শেষ বাজি মারবে কে, ‘ভাও’ চড়ছে অন্য খেলায়

টি-টোয়েন্টি চলছে যেন। ম্যাচ এক বার এ দিকে ঝুঁকে পড়ছে তো এক বার ও দিকে। চড়চড়িয়ে উঠছে-নামছে আস্কিং রেট। মুহূর্তে বদলাচ্ছে সম্ভাব্য স্কোরের হিসেব। আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে-কমছে দর— জুয়ার!

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০১৬ ০৩:০৮
Share:

ভাও বোলিয়ে ভাও! টিএমসি কত যাচ্ছে? জোট কত?

Advertisement

টি-টোয়েন্টি চলছে যেন। ম্যাচ এক বার এ দিকে ঝুঁকে পড়ছে তো এক বার ও দিকে। চড়চড়িয়ে উঠছে-নামছে আস্কিং রেট। মুহূর্তে বদলাচ্ছে সম্ভাব্য স্কোরের হিসেব। আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে-কমছে দর— জুয়ার!

খেলাটা পুরনো। তবে ক্রিকেট নয়। এ হল ভোট-বেটিং। সেই এপ্রিলের গোড়া থেকে যা চোরাগোপ্তা চলছে কলকাতা ও তার উপকণ্ঠে। ভোট যত এগিয়েছে, শাসক ও বিরোধীদের ‘অন-ফিল্ড পারফর্ম্যান্স’ দেখে সেই মতো সম্ভাব্য আসন সংখ্যা ধরে ওঠানামা করেছে জুয়ার দর। প্রায় সমস্ত ভোট-পরবর্তী সমীক্ষা তৃণমূলকে এগিয়ে রাখার পরে যা তুঙ্গে উঠেছে। পুলিশ সূত্রের মতে, আজ, বৃহস্পতিবার ভোটের ফল ঘোষণার সকালে শুরু হবে ‘টি-টোয়েন্টি ফাইনাল’। হাতে মোবাইল, সামনে ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ততা চরমে উঠবে বেটিং চক্রের পান্ডা বা ‘বুকি’দের।

Advertisement

খাতায়-কলমে পশ্চিমবঙ্গের ‘গ্যাম্বলিং অ্যান্ড প্রাইস কম্পিটিশন অ্যাক্ট’ অনুযায়ী, যে কোনও জুয়াই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তা ছাড়া, টাকা নিয়ে গণ্ডগোলে বুকিদের মধ্যেই খুনোখুনির ইতিহাস আছে। কিন্তু যে জুয়া সেই মহাভারতের আমল থেকে চলে আসছে, তাকে রোখাও তো সহজ নয়। কলকাতা শহরে বৃষ্টি হবে কি না, তা নিয়েও জুয়া খেলা হয় বড়বাজারে। সুতরাং ভোটও যে ব্যতিক্রম হবে না, তা আর আশ্চর্য কী!

বিচিত্র পদ্ধতি। ভাষাও বিচিত্র।

এ খেলায় মূলত রাষ্ট্রভাষাই হল মাধ্যম। পুলিশের কাছে কলকাতার উপকণ্ঠের কয়েকটি বেটিং চক্রের
যে হিসেব এসেছে, তারই একদম হাতে-গরম নমুনা দিয়ে ব্যাপারটা বোঝানো যাক।

ধরা যাক, কোনও জুয়াড়ি বুকির কাছে জানতে চাইলেন, ‘ভাও কিতনা হ্যায়?’ বুকি বলবেন ‘টিএমসি ১৮০-১৭৭’। মানে ১৮০ ‘লাগায়গা’, ১৭৭ ‘খায়া’। আরও একটু পরিষ্কার করা যাক। ‘লাগায়গা’ আর ‘খায়া’ হল বেটিংয়ের দু’টি পরিভাষা। জুয়াড়ি যদি তৃণমূলের অন্তত ১৮০টি আসন পাওয়া সম্পর্কে নিশ্চিত থাকেন, তিনি বলবেন ‘১৮০ লাগায়গা’। ১৮০-র থেকে বেশি পেলেও জুয়াড়ির জয়। কিন্তু শাসক দল যদি এর কম আসন পায়, তা হলে হার। তুলনায় ‘খায়া’ খেলাটা নিরাপদ। ‘টিএমসি ১৭৭ খায়া’ বলে যদি কেউ টাকা লাগান, তার মানে তৃণমূলের আসন সংখ্যা ১৭৭-এর কম থাকলেই বাজি জেতা নিশ্চিত। এমনকী তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও জুয়াড়ি পুরো টাকা পেয়ে যাচ্ছেন। কত টাকা?

এটা নির্ভর করছে সেই সময়ে বাজির দরের ওপরে। মঙ্গলবার-বুধবার যেমন শাসক দলের দর যাচ্ছিল একশোয় একশো। মানে, কেউ ১০০ টাকার বাজি ধরে জিতলে পুরো ১০০ টাকাই পাবেন। এমন নয় যে, টাকাটা আগে থেকে জমা রাখতে হবে। গোটা ‘ধান্দা’ই চলে মুখের কথায় বিশ্বাস করে। জিতলে হাতে-গরম ১০০ টাকা পাওয়া যেমন বাঁধা, তেমন হারলেও ১০০ টাকা পত্রপাঠ মিটিয়ে দিতে হবে জুয়াড়িকে।

ঝানু বুকিরা অবশ্য বলছেন, ভোটের জুয়ার কোনও বাঁধাধরা দর নেই। এখানে তাঁরা যে হিসেব ঠিক করে দেবেন, সেটাই শেষ কথা। যেমন, যদি দেখা যায় গোড়ায় যাকে ফেভারিট মনে হচ্ছিল তার সম্ভাবনা কমছে, তখন তার দর খানিকটা নামিয়ে আনা হবে। যদি তাতে উৎসাহিত হয়ে বেশ কিছু জুয়াড়ি এই পক্ষে বাজি ধরে ফেলেন, তখন ফের দর বাড়ানো হবে। দল ধরে ধরে, এমনকী আসন ধরে ধরেও এই নিয়মেই খেলা হয়। এতে জুয়াড়ির পাঁচশো শতাংশ লাভের সম্ভাবনাও যেমন থাকে, তেমন পথে বসার উদাহরণও কম নেই।

নিশ্চিত লাভ একমাত্র বুকিদের।
এ যাত্রা বঙ্গভূমে ভোট দেখে যাঁদের মনে হয়েছে, গোড়ায় ফেভারিট হয়েই ম্যাচ শুরু করেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল। তৃণমূলের সম্ভাব্য আসন ১৭২-এর আশপাশে থাকবে ধরে নিয়েই শুরু হয়েছিল বেটিং। কিন্তু প্রথম কয়েক দফার পর নির্বাচন কমিশন কড়া হতেই রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে অবাধ ভোট দেখা যায়। তখন থেকেই জুয়ার বাজারে ভাও ঘুরতে শুরু করেছিল জোটের অনুকূলে।
গত ৩০ এপ্রিল দক্ষিণ কলকাতা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও হুগলির ভোটের পরে দেখা যায়, বুকিদের হিসেবে তৃণমূলের সম্ভাব্য আসন কমতে কমতে ১৪২-এ নেমে গিয়েছে। এর পরে তা সামান্য বেড়ে ১৫৫ হয়েছিল। ভোট-পরবর্তী সমীক্ষার পরে হিসেবটা হয়েছে ১৭৭ থেকে ১৮০। এই হিসেবেই সিপিএমের সম্ভাব্য আসন সংখ্যা এখন ৭২-৭৪টি। কংগ্রেসের ২৯-৩১টি। বিজেপির ৭-৯টি।

বুকিরা জানাচ্ছেন, আজ সকালে জেলাগুলো থেকে গণনার প্রথম যে ‘ট্রেন্ড’ আসতে শুরু করবে, তার ভিত্তিতেই ঠিক হবে নতুন দর। সব দলের সম্ভাব্য আসন সংখ্যা ধরে
ধরে তা ওঠানামা করবে দিনভর। এমনকী লোকসভার থেকে বিজেপির ভোট কমলে তা কোন পক্ষে যেতে পারে, তা নিয়েও আলাদা হিসেব হবে। পূর্ব কলকাতার এক বুকির কথায়, ‘‘ভাও আপাতত তৃণমূলের দিকে রাখা হলেও হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের চান্স কিন্তু থাকছে।’’

কী করবে পুলিশ? লালবাজার ও বিধাননগর পুলিশকর্তারা জানালেন, ভোট-জুয়া তাঁদের ভাবাচ্ছে বিলক্ষণ। এমনিতে পুলিশের খাতায় কলকাতার সল্টলেকের বিষ্ণু, পূর্ব কলকাতার আদর্শ
বা মিন্টো পার্কের চার্লিরা স্বনামধন্য বুকি। লালবাজারের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, ‘‘রাজারহাট, বাগুইআটির ডেরায় বুকিরা ভোটের ফল বেরোনোর দিন ফের জড়ো হবে বলে খবর। তবে অন্তত কয়েকটা মোবাইল বা ল্যাপটপের মতো মালমশলা হাতে না-এলে তাদের ধরা মুশকিল।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement