সবং থানার সামনে অবস্থানে মানস। ছবি: কিংশুক আইচ
নরমে-গরমে শাসকের হুঁশিয়ারি চলছেই। ভোট মিটলে ‘ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে দেখে নেওয়া’র কথা বলছেন যুব তৃণমূল সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, আর তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে ‘কেন্দ্রীয় বাহিনী তিন দিনের অতিথি, ভয় পাবেন না’ বলে বারবার সুর চড়াচ্ছেন। বিরোধীদের অভিযোগ, এতেই আলগা হচ্ছে তৃণমূলের নিচুতলার রাশ। পরিণাম, ভোটের মুখে পরপর হামলা।
রবিবার সবংয়ের মাটিতে জোট-প্রার্থী কংগ্রেসের মানস ভুঁইয়ার প্রচার মিছিলে হামলার অভিযোগ উঠল তৃণমূলের বিরুদ্ধে। এ দিন দুপুরে সবংয়ের বিষ্ণুপুরে পদযাত্রা ছিল মানসবাবুর। কংগ্রেসের পাশাপাশি বাম কর্মীরাও পা মিলিয়েছিলেন। অভিযোগ, সেই মিছিলেই লাঠিসোটা নিয়ে হামলা চালায় তৃণমূলের লোকজন। ইট-পাটকেলও ছোড়া হয়। বাম-কংগ্রেস মিলিয়ে জনা দশেক কর্মী জখম হন। তবে মানসবাবু অক্ষত রয়েছেন। ঘটনার প্রতিবাদে বিকেলে সবং থানার সামনে অবস্থানে বসেন মানসবাবু। নির্বাচন কমিশনের অনুমতি নিয়ে মিছিল করলেও এ দিন পুলিশ পাঠানো হয়নি বলে অভিযোগ সবংয়ের জোট-প্রার্থীর। মানসবাবুর আরও অভিযোগ, ‘‘পুলিশ-তৃণমূল চক্রান্ত করে আমাকে খুন করতে চেয়েছিল। কর্মীরাই রক্ষা করেছেন।’’
বিরোধীদের দাবি, জোট জোরালো হওয়ার বার্তাই কাঁপুনি ধরিয়েছে শাসক শিবিরে। তাই নির্বাচন কমিশনে নালিশ জানানোর পরও এ দিন ফের পশ্চিম মেদিনীপুরের একাধিক সভায় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘বুক ঠুকে বলে যাচ্ছি ১৯ মে (গণনা)-র পর ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে জবাব দেব।’’ কিছুটা অন্য সুরে হলেও মমতা এ দিন পুরুলিয়ায় ফের কমিশনকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। বিরোধীদের অভিমত, খোদ দলনেত্রী ও তৃণমূলের শীর্ষ নেতাদের এ ধরনের মন্তব্যেই নিচুতলার নেতা-কর্মীরা বেপরোয়া হচ্ছেন। তাঁরা কেন্দ্রীয় বাহিনী বা প্রশাসন, কারও তোয়াক্কা করছেন না। তাই কখনও জোট প্রার্থীর দেওয়াল লিখনে গোবর লেপা হচ্ছে, কখনও প্রচারে না যাওয়ার জন্য জোট সমর্থকদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে, কখনও আবার হামলা হচ্ছে মিছিলে। ক’দিন আগেই জলপাইগুড়ির ফুলবাড়ি-ডাবগ্রাম কেন্দ্রে জোট প্রার্থীর মিছিলে বাম-কংগ্রেস কর্মীদের উত্ত্যক্ত করার চেষ্টা করেছিল তৃণমূলের বাইক বাহিনী। এ বার দক্ষিণবঙ্গেও শাসকের আক্রমণের মুখে সেই জোট।
এ দিন হুগলির শ্রীরামপুরে জোট-প্রার্থী আব্দুল মান্নানের সমর্থনে বাড়ি বাড়ি প্রচার চালানোর সময় কংগ্রেস ও সিপিএম সমর্থকদের উপর হামলার অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিংয়ে দলীয় কার্যালয় খুলতে গেলে এক সিপিএম কর্মীকে শাসক দলের লোকজন মারধর করে বলে অভিযোগ।
নদিয়ায় আবার জোট-প্রার্থীকে চা-জল খাওয়ানোর ‘অপরাধে’ এক মহিলাকে মারধর, এমনকী তাঁর বাড়িতেও ভাঙচুরের অভিযোগ উঠেছে তৃণমূল কর্মীদের বিরুদ্ধে। শনিবার দুপুরে প্রচার শেষে ক্লান্ত হয়ে রানাঘাট (উত্তর-পূর্ব) কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী বাবুসোনা সরকার হাঁসখালির কৈখালি এলাকার মজুমদার বাড়িতে জিরোতে বসেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন জনা পঞ্চাশেক সিপিএম-কংগ্রেস কর্মী। গৃহকর্তা শ্যামল মজুমদার সিপিএম কর্মী। শ্যামলবাবুর অনুপস্থিতিতে তাঁর স্ত্রী গীতাদেবী সবাইকে চা খাইয়েছিলেন। প্রার্থী এক গ্লাস জলও খান। অভিযোগ, শনিবার রাতে তাই বাড়ি ভাঙচুরের পাশাপাশি গীতাদেবীকে মারধর করে তৃণমূল কর্মীরা। শাসিয়ে যায়, ‘‘সিপিএম প্রার্থীকে জল খাওয়ানো? দেখ, কেমন লাগে।’ প্রার্থী বাবুসোনার মতে, ‘‘হেরে যাওয়ার ভয়েই এই হামলা!’’
এ দিন ঝাড়গ্রামে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর প্রচার চলাকালীনও তৃণমূলের মিছিল থেকে অধীরের নামে কটূক্তি কর হয় বলে অভিযোগ। এ নিয়ে কমিশনে নালিশ জানানোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন অধীর। সবংয়ে হামলার অভিযোগও ফ্যাক্স-বার্তায় কমিশনে জানিয়েছেন মানসবাবু। গত কয়েকদিন ধরেই সবংয়ের বিভিন্ন এলাকায় বাম নেতা-কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে প্রচার চালাচ্ছেন জোট সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী। এ দিন বিষ্ণুপুর অঞ্চলের মঙ্গরাজপুর, দুবরাজপুর-সহ কয়েকটি এলাকায় মানসবাবুর প্রচার কর্মসূচি ছিল। দুপুর দেড়টা নাগাদ মঙ্গরাজপুর থেকে মিছিল শুরু হয়। মিছিলের ফাঁকে চলছিল বাড়ি বাড়ি প্রচার। অভিযোগ, মঙ্গরাজপুরেই তৃণমূলের লোকজন মিছিলে লাঠি নিয়ে হামলা চালায়।
বাম আমলে মঙ্গলকোটে সিপিএমের হামলার মুখে পড়েছিলেন মানসবাবু। এখন পরিস্থিতি আলাদা। জোট-আবহে বাম-কংগ্রেস বন্ধু। এ দিনের ঘটনার পরে মানসবাবুকে ফোন করেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র। নির্বাচনী প্রচারে জেলাতেই ছিলেন সূর্যবাবু। মানসবাবু বলেন, ‘‘সূর্যবাবু জানান, তিনি উদ্বিগ্ন। অধীর চৌধুরীরও সঙ্গে কথা হয়েছে।’’ পরে সূর্যবাবুরও বক্তব্য, ‘‘আমার সঙ্গে মানসবাবুর কথা হয়েছে। সবংয়ে শুধু ওই মিছিলটাই নয়, এরও হামলার অভিযোগ এসেছে। আমাদের কর্মীরাও প্রতিবাদ করছেন।’’ আর অধীরের আশঙ্কা, ‘‘এমন সন্ত্রাস চললে ভোটের আগে রক্তপাত বাড়বে।’’
তৃণমূল সবংয়ে হামলার অভিযোগ উড়িয়েছে। দলের প্রার্থী নির্মল ঘোষ বলেন, ‘‘আমরা কাউকে মারিনি।’’ এ দিন বিকেলে দেবকে নিয়ে সবংয়ে সভা করতে এসেছিলেন তৃণমূল সাংসদ মুকুল রায়। তাঁর কটাক্ষ, ‘‘মানসদার নাটক করার অভ্যাস রয়েছে। উনি চাইলে দেবের থেকেও বড় অভিনেতা হতে পারতেন!’’ পশ্চিম মেদিনীপুর পুলিশ সুপার ভাদনা বরুণ চন্দ্রশেখর জানিয়েছেন, মানসবাবুর অভিযোগ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। একই সঙ্গে তাঁর দাবি, ‘‘ওখানে পুলিশ ছিল।’’ তা-ও হামলা হল কী করে? এ বার পুলিশ সুপারের জবাব, ‘‘ঠিক কী হয়েছে দেখছি।’’