বোমাগুলিতে অশান্ত নানুরের গ্রাম

সিঙ্গিতে গুলিতে খুন জোট সমর্থক

ভোটের আগে থেকেই জমিটা তেতে ছিল। ‘উল্টো’ ফল হওয়ার পরে সেই উত্তাপের পরিধিও বেড়েছিল। আশঙ্কা সত্যি করে এ বার গ্রাম দখলের লড়াই শুরু হল নানুরে। রাত থেকে বোমাবাজি, গোলাগুলিতে আতঙ্ক ছড়াল বিধানসভা কেন্দ্রের বিভিন্ন গ্রামে। গুলিতে প্রাণ গেল এক সিপিএম সমর্থকেরও।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

বোলপুর ও নানুর শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০১৬ ০২:০৬
Share:

কান্নায় ভেঙে পড়েছেন নিহতের মা। (ইনসেটে) নিহত খোকন শেখ। (নীচে)

ভোটের আগে থেকেই জমিটা তেতে ছিল। ‘উল্টো’ ফল হওয়ার পরে সেই উত্তাপের পরিধিও বেড়েছিল। আশঙ্কা সত্যি করে এ বার গ্রাম দখলের লড়াই শুরু হল নানুরে। রাত থেকে বোমাবাজি, গোলাগুলিতে আতঙ্ক ছড়াল বিধানসভা কেন্দ্রের বিভিন্ন গ্রামে। গুলিতে প্রাণ গেল এক সিপিএম সমর্থকেরও।

Advertisement

পুরনো স্মৃতি উস্কে দিয়ে ফের এলাকায় শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনে ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বাসিন্দাদের একাংশ। এ দিকে, প্রতিটি ঘটনাতেই অভিযোগের তির শাসকদল তৃণমূলের দিকে। স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য অভিযোগ মানতে চাননি।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, সোমবার সকাল ১০টা নাগাদ প্রথমে বোলপুরের নাহিনা গ্রামে সিপিএমের লোকাল কমিটির সদস্য শেখ ফজুরের বাড়িতে তৃণমূলের দুষ্কৃতীদের পনেরো জনের একটি দল ভাঙচুর ও লুঠপাট চালায়। মহিলাদেরও মারধর করা হয় বলে অভিযোগ। এর পরেই লাগোয়া সিঙ্গি গ্রামের ডাঙাপাড়াতেও হামলার অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। ঘটনার সময় মাঠ থেকে বাড়ি ফিরছিলেন পেশায় দিন মজুর খোকন শেখ (২৮)। ওই সময়েই সেই দুষ্কৃতীরা তাঁকে লাঠি ও রড় দিয়ে মারধর করে পা লক্ষ করে গুলি চালায়। ঘটনার খবর ছড়াতেই এলাকায় উত্তেজনা ছড়ায়। ডাঙাপাড়ায় তৃণমূলের এক দলীয় কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দেন ক্ষুব্ধ জনতা। দু’পক্ষের মধ্যে গুলিও চলে। গ্রামের এই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে ঘটনার এক ঘণ্টা পরেও পরিবারের লোকেরা খোকনকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারেননি। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের জেরে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েন ওই যুবক। বেলা ১২টা নাগাদ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পুলিশ এলাকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। তার পরেই খোকনকে বোলপুর মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসকেরা যদিও জানিয়ে দেন, আগেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে।

Advertisement

ঘটনা হল, বিধানসভা ভোটের কয়েক মাস আগে থেকেই এলাকা দখলকে ঘিরে সংঘর্ষে তেতে উঠেছিল নানুর কেন্দ্রের অন্তর্গত বোলপুরের বাহিরী, সিঙ্গি, নাহিনা-সহ নানুরের বিভিন্ন গ্রাম। তখন এলাকার তৃণমূল নেতা কাজল শেখের অনুগামীদের সঙ্গে তৎকালীন তৃণমূল বিধায়ক গদাধর হাজরা গোষ্ঠীর সঙ্গে দিনের পর দিন সঙ্ঘাত লেগেই থাকত। আপত্তি অগ্রাহ্য করে এ বারও গদাধরকে প্রার্থী করায় কাজল-গোষ্ঠী পরোক্ষে জোট প্রার্থী সিপিএমের শ্যামলী প্রধানের হয়ে ভোট করে বলে তৃণমূলের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর অভিযোগ। আর তার জেরেই শ্যামলীদেবীর কাছে হারতে হয় গদাধরকে। সেই আক্রোশে এ দিন গদাধর অনুগামীরা দফায় দফায় নাহিনা, সিঙ্গি, ঘিদহ প্রভৃতি গ্রামে হামলা চালায় বলে অভিযোগ। সিপিএমের পক্ষ থেকেও পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয় বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন।

এ দিন বেলা আড়াইটে নাগাদ গ্রামে গিয়ে দেখা গেল থমথমে পরিবেশ। এলাকায় টহল দিচ্ছে পুলিশ। নামানো হয়েছে র‍্যাফ। গ্রাম কার্যত পুরুষ শূন্য। আতঙ্কিত মহিলারা কেউ-ই মুখ খুলতে রাজি হচ্ছেন না। তারই মধ্যে কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সক্রিয় ভাবে যুক্ত না হলেও খোকন এলাকায় কাজলের অনুগামী হিসেবে পরিচিত। এ বারের বিধানসভা নির্বাচনে তিনি জোট প্রার্থীর সমর্থনে কাজ করেছিলেন। নিহতের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল প্রায় গোটা গ্রাম ভেঙে পড়েছে। ছেলের শোকে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন মা ছলিমা বিবি। কোনও কথাই বলতে পারছেন না। নিহতের শোকার্ত স্ত্রী আসিয়া বিবি এবং দিদি হালিমা বিবি বলেন, ‘‘আজই ওর চেন্নাই যাওয়ার কথা ছিল। আগে কাজল শেখের নেতৃত্বে তৃণমূল করলেও ভোটের সময় জোটের হয়ে ভোট করেছিল। নানুর হেরে যাওয়ার আক্রোশে তৃণমূলের লোকেরা ওকে খুন করল।’’ নিহত যুবককে দলীয় কর্মী বলে দাবি করে ঘটনার দায় তৃণমূলের ঘাড়েই চাপিয়েছেন সিপিএমের জেলা সম্পাদক মনসা হাঁসদাও। তাঁর অভিযোগ, “হেরে যাওয়ায় শাসকদল তৃণমূল সন্ত্রাস চালাচ্ছে। আমাদের কর্মীকে খুন করেছে।”

সিপিএমের দাবি উড়িয়ে নিহতকে তাঁদের কর্মী বলে দাবি করেছেন গদাধরও। তৃণমূলের সদ্য প্রাক্তন বিধায়কের দাবি, ‘‘খোকন আমার হয়ে নির্বাচনে কাজ করেছে। তার বদলা নিতে সিপিএমের হয়ে কাজল শেখ এবং তার দলবল ওকে খুন করেছে। গ্রামে আমাদের দলীয় কার্যালয় পুড়িয়েছে, একাধিক বাড়িতে ভাঙচুর ও লুঠপাট চালিয়েছে।” তাঁর দাবিকে উড়িয়ে দিয়ে যদিও রাতেই দলের বোলপুর ব্লক সভাপতি রহিম চৌধুরী, বাহিরী-পাঁচশোয়া অঞ্চল সভাপতি জহর হাজরা, সিঙ্গি অঞ্চল সভাপতি শেখ ইজরায়েল-সহ ৭০ জন তৃণমূল নেতা-কর্মীর নামে খুনের অভিযোগ দায়ের করেছে নিহতের পরিবার। রহিম চৌধুরী অবশ্য খুনের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

খুনের পরে তৃণমূলের অফিসে আগুন ধরাল জনতা। —নিজস্ব চিত্র

অন্য দিকে, গ্রাম দখলকে ঘিরেই রবিবার রাত থেকে দফায় দফায় বোমাবাজির জেরে তেতে উঠেছে নানুরের বালিগুনি গ্রামও। এ দিন সকালে ওই গ্রামের তৃণমূলের দলীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে এক ড্রাম ভর্তি তাজা বোমাও উদ্ধার হয়েছে। গ্রামের বাসিন্দা হাবিবা বিবি, আজিজুল শেখরা বলেন, ‘‘রবিবার ছিল শবে বারাতের রাত। কিন্তু মসজিদে যাওয়া দূরের কথা, বোমাবাজির জন্য কেউ বাড়ি থেকেই বেরোতে পারেনি।’’ এক সময় এই গ্রামে সিপিএমের আধিপত্য ছিল। পরে তা দখল করে তৃণমূল। বোলপুরের মতোই এখানেও কাজল-গোষ্ঠীর সঙ্গে বিরোধ বাধে বিধায়ক গদাধর হাজরার অনুগামীদের।

নির্বাচনের কয়েক মাস আগেই কাজল অনুগামী হিসেবে পরিচিত নানুর পঞ্চায়েত সমিতির এক কর্মাধ্যক্ষকে মারধর করে গ্রামছাড়া করার অভিযোগ উঠেছিল গদাধর অনুগামীদের বিরুদ্ধে। ভোটের আগে নির্বাচন কমিশনের হস্তক্ষেপে গ্রামে ফেরেন সেই কর্মাধ্যক্ষ। কিন্তু শান্তি ফেরেনি। সিপিএমের স্থানীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য আনন্দ ভট্টাচার্যের অভিযোগ, ‘‘গ্রাম দখলের লক্ষ্যেই তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা রাতভর বোমা, বন্দুক নিয়ে আমাদের কর্মী-সমর্থকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দিয়েছে। সিপিএম করলে গ্রামে থাকা যাবে না বলে ফতোয়াও জারি করেছে।’’ অভিযোগ মানেননি তৃণমূলের ব্লক সভাপতি সুব্রত ভট্টাচার্য। তাঁর দাবি, ‘‘সিপিএমই ওই গ্রামে সন্ত্রাস তৈরি করেছে। তারাই আমাদের বদনাম করতে দলীয় কার্যালয়ের সামনে বোমা রেখে পুলিশকে খবর দিয়েছে।’’

ভোট পরবর্তী সন্ত্রাসের অভিযোগ উঠেছে লাভপুরেও। স্থানীয় সিপিএম নেতা পল্টু কোঁড়ার অভিযোগ, তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা পুরাতন মহুগ্রামে রবিবার রাতে দলের এক কর্মীর খড়ের পালুই পুড়িয়ে দিয়েছে। সোমবার সকালে তাঁর বাড়িতে ভাঙচুরও চালিয়েছে। ঘটনাটিকে ‘সাজানো নাটক’ বলে দাবি করেছেন তৃণমূলের ব্লক সভাপতি তরুণ চক্রবর্তী। এ দিকে, ময়ূরেশ্বরের ঢেকায় সিপিএমের ষাটপলশা লোকাল কমিটির অফিস দখলের চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। এ ক্ষেত্রেও অভিযোগ উড়িয়েছে দিয়েছে তৃণমূল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement