প্রচারে নায়ক। তৃণমূল প্রার্থীদের হয়ে দেব হাজির বারাবনিতেও। মঞ্চে মুকুল রায়। শুক্রবার। —নিজস্ব চিত্র।
শুকনো ঝোড়ো হাওয়ায় ঘূর্ণি তুলে মুগবসানের মাটিতে নামল তৃণমূলের তারকা-সাংসদের হেলিকপ্টার। দেবের নিজের গ্রাম মহিষদা থেকে কেশপুরের এই এলাকাটা কিলোমিটার আটেক দূরে। মঞ্চে উঠেই দেব বলতে শুরু করলেন, “ছোটবেলায় গ্রামে থাকার সময় বোমার আওয়াজ শুনতাম। রাতে বাইরে বেরোতেও ভয় পেতেন অনেকে। আর ভয় করে না। শান্তিটা এখন আমাদের কাছে আছে।’’
বোমা-গুলি, বারুদে ভারী বাতাস আর খুনোখুনির ট্র্যাডিশনে তবে কি সত্যিই দাঁড়ি পড়েছে কেশপুরে?
মুগবসানে দেবকে দেখতে আসা অল্পবয়সী ভিড় থেকে কিন্তু উল্টো সুর এল কানে। রুকসানা বেগম, আরফিনা, সুলতানারা বললেন, “কীসের শান্তি! দিনকয়েক আগেও গ্রামে বোমা-গুলির শব্দ পেলাম যে!”
কেশপুর নামটার সঙ্গেই লেপ্টে রয়েছে রাজনীতির হানাহানি, সন্ত্রাস। বাম আমল থেকেই গ্রাম দখলের সংঘর্ষ, সশস্ত্র দুষ্কৃতীদের দাপট, একবগ্গা রাজনীতি দেখে অভ্যস্ত পশ্চিম মেদিনীপুরের এই জনপদ। লোকে বলত, সিপিএমের হুকুম ছাড়া কেশপুরে গাছের পাতাও নড়ে না। তখন এই ‘লালদুর্গ’-এ যাবতীয় রাজনীতির ভরকেন্দ্র ছিল সিপিএমের জোনাল অফিস— ‘জামশেদ আলি ভবন’। বিরোধীদের অভিযোগ ছিল, যাবতীয় সন্ত্রাস চালানো হত এই পার্টি অফিস থেকে। তল্লাটে আতসকাচে খুঁজতে হত বিরোধীদের। বিরোধী স্বর শোনা গেলে হয় সামাজিক বয়কটের মুখে পড়তে হত, না হলে স্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হল সাদা থান।
এ বার জঙ্গলমহলে ভোটের পরে যে ভুতুড়ে ভোট নিয়ে এত কাঁটাছেঁড়া, তা-ও কেশপুরবাসীর কাছে পুরনো। বুথমুখো না হওয়ার হুমকি, অবাধ ছাপ্পা, বিরোধী-হীন বুথে একশো ভাগ ভোট করা, এ সবই দস্তুর ছিল কেশপুরে। ২০০১-এ বিধানসভা ভোটে বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হুঁশিয়ারি ছিল, ‘কেশপুর সিপিএমের শেষপুর’ হবে। হয়নি। উল্টে সিপিএমের নন্দরানি ডল জেতেন ১ লক্ষ ৮ হাজার ভোটে। রাজ্যে সেটাই ছিল রেকর্ড ব্যবধান। বিস্তর বিতর্কেও বদলায়নি ছবি। ২০০৬-এ সিপিএম এখানে জেতে ৬৬ হাজার ভোটে। রং বদলায়নি ২০১১-র ঝড়েও। ৩৪ হাজার ভোটে জেতেন সিপিএমের রামেশ্বর দোলুই।
তবু আশা জেগেছিল কেশপুরে। এ বার হয়তো ফিরবে শান্তি। কারণ, বদলের বার্তা দিয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী। কিন্তু কোথায় কী! রাজ্যপাটে আসতেই কেশপুরেও শুরু হয়ে যায় শাসক দলের দাপট। সামনে আসে বিরোধীশূন্য কেশপুরের চেনা ছবি। একে একে ঝাঁপ বন্ধ হয় সিপিএমের ১৫২টি শাখা কার্যালয়, ৭টি লোকাল কমিটির কার্যালয়। খোলা ছিল শুধু জোনাল কার্যালয় জামশেদ ভবন। মারধর, হুমকি, মামলায় নাম জড়িয়ে একের পর এক সিপিএম নেতা-কর্মী এলাকা ছাড়েন। দীর্ঘ হয় ঘরছাড়াদের তালিকা। থামেনি রাজনৈতিক সংঘর্ষও। খুন হয়েছেন বাম কর্মী, কখনও দলের কোন্দলে তৃণমূলের জেলা পরিষদ সদস্যার প্রাণ গিয়েছে গুলিতে। অশান্তি ঠেকাতে এই পাঁচ বছরে ওসি বদল হয়েছে ছ’-ছ’বার।
স্থানীয় বাসিন্দা শেখ নাসিরউদ্দিন, শেখ আজহাররা বলছেন, “গোলমাল আর ভাল লাগে না। কেশপুরের সকলে শুধু শান্তি চান।” বেনজির ইয়াসমিনের মতো গৃহবধূরাও বলছেন, “আর কিছু চাই না। এলাকায় শান্তি থাকলেই হল।”
কিন্তু ভোট এলেই সিঁটিয়ে যান কেশপুরবাসী। কারণ, এখানে জোর যার, মুলুক তার। ২০১৩-র পঞ্চায়েত ভোটে এলাকায় নিরঙ্কুশ হয় ঘাসফুল। ১৫টি গ্রাম পঞ্চায়েতের সবক’টি যায় শাসক দলের দখলে। সে বার পঞ্চায়েত ভোটে কেশপুর বিধানসভা এলাকায় তৃণমূলের ‘লিড’ ছিল ১ লক্ষ ৩৩ হাজার। আর ২০১৪-র লোকসভা ভোটে কেশপুর বিধানসভায় তৃণমূল এগিয়ে ছিল ১ লক্ষ ১৭ হাজার ভোটে। এই সব হিসেব বাম আমলের রেকর্ডকেও ছাপিয়ে গিয়েছে।
দেবের সভার টুকরো টুকরো ছবিও বলে দিচ্ছে তমাল, পারাং, কুবাই দিয়ে অনেক জল বয়ে গেলেও সন্ত্রাসের আবহে চিরচেনা কেশপুরে সেই ‘ট্র্যাডিশন’ সমানে চলছে। শুধু রং বদলেছে, জায়গা বদল করেছে শাসক-বিরোধী। তবু আশা জেগেছিল এ বারও। নির্বাচন কমিশন কড়াকড়ির কথা শোনানোয় কেউ কেউ ভেবেছিলেন সত্যিকারের ভোট বুঝি হবে। ভোটের ঢের আগে কেন্দ্রীয় বাহিনী আসায় একটু আলোর রেখাও দেখা গিয়েছিল। সিপিএমের ২টি লোকাল কমিটি এবং ৪টি শাখা কমিটির দফতর খেলে। কিন্তু সন্ত্রাসের থাবা পড়ে সেখানেও। দলীয় কর্মীরা বয়কটের মুখে পড়ায় লোকাল কমিটির দু’টি দফতর ফের বন্ধ হয়ে যায়।
সিপিএমের কেশপুর জোনাল সম্পাদক মানিক সেনগুপ্ত বলেন, “কর্মীরা দোকান-বাজারে যেতে পারছিলেন না। জলও মিলছিল না। এ ভাবে আর ক’দিন চলতে পারে!” এই অবস্থায় প্রচারও তেমন জমেনি। কেশপুরের সিপিএম প্রার্থী রামেশ্বর দোলুই বলছেন, ‘‘পতাকা লাগালে ছিঁড়ে দিচ্ছে। এ ভাবে কি অবাধ ভোট সম্ভব?” তৃণমূলের ব্লক সভাপতি সঞ্জয় পানের কটাক্ষ, “মানুষ ওদের সঙ্গে না থাকলে আমরা কী করব!”
‘ট্র্যাডিশন’ বজায় রয়েছে তৃণমূলের প্রার্থী বাছাইয়েও। অতীত বলছে, এই বিধানসভা আসনে এক জনকে দ্বিতীয় বার টিকিট দেননি মমতা। এ বারও তার অন্যথা হয়নি। ২০১৬-য় কেশপুরে ঘাসফুলের প্রার্থী শিউলি সাহা। তিনি হলদিয়ার বিদায়ী বিধায়ক। দলের অন্দরে খবর, শিউলিকে হলদিয়া-ছাড়া করিয়েছেন শুভেন্দু অধিকারী। গত লোকসভা ভোটের হিসেব, তৃণমূল এখানে পেয়েছিল ৭৬.৯০% ভোট। শিউলির তাই চিন্তায় থাকার কথা নয়। শুধু ‘বহিরাগত’ হওয়ায় বিঁধছে কোন্দলের কাঁটা। সেই কাঁটা তুলতে ভরসার পাত্রও রয়েছে শিউলির। ‘মুকুলদা’।
তৃণমূলের অন্দরে বরাবর সাংসদ মুকুল রায়ের ঘনিষ্ঠ হিসেবেই পরিচিত শিউলি। মুকুল যখন তৃণমূলের চক্ষুশূল, সেই পর্বে সাসপেন্ড হন শিউলি। দিদিকে টেক্সট করে, পরে চিঠি লিখে তিনি ক্ষমা চেয়ে নেন। এ বারও তাঁর প্রচারে নিজের মহিমা ঢেলে দিয়ে গিয়েছেন ‘মুকুলদা’। কোন্দল সামলাতে বলে গিয়েছেন, “মনে রাখবেন, ভোটটা শিউলি সাহাকে নয় দেবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই!”
আরও পড়ুন:
সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখুন, বললেন দেব