প্রচারে অশোক ভট্টাচার্য। শিলিগুড়িতে। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।
আচ্ছা, ‘অশোকদা’ ঘুমোচ্ছেন কখন!
মাঝরাতে এসএমএস করলে উত্তর দেন। বস্তিতে গোলমালের খবর পেয়ে রাত ১টায় থানায় ফোন করেন। কাকভোরে দেখা যায় কলেজ মাঠে গিয়ে হাঁটছেন। কোনও দিন দেশবন্ধু পাড়ার মাঠে গিয়ে ফুটবলে পা ছোঁয়াচ্ছেন। কোনও দিন দাদাভাইয়ের মাঠে ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে ছক্কা হাঁকানোর চেষ্টা করছেন। বেলা বাড়তে দেখা যায় হাত জোড় করে এক ওয়ার্ড থেকে আর এক ওয়ার্ডে ছুটছেন। মিটিং-মিছিলে সবার সামনে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলে বাড়িতে ছুটে নাকে-মুখে গুঁজে ফের ছুটছেন এক পাড়া থেকে আর এক পাড়ায়।
যত ক্ষণ গাড়িতে থাকছেন, মোবাইলে কথা চলছে। ঘোড়ার মুখের খবর, দলের লোকরা বটেই, পাহাড়ের মোর্চা নেতা, ডাকসাইটে নকশাল ব্যক্তিত্ব, কেপিপি নেতা, বিজেপির নানা স্তরের নেতাদের সঙ্গেও অবিরল কথা চালাচালি হচ্ছে তাঁর। আরও জবর খবর, ছোট-বড়-মাঝারি অনেক তৃণমূল নেতার সঙ্গেও হাসি-ঠাট্টা, খবরাখবর আদানপ্রদানে ভীষণ স্বচ্ছন্দ সুভাষপল্লির ‘রতনদা’ মানে শিলিগুড়ির মেয়র অশোক ভট্টাচার্য।
রেকর্ড বলছে, দিনে প্রায় ১০০ এসএমএস, ১৫০টির বেশি ‘ইনকামিং’ ও অন্তত ১৩০টি ‘আউটগোয়িং’ কল। বিকেলে রোড শো। সন্ধ্যায় পথসভা। রাত ১০টা পর্যন্ত ‘ডোর-টু-ডোর’ চলছে তাঁর।
তা হলে খানই বা কখন? ঘুমোনই বা কত ক্ষণ!
রান্নাঘরে পাবদা মাছের ঝোল, সজনে ডাঁটার চচ্চড়ি, ডালের বাটি সাজাচ্ছিলেন সুভাষপল্লির রুদ্রেশ্বর ভবনের রত্নাবৌদি। অশোকবাবুর স্ত্রী কারও কারও কাছে রত্নাকাকিমাও বটে। বারান্দার পাশের ছোট্ট গাছে সুদৃশ্য ‘আম্রপালি’ আমে ভরে রয়েছে। পায়ের কাছে ঘুরঘুর করছে একটি বাদামি রঙের দেশি কুকুর। টেবিলে থালা দিয়ে পোষ্যটিকে সস্নেহে খাবার দেওয়ার পরে বললেন, ‘‘গত পাঁচটা বছর ধরে এ ভাবেই চলছে। যখন সময় পায় খায়। ঘুমোনোর ঠিকঠাকানা নেই। ফোনে কথা বলতেই থাকে। আবার ভোরে উঠে ছোটে।’’
আসলে ৫ বছর আগের ‘বড় ম্যাচে’ রাজনীতিতে একেবারে আনকোরা রুদ্রনাথ ভট্টাচার্যের কাছে হেরে যাওয়ার পরে খেলার ধরনটাই বদলে ফেলেছেন অশোক ভট্টাচার্য। বদলে গিয়েছে জীবন-দর্শনও। তাই তাঁর তুলনায় রাজনীতিতে নেহাতই নতুন হলেও তৃণমূলের ভাইচুং ভুটিয়াকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার মেজাজ দেখাচ্ছেন না। একাই গোল করার জন্য ছুটছেন না। বরং, মাঠে নামা ইস্তক ভাইচুং যে ভাবে তাঁর গোল লক্ষ্য করে দুমদাম ‘শট’ নিচ্ছেন, তা রুখে ঠান্ডা মাথায় প্রতি আক্রমণের ছক কষছেন। আশেপাশে নানা মানুষ জোগাড় করে তাঁদের সঙ্গে মিলেই আক্রমণে উঠছেন। একা বল ধরে ছোটার বদলে নানা জনের মধ্যে পাস খেলে ভারতের ফুটবল দলের প্রাক্তন অধিনায়কের ডিফেন্স ভাঙার চেষ্টা করছেন। কেননা, ‘শিলিগুড়ি মডেল’-এর জনক যে জানেন, পুরসভা থেকে মহকুমা পরিষদ সব লড়াইতেই এই ফর্মুলাই কাজ দিয়েছে। এটাও জানেন, পাহাড়ের যে অংশের ভোট তাঁকে আগে বেশ কয়েকবার বাঁচিয়ে দিয়েছিল, গতবার থেকেই সেই অংশটি তাঁর বিধানসভা এলাকা থেকে বাদ চলে গিয়েছে। যদিও শিলিগুড়ির কংগ্রেস ভোটটিও তাঁর ঝুলিতে পড়বে বলে আশা করছেন।
তাই ভোরবেলায় কলেজ মাঠের চায়ের ফেরিওয়ালা রঘু বর্মন ‘অশোকদা’কে চা খাওয়ানোর পরে রাত ১১টায় ঠেলা নিয়ে শান্তিনগরে যাওয়ার পথে সুভাষপল্লিতে বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে সেই লোকটাকেই কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলতে দেখে অবাক। মধ্যবয়সী রঘু বলেন, ‘‘এ তো দেখি ফেরিওয়ালার মতোই জীবন। নাওয়া-খাওয়া-ঘুমের কোনও মাথামুন্ডু নাই।’’
মরিয়া ভাইচুং বস্তিতে রাত কাটিয়ে, রাস্তার কলে স্নান করে তার মোকাবিলায় নেমেছেন ঠিকই। কিন্তু নিজের ডিফেন্স নিজেই নড়বড়ে করে দিয়েছেন। প্রথমে তো নাম ঘোষণার পরে কিছু দিন চুপচাপ বসে ছিলেন। তারপরে গৌতম দেবকে সরিয়ে যাঁকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দার্জিলিং জেলা তৃণমূলের সভাপতি করেছেন, সেই রঞ্জন সরকারকেই ভাইচুং কেবল দু’টি ওয়ার্ডের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তাতে তখন সবাই অবাক। সংগঠনকে ঠিক মতো ব্যবহার না করলে ভাইচুংয়ের হয়ে তা হলে পাসটা বাড়াবেন কে? শেষ পর্যন্ত দলনেত্রীর কথায় মাঝমাঠের হাল ধরেছেন রঞ্জনবাবুই।
একটু দেরি হয়ে গেল না তো ভাইচুং!