নুইয়ে পড়া মেরুদণ্ডটা ২১ এপ্রিলের ভোটেই খাড়া হওয়ার চেষ্টা করছিল। পুরোটা সোজা করা যায়নি। শনিবারের ভোটে মেরুদণ্ড সোজা করে খাড়া হয়ে সটান দাঁড়িয়ে পড়ল কলকাতা পুলিশ।
সুরজিৎ করপুরকায়স্থ যা পারেননি, রাজীব কুমারের স্বল্পকালীন রাজ্যপাটে যা সম্ভব হয়নি, সেটাই করে দেখাল সৌমেন মিত্রের বাহিনী। তাঁর নির্দেশে মেটিয়াবুরুজ থেকে বেনিয়াপুকুর, তপসিয়া থেকে পঞ্চসায়র— এমন ভাবে তারা ছক্কা হাঁকাল যে কসবার মুন্না পাণ্ডে, বন্দরের মুন্না, চেতলার প্রতাপ সাহা, বেহালার যিশুরা সারা দিন কুঁকড়ে থাকল। শাসক-বিরোধী তো বটেই, নির্বাচন কমিশনের প্রশংসা কুড়িয়ে ডার্বিতে ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ কিন্তু কলকাতা পুলিশই।
শাসক দলের তল্পিবাহক হয়ে ক্রমে নিজেদের আত্মবিশ্বাসটাই হারিয়ে ফেলেছিল বাহিনী। শাসক দলের দাদার নেতৃত্বে থানায় হামলা হয়েছে লাঠি নিয়ে তেড়ে যাওয়ার বদলে কলকাতা পুলিশ টেবিলের নীচে ঢুকেছে পিঠ বাঁচাতে! মাথা বাঁচাতে চাপা দিয়েছে ফাইল! এমন হেনস্থার পরেও সেই দাদার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগই লিপিবদ্ধ করেনি তারা। সেই পুলিশই শনিবার মন্ত্রী মণীশ গুপ্তর সঙ্গে থাকা তৃণমূল বাহিনীকে হটিয়েছে। তাড়া করে এলাকা ছাড়া করেছে বুথের সামনে ভিড় করে থাকা তৃণমূল কর্মীদের।
২১ এপ্রিল কলকাতার প্রথম দফার ভোটেই সৌমেন মিত্রের বাহিনী উত্তর কলকাতার দাদা-দের বুঝিয়ে দিয়েছিল, কলকাতা পুলিশ এ বার প্রকৃত পুলিশ হয়ে উঠতে চলেছে। লালবাজারে তাঁরই এক সেনাপতি এ দিন ভোটের পরে বলেন, ‘‘২১ তারিখের ভোটটা ছিল স্টেজ রিহার্সাল। এ দিন নাটক মঞ্চস্থ হল!’’ কী ভাবে এটা সম্ভব হল? দিনের শেষে লালবাজারে বসে কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) সুপ্রতিম সরকারের বিনীত মন্তব্য, ‘‘শহরে শান্তিপূর্ণ ভোট করানোর লক্ষ্য ছিল কলকাতা পুলিশের। সেই লক্ষ্য পূরণে আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। আমরা আমাদের কাজটা করতে পেরেছি।’’
রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তা জানাচ্ছেন, ২১ এপ্রিলের ভোটে কলকাতা পুলিশের ভূমিকার প্রভাব পড়েছিল বিধাননগর কমিশনারেট, ব্যারাকপুর কমিশনারেট এবং হাওড়া কমিশনারেটের উপরেও। উজ্জীবিত হয়েছে জেলা পুলিশও। ২৫ এপ্রিলের ভোটে তাই বিরোধীরা ১০-এ ১০ দিয়েছিলেন পুলিশকে। শাসক দল গালমন্দ করেছিল। আর এ দিন পুলিশ অতিসক্রিয় থাকলেও উছলে খেলেনি। ফলে শাসক দলও পুলিশের বিরুদ্ধে নালিশ জানানোর অবকাশ পায়নি। তাদের যত অভিযোগ কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে। এ দিন নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগও জমা পড়েছে অনেক কম।
পুলিশের মতো কাজ করে এ দিন দিল্লির নির্বাচন কমিশনেরও প্রশংসা কুড়িয়ে নিয়েছে কলকাতা ও রাজ্য পুলিশ। নির্বিঘ্নে ভোট মেটার যাবতীয় কৃতিত্ব পুলিশকেই দিচ্ছে কমিশন। পশ্চিমবঙ্গের ভারপ্রাপ্ত উপ মুখ্য নির্বাচন কমিশনার সন্দীপ সাক্সেনা বলেন, ‘‘পুলিশ পর্যবেক্ষকেরা এ দিন যে রিপোর্ট দিয়েছেন তাতে বলা হয়েছে, এ দিন পুলিশ অত্যন্ত সক্রিয় ছিল। প্রতিটি অভিযোগের দ্রুত নিষ্পত্তি করেছে তারা। পুলিশের ভূমিকা প্রশংসনীয়।’’
রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের এক অফিসারের মতে, কলকাতা পুলিশ হল রাজ্যের গোটা পুলিশ বাহিনীর মুখ। কলকাতা পুলিশের মুখ পুড়লে গোটা রাজ্যের পুলিশের উপরে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ২১ এপ্রিল কলকাতা পুলিশ সক্রিয় হতেই নির্দিষ্ট বার্তা পেয়ে গিয়েছিল রাজ্য পুলিশের বাহিনী। তাদেরও যে মেরুদণ্ড রয়েছে, তা প্রমাণ করার দায় ছিল।
এত দিন কলকাতা পুলিশের ভূমিকায় যিনি নিজেই লজ্জায় মুখ লুকিয়েছেন, সেই কলকাতা পুলিশের প্রাক্তন কমিশনার তুষার তালুকদার শনিবার বলেন, ‘‘এ দিন কলকাতা পুলিশ যা করেছে তার জন্য বাহিনীকে অভিনন্দন। কলকাতা পুলিশের হাবেভাবে আগাগোড়া একটা সদর্থক ভঙ্গি চোখে পড়েছে।’’ কমিশনের চাপেই কি বদলেছে পুলিশের ভূমিকা? তুষারবাবু বলেন, ‘‘কমিশনের পাশাপাশি বাহিনীর সর্বোচ্চ স্তরে সদিচ্ছার প্রভাব পড়েছে ভোটে।’’ প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার মনে করেন, ‘‘গত কয়েক বছরের বেশ কিছু ঘটনা সাধারণ মানুষের মতো পুলিশের নিচু তলাতেও প্রভাব ফেলেছিল। মেরুদণ্ড সোজা রেখে সেই গ্লানি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছে বাহিনী। তারই প্রতিফলন শনিবারের ভোটে।’’
লালবাজারের এক কর্তা জানাচ্ছেন, নির্বাচনের ঠিক মুখে দায়িত্ব নিয়ে সৌমেনবাবু থানাগুলির কাছে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন। তাতে বলা ছিল— পাড়ার ‘দাদা’-দের যেন থানার চৌহদ্দি ধারে কাছে দেখা না যায়।
‘দাদা’-দের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে এসে কেউ যেন থানা থেকে ফিরে না যায়। পুলিশের গায়ে হাত তুলে কেউ যাতে রেহাই না পায়।