এ ভাবেই দিনভর সক্রিয় রইলেন জওয়ানেরা। সল্টলেকে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
উলটপুরাণ একেই বলে!
সল্টলেকের এই এফ ডি ব্লকেই তো গত অক্টোবরে ভোট-তাণ্ডবের সামনে অন্ধ-বোবা-কালা হয়ে ছিল পুলিশ। তাদের সামনেই রাস্তায় ফেলে মারা হয়েছিল সাংবাদিক এবং চিত্র-সাংবাদিকদের। ভয়ে মানুষ বাড়ি থেকে বেরোতে পারেননি ভোট দিতে। ঠিক সেখানেই সোমবার পরতে-পরতে চমক! বিধানসভা ভোটের দুপুরে এফ ডি ব্লকের রাস্তায় পাঁচ-ছ’জন জটলা করছে। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একটি গাড়ি জোরে ব্রেক কষে দাঁড়ালো। লাফ দিয়ে নামলেন দশাশই চেহারার এক সেনা অফিসার।
‘কেয়া বাত হ্যায়? কেয়া হো রাহা হ্যায়?’ ‘স্যর, আমরা সুজিত বসু-র লোক।’ ‘কৌন সুজিত বসু?’
মুখগুলো এ বার হতভম্ব! কথা খুঁজে পাচ্ছে না। উদ্ধারকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন সল্টলেক কমিশনারেটের এক কর্তা। ‘সুজিত বসু মানে টিএমসি ক্যান্ডিডেট স্যর।’’ কড়া চোখে পুলিশ অফিসারের দিকে তাকিয়ে এ বার সেনা অফিসারের উক্তি, ‘‘আপ গাড়িমে চড় যাইয়ে। আপসে নেহি পুছা।’’
তার পর গাড়ি থেকে এক টানে ফাইবারের ছিপছিপে একটা ডাণ্ডা বার করলেন। চোখ দিয়ে সেই দিকে ইশারা করে বরফ ঠাণ্ডা গলায় সামনের জমায়েতকে বললেন, ‘‘ইয়ে দিখ রাহা হ্যায়? অব খালি হো যাও।’’ মূহূর্তে ভোজবাজির মতো ভ্যানিশ হয়ে গেল ভিড়টা!
উলটপুরাণ এটাই!
অক্টোবরে এফ ডি ব্লকেরই ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রেনিং ইনস্টিটিউট’ (এটিআই)-এর দুটো বুথে পুলিশকে বার করে দিয়ে সব দরজা বন্ধ করে আপাদমস্তক ছাপ্পা পড়েছিল। উপস্থিত সাংবাদিকদের মুখে অ্যাসিড ঢালার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। এটিআইয়ের সামনের রাস্তায় দুপুরের পর থেকে সুজিত বসুর উপস্থিতিতে তাণ্ডব চালিয়েছিল কয়েকশো গুণ্ডা। সন্ত্রাসের সেই বুথ এপ্রিলের ২৫ তারিখ ‘মডেল!’ বুথ জুড়ে সাদা-গোলাপি বেলুনের মালা, গোলাপি ফিতের ফুল। মেঝেতে লাল কার্পেট, ভোটারদের ‘কষ্ট’ লাঘব করতে সার দিয়ে টেবল ফ্যান, ঠাণ্ডা জলের ব্যবস্থা। পাশে বয়স্ক ভোটারদের বিশ্রামের জায়গা। যেখানে বসে এফ ডি ২৩৭-এর বাসিন্দা বিরাশি বছরের গীতাদেবী চৌধুরী ফোকলা দাঁতে একগাল হেসে বলে ফেলেছিলেন, ‘ইয়ে তো চমৎকার হো গ্যয়া!’ পাশে দাঁড়িয়েই তখন সপরিবার মহানন্দে ভোট-পরবর্তী সেলফি নিচ্ছে সুনীল অগ্রবালের পরিবার!
চমৎকারই বটে!
বিধানসভা ভোটের সল্টলেক ভয়ের অতীত মুছে এ দিন ভোর থেকে বিপুল ভাবে পথে নামল। তার পরে উৎসবের মেজাজে ধুন্ধুমার ভোট দিল। এই সল্টলেক সন্ত্রাস আর গরমের আশঙ্কায় আশঙ্কিত না হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভোটের লাইনে দাঁড়িয়েছে। কেউ যখন বলেছেন, ‘‘এত লাইন, রোদ, এক-আধঘণ্টা বরং বাড়ি থেকে একটু বিশ্রাম নিয়ে আসুন,’’— তখন সল্টলেকবাসীই প্রস্তাব নাকচ করে বলেছেন, ‘‘উঁহু। গত বার পারিনি। এ বার যত কষ্ট হোক, একে বারে দিয়েই যাব। কে জানে, দেরি হলে যদি আর দিতে না পারি!’’
এই উলটপুরাণের কাহিনীতে নজিরবিহীন তৎপরতায় নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ কেন্দ্রীয় বাহিনী। বিন্দুমাত্র বেগড়বাঁই শুরু হলেই কোথা থেকে যেন মাটি ফুঁড়ে উদয় হয়েছেন জওয়ানেরা। প্রথমে হুঁশিয়ারি, না শুনলেই ঘাড় ধাক্কা, তার পর মার। কথা কম, কাজ বেশি।
সল্টলেকে ঢোকা ও বেরোনোর সময় তল্লাশি হয়েছে প্রতিটি গাড়িতে। দিনের শেষে শাসক দলের এক ‘নামী ছাপ্পাকারী’ ভেঙে পড়ে বলেছেন, ‘‘কোনওরকমে সর্দারপাড়া, বারোকপাটের দুটো বুথে পঞ্চাশটার মতো ছাপ্পা দিয়ে পোলেনাইটের কাছে সবে একটু বিশ্রাম নিচ্ছি, বাহিনী হাজির হল। তাড়া করে কী মার মারল ব্যাটারা! ১৫ জন আহত। খেলা শেষ!’’ আই এ ব্লকে এক মহিলা তৃণমূল নেত্রী এবং তাঁর দলবলের বিরুদ্ধে সিপিএম কর্মী এবং ভোটারদের ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ উঠেছিল। নিমেষে হাজির কেন্দ্রীয় বাহিনী ও পুলিশ। তৃণমূল কর্মীদের একাংশ তাদের উদ্দেশে গালিগালাজ শুরু করতেই পুলিশ শুধু বলে, ‘‘রাতে বাড়ি থাকবি নাকি জেলে ভাত খাবি ঠিক করে নে।’’ ব্যাস! এক কথায় এলাকা খালি!
যে সল্টলেকে পুরভোটের দিন প্রায় প্রতিটা রাস্তায় থিকথিক করছিল বহিরাগত গুণ্ডা, সেখানে সোমবার দিনভর নিরবিচ্ছিন্ন শান্তি। এবি-এসি ব্লকের বুথে সে কথা বলতে গিয়ে হেসে ফেলছিলেন মহিলা ভোটারেরা, ‘‘সে দিন মনে হয়েছিল, এরা কারা! আর আজ মনে হচ্ছে, ওরা সব কোথায়? কোন কোটরে ঢুকেছে?’’ ভিড় থেকেই শোনা গিয়েছে, ‘‘কেন্দ্রীয় বাহিনী একশোয় একশো তবে জাভেদ শামিমও পুলিশের মুখ রাখলেন।’’
রবিবার রাত আটটা বাজতেই খবর আসা শুরু হয়েছিল। কুলিপাড়া-ইস্টার্ন মেট্রোপলিটন বাইপাস হয়ে দত্তাবাদে লোক ঢুকছে। বাসে করে লোক আনা হচ্ছে বেঙ্গল কেমিক্যালের কাছে। বেশ কিছু জায়গা থেকে বাড়ি-বাড়ি ভোটারদের হুমকি দেওয়ার অভিযোগও আসতে থাকে। এমনকী যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গণেও কয়েক হাজার লোক ঢুকে খাওয়া দাওয়া করছে এমন খবর ছড়িয়ে পড়েছে হু-হু করে। তাই নিয়ে অভিযোগও করেন বিরোধীরা।
তবে পুলিশ সূত্রের খবর, তুমুল নিরাপত্তার সামনে কোথাও খাপ খুলতে পারেনি বহিরাগতরা। শনিবার সন্ধ্যা থেকেই টানা নজরদারি, নাকাবন্দি, গাড়ি পরীক্ষা-সহ নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছিল। রাতেই দত্তাবাদে বালির মাঠ, থানের মাঠ থেকে শুরু করে সুকান্তনগর, ত্রিনাথ পল্লি, খাসমহল, কুলিপাড়ায় অভিযান চালায় পুলিশ। কিছু জায়গায় দেখা যায় অভিযোগের সারবত্তা রয়েছে। বেশ কিছু ‘বহিরাগত’ অর্থাৎ বৈধ অনুমতি ছিল না, তাঁদের বের করে দেওয়া হয়। রাত থেকে পুলিশ এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীর এমন তৎপরতা এ বারের বিধানসভার ভোটে এর আগে চোখে পড়েনি।
মহা খুশি চুনিলাল মিত্র, সুজিতা সেনগুপ্ত, বীরেন্দ্রনাথ বিশ্বাসেরা। এটিআইয়ের বুথের সত্তরোর্ধ্ব ভোটার এঁরা। গত বার হয় বাড়ি থেকে বার হতে পারেননি বা বুথ থেকে ভোট না দিয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। সোমবার তাঁদেরই পাওয়া গেল বুথের বাইরে। মেজাজে। ‘‘আজ যেটা হল সেটাই সল্টলেকের ভোট। এটাতেই আমরা অভ্যস্থ। যাঁরা এই পরিবেশকে নোংরা করতে চেয়েছিল তাদের গালে সল্টলেক চড় মেরেছে।’’
সেই জয়ের আনন্দেই এফ ডি কমিউনিটি হলের সামনে ভোটের কালি মাখানো আঙুল তুলে ‘পোজ’ দিয়েছেন ৮৮ বছরের সুনীলচন্দ্র সাহা, ৭৪ বছরের তারাপদ ঘোষ আর ৭৭-এ পা দেওয়া কুমারশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়েরা।
সাত মাসের ব্যবধানে এই হল সত্যিকারের উলটপুরাণ।