

সেই পুরনো দিনের কথা শোনাচ্ছিলেন ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রাক্তন মন্ত্রী-বিধায়ক, বিরাশি বছরের সরল দেব। তিনি জানান, তখন বারাসত-মধ্যমগ্রাম এবং সংলগ্ন বিশাল এলাকা ছিল বনগাঁ লোকসভার অধীন। কংগ্রেসের তরুণকান্তি ঘোষকে টক্কর দিয়ে চার বার সাংসদ হন ফরওয়ার্ড ব্লকের চিত্ত বসু। তখন ফ্লেক্স-হোর্ডিংয়ের চল ছিল না। ছিল না দেওয়াল-লিখন নিয়ে এমন কড়াকড়িও। কারা কোন দেওয়াল-লিখনে শিল্প-নৈপুণ্য দেখিয়েছে, সে চর্চা চলত পাড়ায় পাড়ায়। ভোট আসতেই কখনও হাবরা, কখনও বারাসত ছুটতে হতো বনগাঁর চিত্রশিল্পী ওয়ালিয়র রহমানকে। ‘দ’ দিয়ে ছোটরা যেমন পাখি আঁকে, তেমনই ‘২’ দিয়ে সিংহ আঁকা শুরু করতেন তিনি। ২ হয়ে উঠত সিংহের হাঁ করা চোয়াল। ৫০ টাকা পারিশ্রমিকে পাঁচ লিটার কেরোসিনে (রঙের মাধ্যম) যতগুলি সিংহ আঁকা যায়, সেই চুক্তিতে ছবি আঁকতেন তিনি। চার রকম হলুদ রঙে ফুটে উঠত পশুরাজ।

সে দিন আর নেই। প্রচারের ধরন বদলেছে। তবু দেওয়াল-লিখন রয়েছে। জোটপ্রার্থীর নাম লিখলে প্রতীকও আঁকতেই হবে। কিন্তু সিংহ যে সহজে বাগ মানবে না বুঝে গিয়েছে কংগ্রেস। এক কংগ্রেসকর্মীর মন্তব্য, ‘‘পশুরাজকে বাগ মানানো কি চাট্টিখানি কথা। হোক না দেওয়ালে। পশুরাজ তো!’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement