মা কার পাশে, উত্তর খুঁজছে গাইঘাটা

গোটা গাইঘাটা জুড়েই যেন অমিতাভ বচ্চনের এক-একটা সিনেমা।গাইঘাটা থানা পেরোতেই প্রশ্ন, ‘ইতনা সন্নাটা কিঁউ হ্যায় ভাই?’শোলের দৃষ্টিহীন বৃদ্ধ ইমামের (এ কে হাঙ্গল) প্রশ্ন নয়। রাস্তায় বেরিয়ে এ প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন গোবরডাঙার বাবুপাড়ার প্রবীণ মাস্টারমশাই।

Advertisement

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:১৩
Share:

গোটা গাইঘাটা জুড়েই যেন অমিতাভ বচ্চনের এক-একটা সিনেমা।

Advertisement

গাইঘাটা থানা পেরোতেই প্রশ্ন, ‘ইতনা সন্নাটা কিঁউ হ্যায় ভাই?’

শোলের দৃষ্টিহীন বৃদ্ধ ইমামের (এ কে হাঙ্গল) প্রশ্ন নয়। রাস্তায় বেরিয়ে এ প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন গোবরডাঙার বাবুপাড়ার প্রবীণ মাস্টারমশাই।

Advertisement

বাস্তবিকই ভোটের আগে বড় চুপচাপ গাইঘাটার মানুষজন। তীব্র গরমে ঘরে পাখার নীচে বসিয়ে কাঁচা আম পোড়া শরবৎ খাওয়াবেন, কিন্তু ভোট নিয়ে প্রশ্ন করলেই, যেন সেই ভূতের সিরিয়াল, ‘স্সস, কোই হ্যায়।’’

মানুষ বড় চুপচাপ, কিন্তু এলাকা সরগরম।

শনিবার তখন বিকেল ৪টে। শেষ মুহূর্তের প্রচারে অটো-টোটো, মিছিলে কানে তালা লাগার জোগাড় গোবরডাঙা, ঠাকুরনগর, গাইঘাটায়। গলদঘর্ম তিন প্রার্থীই।

কোথায় ‘সন্নাটা?’ পানের দোকানের ভিড়ে পাল্টা প্রশ্ন করেন মাঝবয়সী মানুষটি। ‘‘কত শুনবেন? লিখুন না মতুয়াবাড়ির ভিতরে-বাইরের কোন্দলের কথা!’’

তৃণমূলের এক সময়কার মন্ত্রিসভার সদস্য (পরে দল থেকে বহিষ্কৃত) ঠাকুরবাড়ির ছোটঠাকুর মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর এক সময়ে ঝুঁকেছিলেন বিজেপির দিকে। তাঁর বৌদি, প্রয়াত সাংসদ কপিলকৃষ্ণের স্ত্রী মমতাবালা ঠাকুর বর্তমানে তৃণমূলের সাংসদ। দেওর-বৌদি আদায়-কাঁচকলার সম্পর্ক, সে কথা জানে গোটা গাইঘাটা।

বস্তুত, গাইঘাটার ভোটের পরিবেশ নিয়ে দু’কথা যদি বা ওঠে, প্রথমেই এসে পড়ে মতুয়াবাড়ির কোন্দলের কথা।

তারপরেও বলাবলি শুরু হয় তৃণমূলে ‘বহিরাগত’ প্রার্থী নিয়ে। একজন ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘‘আরে বৃদ্ধ আইএএস, দম্ভে তো মাটিতে পা পড়ে না। যারা প্রার্থী হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল, তারা সব খচে বোম হয়ে আছে।’’ এক ফিচেল যুবক জানিয়ে নিচু গলায় বলে যান, ‘‘জোটের হয়ে সিপিএম, কংগ্রেসের নেতারা কিন্তু তেমন খাটছে না। আর ও দিকে, প্রচুর টাকা ঢালছে বিজেপি।’’

আপনার নাম?

এ বার পলায়ন। ঠিক ‘শানের’ চাকা লাগানো গাড়ি চালিয়ে মাজহার খানের মতো দে-দৌড় দে দৌড়। ‘‘পাগল, নাম বলি, লিখে দিন কিছু একটা….‘নাম হ্যায় আব্দুল মেরা, সবকা খবর রাখতা হুঁ।’’

ঠাকুরনগরের ঠাকুরবাড়ি ঢুকলেও যেন সত্তর দশকের ‘দিওয়ার’। রবির (শশী কাপুর) দিকে তাকিয়ে বিজয় বর্মার (অমিতাভ) ফিরিস্তির পরে যেমন ছিল পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘কেয়া হ্যায় তুমহারে পাস?’ তার পরেই সেই বিখ্যাত ডায়লগ— ‘‘মেরে পাস মা হ্যায়, মা।’’

ঠিক সেই চিত্র। ভোটের ময়দানে নেমে গত বিধানসভা ভোটের আগে গাইঘাটার মতুয়া বাড়ির ছোটছেলে মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর সগর্বে বলতেন, মেরে পাস মা হ্যায়। গত বারের তৃণমূল প্রার্থী মঞ্জুলবাবু এ বার ভোটের ময়দানে নেই। তৃণমূল-বিজেপি— দু’তরফের আম-ছালা হারিয়ে ইদানীং কার্যত ঘরবন্দি তিনি।

এ বার গাইঘাটায় শাসক বা বিরোধী কোনও দলের প্রার্থীই জোরের সঙ্গে দাবি করতে পারছেন না, ‘মেরে পাস’ বড়মা ‘হ্যায়।’ আর সে কারণেই এ বার ভোটের লড়াই হাড্ডাহাড্ডি।

বড়মা মানে সারা ভারত মতুয়া মহাসঙ্ঘের প্রধান উপদেষ্টা বীণাপানি ঠাকুর। মঞ্জুল-কপিলের মা তিনি। মতুয়া প্রভাবিত গাইঘাটা কেন্দ্রে প্রতিটি ভোটে মতুয়া ধর্মের মানুষেরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন বলে দাবি রাজনৈতিক দলগুলির। আগে বামেরা, ২০০৮ সালের পর থেকে তৃণমূল মতুয়া ধর্মের বেশিরভাগ মানুষের সমর্থন একচেটিয়া পেয়ে আসছে।

কিন্তু এ বার?

মা এ বার কোন পক্ষে বলা মুশকিল। ডান-বাম সব পক্ষের প্রার্থীরাই ঠাকুরবাড়িতে গিয়ে বড়মার আশীর্বাদ নিয়ে এসেছেন। বড়মা কাউকেই নিরাশ করেননি। সকলকেই মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেছেন। মুখে বলেছেন, ‘‘ঠাকুরের কাছে গিয়ে আশীর্বাদ চেয়ে নাও।’’ ঠাকুর মানে, বাড়িতে থাকা হরিচাঁদ ও গুরচাঁদের মন্দির।

গত বিধানসভা ভোটের আগে ছেলে মঞ্জুলের হয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাচনী জনসভার মঞ্চে হাজির থাকতে দেখা গিয়েছিল বড়মাকে। ফলে সে বার বড়মার সমর্থন কোন দিকে ছিল, তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি মতুয়া ভক্তদের। কিন্তু এ বার বিভ্রান্ত তাঁরাও। আর সে কারণেই আশার আলো দেখছেন জোট প্রার্থী।

গাইঘাটা কেন্দ্র থেকে এ বার জোট প্রার্থী, সিপিআইয়ের কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর। মতুয়া ধর্মের উপরে একাধিক বইপত্র লিখেছেন। মতুয়া বাড়ির সরাসরি সদস্য না হলেও ওই বাড়ির সঙ্গে আছে তাঁর নাড়ির টান। মতুয়া বাড়ির বড় ছেলে তথা বনগাঁর প্রয়াত সাংসদ তৃণমূলের কপিলকৃষ্ণ ঠাকুরের সঙ্গেও জোট প্রার্থীর সুসম্পর্ক ছিল। এক সঙ্গে মতুয়া ধর্মের প্রাণপুরুষ হরিচাঁদ ঠাকুরের দু’শোতম জন্মোৎসবও পালন করেছেন দু’জনে।

বামনগাছিতে বাড়ি হলেও কপিলবাবু নিজেকে ‘বহিরাগত’ বলতে নারাজ। ‘মিস্টার নটবরলাল’ এর মতোই তাঁর ব্যাখা, ‘‘মতুয়া সমাজ, উদ্বাস্তু আন্দোলন নিয়ে যাঁরা ভাবনা-চিন্তা করেন না, তাঁদের বাড়ি ঠাকুরনগরে হলেও তাঁরা তো আসলে বহিরাগতই।’’ প্রয়াত সাংসদের সঙ্গে নামের মিল থাকার বাড়তি ‘মাইলেজ’ ভোটের বাক্সে পাবেন বলে মনে করেন কপিলকৃষ্ণ।

সাহিত্যকর্ম ছেড়ে কেন ভোটের ময়দানে? ঠাকুরনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে দাঁড়িয়ে কপালের ঘাম মুছে, তিনি বলেন, ‘‘মতুয়া ধর্মের মানুষ যে সঙ্কটের মধ্যে আছেন, তা থেকে মুক্তি পেতে চাইছিলেন। তাই ভোটে দাঁড়িয়েছি।’’

অন্য দিকে তৃণমূল প্রার্থী তথা প্রাক্তন আমলা পুলিনবিহারী রায়কে ঠাকুরবাড়ি আর এলাকায় একাধিক বিধায়কের দাবি সামলাতেই প্রার্থী করা হয়েছে বলে তৃণমূলের একটি সূত্রের খবর। তবে ‘পুকার’ এর অমিতাভের মতো শেষ মুহূর্তে তারা সঙ্গে থাককবে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন আঠে দলের অন্দরেই।

সেই প্রসঙ্গ তুলতেই তৃণমূল প্রার্থী যেন, ‘ইনকিলাব’-এর অমিতাভ। বললেন, ‘‘সব অভিমান মুছে গিয়েছে। জীবনে অনেক কিছু সামলে এসেছি। এটুকু সামলাতে পারব না?’’

আর, নারদা-সারদা, বাম-কংগ্রেসের জোটকে কটাক্ষ করে গাইঘাটায় ‘নতুন আজাদির’ প্রতিশ্রুতিতে ‘জান কবুল’ করে ময়দানে মাইক ফুঁকছেন, বিজেপি প্রার্থী শঙ্কর ঠাকুর।

মনে করিয়ে দিচ্ছেন ‘ম্যায় আজাদ হুঁ’র আগুন-ঝরা অমিতাভ বচ্চনকেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement