দেশের সংসদে গেরুয়া রাজপাট শুরু হয়ে গেলেও বাংলার মাটিতে পদ্ম ফোটা বাকি তখনও। কিন্তু তখনই বাংলার হাওয়ায় গেরুয়া আভাস দেখতে পেয়েছিলেন তিনি। তাই বামজনতাকে সতর্ক করেছিলেন, ‘‘সামনে বড় লড়াই। তৈরি হও। শুধু লড়লে হবে না। জিততে হবে।’’
ব্রিগেডের সমাবেশের সঙ্গে এমনই নিবিড় যোগ ছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের। গঙ্গাপাড়ে গজিয়ে ওঠা কংক্রিটের জঙ্গলের মধ্যে ওই এক পশলা সবুজই ছিল তাঁর কাছে আবহমান যন্ত্র। লালঝান্ডার ওড়া দেখেই মেপে নিতেন হাওয়ার গতি।
জোড়াফুল নাকি পদ্ম, ২০২১-এ নীলবাড়ির ভাগ্য নির্ধারণে যখন ব্যস্ত গোটা রাজ্য, সেই সময় আরও বেশি করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে ২০১৫-র ডিসেম্বরে ব্রিগেডের মাঠে বুদ্ধদেবের শেষ ভাষণ। রবিবার ব্রিগেডের সভার আগে বুদ্ধদেবের সেই কথা তাঁর মনেও যে ঘুরছে, সে কথা নেটমাধ্যমে ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন সিপিএম-এর রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র।
তবে সূর্যকান্ত একা নন। লালফৌজিরা তো বটেই, বাংলার মাটিতে অস্তিত্ব রক্ষায় ‘বুদ্ধ-আবেগ’ আঁকড়ে ধরতে চাইছে কংগ্রেসও। তাই অসুস্থতার কারণে সশরীরে বুদ্ধদেবকে পাওয়া না গেলেও তাঁর লিখিত ভাষণ পড়ে শুনিয়েই ব্রিগেডের মাঠে বুদ্ধদেবকে রাখতে চাইছে তারা। বুদ্ধদেব ছাড়া ব্রিগেড ভাবা যায় না, এই উক্তি এখন মুখে মুখে ঘুরছে বাম-কংগ্রেস জোটের।
তবে ব্রিগেডের সঙ্গে বুদ্ধদেবের এই নাড়ির সম্পর্ক একদিনে গড়ে ওঠেনি। বাবা-কাকার হাত ধরে সদর দরজা দিয়ে বামপন্থা তাঁদের বাড়িতে ঢুকে পড়েছিল ঢের আগেই। ছাত্রজীবনেই তাই বামপন্থী রাজনীতিতে অভিষেক বুদ্ধদেবের।
কলেজ জীবনে এনসিসি ক্যাডেট ছিলেন বুদ্ধদেব। তখন থেকেই মাঠে-ময়দানে যাতায়াত শুরু তাঁর। শিক্ষিত, মার্জিত, সুলেখক এবং সর্বোপরি সুবক্তা হিসেবে সেখান থেকেই তরুণ বামপন্থীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা তৈরি হয় তাঁর। ছয়ের দশকে ডিওয়াইএফআই-এর প্রথম রাজ্য সম্পাদক নিযুক্ত হন তিনি।
তবে বামজনতার মধ্যে তখনও প্রথম সারির নেতা হয়ে উঠতে পারেননি বুদ্ধদেব। ব্রিগেডের মাঠে নিয়মিত হাজিরা দিলেও মঞ্চে ওঠার সুযোগ অধরাই ছিল। ১৯৭৭ সালে প্রথম বার বামফ্রন্ট সরকার গঠন করে বাংলায়। সে বছর কাশীপুর থেকে বিধায়ক নির্বাচিত হন বুদ্ধদেব।
ছাত্র রাজনীতি থেকে বিধায়ক হওয়ার পরেও ব্রিগেডের মঞ্চে ওঠার সুযোগ হয়নি বুদ্ধদেবের। বরং মাঠে থেকেই দলের হয়ে কাজ করে গিয়েছেন। কিন্তু উত্তরসূরিকে চিনতে ভুল করেননি জ্যোতি বসু। রাজ্য রাজনীতিতে ক্রমশ গুরুত্ব বাড়তে থাকে বুদ্ধদেবের। সেখান থেকেই মঞ্চে ওঠার সুযোগ। তার পর বক্তা হয়ে ওঠা।
১৯৮২ সালে কাশীপুর বিধানসভা কেন্দ্রে হেরে যান বুদ্ধদেব। তার পর ১৯৮৭ সালে যাদবপুর কেন্দ্রে সরে আসেন তিনি। ২০১১ সালে তৃণমূলের মণীশ গুপ্তের কাছে পরাজিত হওয়া পর্যন্ত ওই কেন্দ্রেই ছিলেন তিনি। তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রক, পুর ও নগরোন্নয় মন্ত্রক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের মতো রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ দফতরের দায়িত্বও সামলেছেন।
১৯৯৯ সালে রাজ্যের উপ-মুখ্যমন্ত্রী হন বুদ্ধদেব। পরের বছরেই মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসে রাজপাট সামলানোর গুরুদায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর কাঁধে। আর সেই দীর্ঘ যাত্রাপথেই আনকোরা থেকে প্রথমে অন্যতম এবং পরে ব্রিগেডের মুখ্য আকর্ষণ হয়ে ওঠেন বুদ্ধদেব। অবসর গ্রহণের পরেও সেই সময় ব্রিগেডে নিয়মিত দেখা যেত জ্যোতি বসুকে। সেই সময় ব্রিগেডে মুখ্য বক্তা ছিলেন বুদ্ধদেব। জ্যোতি বসু মঞ্চে থাকলে আলো কিছুটা ভাগ হয়ে যেত যদিও। কিন্তু ২০১০ সালে জ্যোতি বসুর প্রয়াণের পর ব্রিগেডের একচ্ছত্র অধিপতি ছিলেন বুদ্ধদেবই।
২০০৬ থেকে ২০১১— শিল্পায়নের বিরুদ্ধে জমি আন্দোলন ঘিরে যখন লালদুর্গের টালমাটাল অবস্থা, সেই সময়ও তাতে ছেদ পড়েনি বিন্দুমাত্র। বরং কৃষক সভা-সহ সিপিএম-এর বিভিন্ন জনসংগঠনের ডাকে ব্রিগেডে একাধিক সমাবেশে ভাষণ দিতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। কিন্তু যে দৃপ্ত কণ্ঠস্বর শুনে লালফৌজের রক্ত টগবগ করে ফুটত, তত দিনে সেই স্বর অনেকটা স্তিমিত। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে ক্লান্তির সুর গলায়।
তবে হার নিশ্চিত জেনেও মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে যান বুদ্ধদেব। জমি আন্দোলনে উত্তপ্ত নন্দীগ্রামে ২০০৬ সালের ৬ জানুয়ারি প্রথম প্রাণহানি ঘটে। ৭ জানুয়ারি সকালে শঙ্কর রায় এবং শেখ সেলিমের মৃত্যুর খবর স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে গোটা রাজ্যে। কিন্তু ওই দিন ব্রিগেডে বামেদের সভা আগে থেকেই ঠিক ছিল। সে দিনও মূল বক্তা ছিলেন বুদ্ধদেবই।
ওই দিন টাটা সেন্টারকে সামনে রেখে শিল্পায়নের গুরুত্ব বোঝানোর মরিয়া চেষ্টা করতে দেখা গিয়েছিল বুদ্ধদেবকে। বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘‘কৃষি আমাদের ভিত্তি। শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ।’’ জানিয়েছিলেন, নন্দীগ্রামের মানুষ না চাইলে এক ছটাক জমিও নেওয়া হবে না।
কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। ২০১১-য় যাদবপুরে পরাজিত হন তিনি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে গদি ছেড়ে দিতে হয় তাঁকে। সেই ধাক্কা আজও সামলে উঠতে পারেননি বুদ্ধদেব। তবে তার মধ্যেও দলের সঙ্গ ছাড়েননি। ২০১৫ সালে কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি সরকার গড়ার পর ব্রিগেডে সিপিএমের সভায় সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করেন তিনি। সেখানে বলেন, ‘‘দেশের অবস্থা ভাল নয়। বিজেপি বিষ ছড়াচ্ছে। আগুন ছড়াচ্ছে। তাতে দেশ ছারখার হয়ে যাবে। মানুষের ডাল-রুটি নিয়ে টান দিয়েছে বিজেপি। এদের সরাতেই হবে।’’
ওই সভা থেকেই রাজ্যের মমতা সরকারকেও তীব্র আক্রমণ করেন বুদ্ধদেব। বলেন, ‘‘রাজ্যের অবস্থা ভয়ঙ্কর। এই সরকার রাজ্যকে সর্বনাশের কিনারায় রাজ্যকে দাঁড় করিয়েছে। রাজ্য এখন দেউলিয়া। মানুষের ভবিষ্যৎ নেই। যুবকদের ভবিষ্যৎ নেই। কলকারখানা হচ্ছে না। আত্মহত্যা, আত্মহত্যা। আর সরকার এই আত্মহত্যা নিয়ে উৎসব করছে।’’
বুদ্ধদেব আরও বলেন, ‘‘আপনাদের বলছি— তৃণমূল হটাও, বাংলা বাঁচাও। বিজেপি হটাও, দেশ বাঁচাও। আজ সভা থেকে ফিরে যাবেন। কিন্তু মনে রাখবেন, সামনে বড় লড়াই। তার জন্য তৈরি হতে হবে। এ লড়াই শুধু লড়লে হবে না, জিততে হবে।’’
সেই শেষ। শ্বাসকষ্টের সমস্যা কাবু করে ফেলায় আর ব্রিগেডে বক্তৃতা করা হয়নি তাঁর। কিন্তু ব্রিগেডের মায়া ত্যাগ করতে পারেননি। তাই ২০১৯-এর ৩ ফেব্রুয়ারি নাকে অক্সিজেনের নল লাগানো অবস্থাতেই ব্রিগেডে হাজির হন বুদ্ধদেব। চিকিৎসকের নিষেধে গাড়ি থেকে নামা হয়নি। সবমিলিয়ে ১২ মিনিট ছিলেন ব্রিগেডের মাঠে। কিন্তু ওই ১২ মিনিটই অক্সিজেন জুগিয়েছিল বামেদের।