শহর যে এ বার শক্ত ঠাঁই, তা আগেই আঁচ করেছিলেন নেতারা। কিন্তু দুর্গাপুর লাগোয়া গ্রামীণ এলাকাও যে এ ভাবে মুখ ফিরিয়ে নেবে, ভাবেননি তৃণমূল নেতারা।
দুর্গাপুর পূর্ব কেন্দ্রটি শহরের ১৬টি ওয়ার্ড এবং কাঁকসার মলানদিঘি, আমলাজোড়া ও গোপালপুর পঞ্চায়েত এলাকা নিয়ে গড়া। গত বিধানসভা ভোটে এই কেন্দ্রে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে তৃণমূল প্রার্থী পেয়েছিলেন ৫১ শতাংশ ভোট, সিপিএমের থেকে ৬ শতাংশ বেশি। অথচ, ২০১৪-য় লোকসভা ভোটে আলাদা লড়ে তৃণমূল পায় প্রায় ৩৬ শতাংশ ভোট। সিপিএমের সঙ্গে ব্যবধান দাঁড়ায় এক শতাংশেরও কম। সে বার কংগ্রেস পেয়েছিল সাড়ে ৪ শতাংশ ভোট। এ বার ইস্পাতনগরীতে সিপিএমের এগিয়ে থাকার সম্ভাবনা থাকলেও কাঁকসার মলানদিঘি, আমলাজোড়া ও গোপালপুর পঞ্চায়েত এলাকায় দল ভাল ‘লিড’ পাবে, এমনটাই ভেবেছিলেন তৃণমূল নেতৃত্ব। কিন্তু তা হয়নি। গণনার প্রায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এগিয়ে ছিলেন সিপিএম প্রার্থী সন্তোষ দেবরায়।
এ বার এই কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী ছিলেন প্রাক্তন আমলা, কলকাতার প্রদীপ মজুমদার। তৃণমূলের সূত্রের খবর, দলের একাংশ এখানে বিদায়ী বিধায়ক নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়কেই প্রার্থী হিসেবে চেয়েছিলেন। বিধায়ক উন্নয়ন তহবিল এবং এডিডিএ-র চেয়ারম্যান হিসেবে নিখিলবাবু এই তিন পঞ্চায়েত এলাকায় বেশ কিছু কাজকর্ম করায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন বলে তৃণমূলের ওই অংশের মত। এমনকী, নিখিলবাবুর প্রার্থিপদের সমর্থনে দেওয়াল লেখা ও পোস্টারও পড়ে মলানদিঘি এবং আমলাজোড়া এলাকায়। দলের নেতারা প্রকাশ্যে একে ‘সিপিএমের কারসাজি’ বলে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও শেষরক্ষা হয়নি।
এই বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে পুরসভার ২ থেকে ১০ নম্বর ওয়ার্ড পড়ছে ইস্পাতনগরীতে। এই ৯টি ওয়ার্ডে সিপিএম তৃণমূলের থেকে ৫১৮১ ভোটে এগিয়েছিল। সিটুর সাংগঠনিক আধিপত্যের কাছে আইএনটিটিইউসি বারবার পিছিয়ে পড়ায় এমন সম্ভাবনার কথা আগেই আঁচ করা গিয়েছিল বলে দাবি তৃণমূলের একাংশের। ইস্পাতনগরী লাগোয়া গ্রামীণ এলাকা নিয়ে গড়া ১ নম্বর ওয়ার্ডেও সিপিএম এগিয়েছিল ১২৪৫ ভোটে। ২৩ থেকে ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে পড়ছে বন্ধ এমএএমসি কারখানার আবাসন এলাকা, ভ্যাম্বে কলোনির মতো বস্তি এলাকা, বিধাননগরের মতো অভিজাত এলাকা, হাটকো লাগোয়া বিভিন্ন সরকারি সংস্থার প্রাক্তন কর্মীদের ১৩টি সমবায় আবাসন ছাড়াও খয়রাশোল, সগড়ভাঙা, মুচিপাড়ার মতো এলাকা। এই ছ’টি ওয়ার্ডে সিপিএমের সম্মিলিত ‘লিড’ ছিল ৩৩৬৫ ভোটের। অর্থাৎ, পুর এলাকায় সিপিএম তৃণমূলের থেকে এগোয় ৯৭৯১ ভোটে।
এ বার গণনা শুরু হয়েছিল পুর এলাকা দিয়ে। একের পর এক রাউন্ডে তৃণমূল প্রার্থী প্রদীপবাবু পিছিয়ে পড়ছিলেন। কিন্তু তৃণমূল কর্মীরা নিশ্চিত ছিলেন, কাঁকসার তিনটি পঞ্চায়েত আমলাজোড়া, মলানদিঘি ও গোপালপুর এলাকা থেকে তারা অনেক বেশি ভোট পাবে। জিতে যাবেন দলের প্রার্থী, মনে করছিলেন তাঁরা। কিন্তু, বাস্তবে তা হয়নি। তিন পঞ্চায়েতেই সিপিএমের সঙ্গে তৃণমূলের হাড্ডাহাড্ডি টক্কর হয়। শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, সিপিএম প্রার্থী সন্তোষবাবু ভোট পেয়েছেন ২৪৩৬৯টি। প্রদীপবাবু পেয়েছেন তার থেকে মাত্র ৭৭০টি বেশি ভোট। এমনকী, পোস্টাল ব্যালটেও সিপিএম এগিয়ে ১১০ ভোটে। ৯১৩১ ভোটে হেরে যান প্রদীপবাবু।
হারের পরেই প্রদীপবাবু দাবি করেন, প্রচারে বেরিয়ে তৃণমূলের স্থানীয় কিছু নেতার উপরে মানুষের ক্ষোভ তিনি টের পেয়েছিলেন। দলের একাংশের মতে, গ্রামীণ এলাকায় গত কয়েক বছরে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নানা ঘটনায় প্রকাশ্যে এসেছে। দলের দুর্গাপুর জেলা (শিল্পাঞ্চল) সভাপতি উত্তম মুখোপাধ্যায় শুধু বলেন, ‘‘এলাকা ধরে-ধরে পর্যালোচনা শুরু হয়েছে। প্রয়োজনে বেশ কিছু কঠিন পদক্ষেপ করতে হতে পারে।’’
সিপিএম প্রার্থী সন্তোষ দেবরায়ের বক্তব্য, ‘‘মানুষের পাশে থাকার সুফল পেয়েছি আমরা।’’