বাঁকুড়ার বড়জোড়ায় প্রচারে সোহম চক্রবর্তী। —নিজস্ব চিত্র।
বাইরে থেকে কোনও চাকচিক্য নেই। তিন খানা তলা আছে বটে। কিন্তু, জেলার মফস্সল এলাকার লজ যেমন সাদামাঠা হয়, ঠিক তেমনটাই।
দুর্গাপুর-বাঁকুড়া রাজ্য সড়কের ঠিক পাশে, বড়জোড়ার সারদাপল্লি সংলগ্ন সেই ‘লজ দামোদর’–এ লোকজনের আনাগোনা গত এক-দেড় মাসে হঠাৎই বেড়ে গিয়েছে। বড়জোড়া স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র শুভ দাস, অরিন্দম কর্মকাররা সারদাপল্লিতে সাইকেলে পড়তে যাওয়ার ফাঁকে মাঝে মাঝেই ওই লজে গিয়ে হাত মিলিয়ে আসছেন লজের এক বিশেষ আবাসিকের সঙ্গে। পথচলতি মানুষজনও লজের সামনে থমকে দাঁড়াচ্ছেন কিছুক্ষণ। যদি তাঁকে দেখা যায়! কিন্তু, বেশির ভাগ সময়েই অবশ্য হতাশ হতে হচ্ছে। সোহম চক্রবর্তীর দেখাই যে মিলছে না!
সোহম তখন অনেকটা দূরে, কোনও এক অজ গাঁয়ে চৈত্রের খর রোদ মুখে-মাথায় মেখে করজোড়ে বলছেন, ‘‘একবার সুযোগ দিন। পাকাপাকি ভাবে এখানেই থাকব!’’ শুনে আঁচলে মুখ টিপে সে কী হাসি গাঁয়ের বউ-মেয়েদের। সোহম এগিয়ে যান। কিন্তু, ‘‘মুনমুন সেন এমনই বলেছিল না?’’—বিশাল মিছিলে চাপা পড়ে যায় পিছনের আলোচনা।
বড়জোড়ায় টালিগঞ্জের তারকা সোহমকে প্রার্থী করেছেন তৃণমূল নেত্রী, ভোটের বাজারে এই খবরটা এখন বাসী। আসল খবর বরং, কী ভাবে তখন থেকেই বাঁকুড়ার শিল্পাঞ্চল বলে খ্যাত এই লালমাটির তল্লাট আঁকড়ে ‘আমি তোমাদেরই লোক’ প্রমাণের মরিয়া লড়াই চালাচ্ছেন এই তারকা। তাঁর তারকা-ইমেজ বিরোধীদের প্রধান হাতিয়ার ভোটের প্রচারে। বড়জোড়ার সিপিএম নেতা সুজয় চৌধুরী যেমন মোড়ে মোড়ে সভা করে প্রশ্ন তুলছেন, “তারকা সোহমকে আমি শ্রদ্ধা করি। কিন্তু ধানের দাম না পেলে কৃষকের কতটা ক্ষতি হয়, কাজ হারানো শ্রমিকদের জীবন-যন্ত্রণা কী, হাতির উপদ্রব কতটা— এই তারকা তা কি অনুভব করতে পারবেন?’’
সোহমের পিছনে তৃণমূলের সংগঠনের জোর আছে ঠিকই। কিন্তু, এ-ও ঠিক, সিপিএমের প্রচার এলাকাবাসীর মনে প্রশ্ন জাগিয়েছে। ‘ভোটে জিতে সোহমও ফুড়ুৎ হয়ে যাবেন না তো?’
টলিউডের নায়কের লড়াইটা তাই যত না বিরোধীদের সঙ্গে, তার চেয়েও বেশি বোধহয় নিজের তারকা ভাবমূর্তির সঙ্গে। তাই প্রার্থী হিসেবে তাঁর নাম ঘোষণা হওয়ার দিন দুয়েকের মধ্যেই বড়জোড়ায় এসে চষে ফেলেন এক বড় এলাকা। বড়জোড়ার বিদায়ী বিধায়ক আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে বসিয়ে তাঁকে প্রার্থী করায় দলেরই একাংশে ক্ষোভ ছিল। সোহম নিজে আশুবাবুর বাড়িতে গিয়ে তাঁর মান ভাঙালেন। কর্মিসভায় নির্দেশ দিলেন, “সবাই মিলে মিশে ভোট করুন।’’
মাস খানেক টানা বড়জোড়ায় থাকার পরে তাঁকে দেখে এলাকার তৃণমূল নেতা সুখেন বিদ, অলক মুখোপাধ্যায়, গোপাল দে-রা বলছেন, “তারকা হলেও সোহম আদপে সাধারণ। কোনও চাহিদা নেই। পোস্ত ভাত থেকে লাল চা, যা দিচ্ছি তাই খাচ্ছেন।’’ সোহমের নিজের কথায়, ‘‘আমি বড়জোড়াতেই অফিস খুলব। মানুষ সব সময়ই আমাকে পাবেন।’’
আর আছে মহাকাল। বাঁকুড়া জেলার অন্যতম হাতি-উপদ্রুত ব্লক হিসাবে চিহ্নিত বড়জোড়া। ফি-বছর বড়জোড়ায় হাতির দলের হানায় হতাহত এবং ফসল হানি বাড়ছে। ৭ মার্চ প্রার্থী হিসেবে প্রথমবার বড়জোড়ায় এসেছিলেন সোহম। সে দিনই পিংরুই গ্রামে হাতি মারে এক মহিলাকে। প্রচারে বেরিয়ে মৃতার বাড়িতে গিয়ে সোহম সান্ত্বনা দিয়েছেন মৃতার পরিবারকে। নিত্যানন্দপুর অঞ্চলের বাঁকদহ গ্রামে সন্ধ্যায় প্রচার সেরে ফেরার পথে তাঁর বুনো হাতি দর্শনও হয়ে গিয়েছে। পরে গ্রামেরই হুলাপার্টি এসে হাতি সরায়। হাতির হামলায় ক্ষতি ঘিরে যে ‘কাটমানি’ সংস্কৃতি প্রচলিত, ভোটে জিতলে দলনেত্রীকে জানিয়ে সেই ‘সিস্টেম’ তুলে দিতে চান এই তারকা।
তারকা ভাবমূর্তির সঙ্গে লোকসভা ভোটের অঙ্কও উদ্বেগে রেখেছে সোহমকে। বড়জোড়ায় তৃণমূল পেয়েছিল ৭৫,২২৯টি ভোট। প্রায় ৭৩ হাজার ভোট পেয়ে ঘাড়ে নিঃশাস ফেলছে জোট। এই অবস্থায়, বিজেপি যে ২৭,৮৯৮ ভোট পেয়েছিল, তা ভেঙে কোন ঘরে ঢোকে, তার উপরে অনেকটাই নির্ভর করছে সোহমের ভোট-ভাগ্য।
বুবুল বাজপেয়ীদের মতো এলাকার তৃণমূলকর্মীদের অবশ্য দাবি, “গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় ঢুকে সাধারণ মানুষের হাত নিজের মাথায় টেনে নিয়েছেন সোহম। নায়ক এখন আমাদের ঘরেরই ছেলে। জিততে কোনও সমস্যাই হবে না।’’ যা শুনে বড়জোড়ার জোট প্রার্থী, সিপিএমের সুজিত চক্রবর্তী তুলছেন মোক্ষম প্রশ্ন, ‘‘তারকা দিয়ে মানুষকে সব সময় ভোলানো যায় না। এই জেলার মানুষও ভুলে যাননি, দু’বছর আগে লোকসভা ভোটে তাঁরা জিতিয়েছিলেন এক তারকাকে। মুনমুন সেন কি আজও ঘরের মেয়ে হতে পেরেছেন?’’