পঞ্চায়েত ভোটের সময় এ রকম বহু দৃশ্যের সাক্ষী থেকেছে সাধারণ মানুষ। —ফাইল চিত্র।
কলকাতা লাগোয়া দক্ষিণ শহরতলির দুই বিধানসভা কেন্দ্র, বজবজ ও মহেশতলা। গত বিধানসভা এবং লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের নিরিখে দুই কেন্দ্রেই শাসক তৃণমূলের ভিত মজবুত। তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য, নাগরিক পরিষেবা নিয়ে তাঁদের অভিযোগ আছে। আর ক্ষোভ রয়েছে গত পঞ্চায়েত ও লোকসভা নির্বাচনে ভোট দিতে না পারা নিয়ে।
দশটি পঞ্চায়েত এবং দু’টি পুরসভা (পূজালি ও বজবজ) নিয়ে তৈরি হয়েছে বজবজ বিধানসভা কেন্দ্র। স্থানীয় চড়িয়াল বাজারের এক ব্যবসায়ীর বক্তব্য, ‘‘পঞ্চায়েত নির্বাচনে অধিকাংশ জায়গায় বিরোধীদের মনোনয়নই জমা দিতে দেওয়া হয়নি। অধিকাংশ এলাকায় ভোটদানেও বাধা দেওয়া হয়েছে। লোকসভা নির্বাচনে কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন গ্রামে ভোটারদের আটকে রাখা হয়েছিল। এ বার মানুষ ভোট দেবে।’’
বজবজে লড়াই মূলত তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে। ২০১৬-র বিধানসভা ভোটে এই কেন্দ্রে তৃণমূলের অশোক দেব সাত হাজারের বেশি ভোটে হারিয়েছিলেন কংগ্রেস প্রার্থীকে। কিন্তু ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের ফলের নিরিখে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে বিজেপি। পাঁচ বারের বিধায়ক অশোকবাবুর জয় এ বারও নিশ্চিত বলে মনে করছে তৃণমূল। অশোকবাবু বলেন, ‘‘এখানকার ভোটারদের মনের খবর রাখি। অধিকাংশ এলাকার মানুষের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক রয়েছে।’’
তা হলে স্থানীয় বাসিন্দারা গত পঞ্চায়েত ও লোকসভা নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি কেন? বজবজ পুরসভার বিদায়ী উপ পুরপ্রধান গৌতম দাশগুপ্তের দাবি, ‘‘এই অভিযোগ ঠিক নয়। এ বারও তৃণমূলের উপরেই মানুষ ভরসা রাখবেন।’’
বজবজের বিজেপি প্রার্থী, চিকিৎসক তরুণ আদক অবশ্য প্রচারে হাতিয়ার করছেন ভোট দিতে না-পারার সেই অভিযোগকেই। তিনি বলেন, ‘‘গত পঞ্চায়েত ও লোকসভায় অধিকাংশ মানুষ তৃণমূলের সন্ত্রাসের জেরে ভোট দিতেই পারেননি। এ বার তাঁরা ভোট দিতে পারলে শাসক দলকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। মানুষ পরিবর্তন চাইছেন। আমি ৫০ হাজার ভোটে জিতব।’’ তৃণমূল প্রার্থীর পাল্টা কটাক্ষ, ‘‘দিনেদুপুরে স্বপ্ন দেখা ভাল নয়। তরুণবাবু অভিজ্ঞ চিকিৎসক। কিন্তু ভোটটা বোঝেন না।’’
সংযুক্ত মোর্চার কংগ্রেস প্রার্থী মুজিবর রহমানও আশাবাদী। তাঁর কথায়, ‘‘রাজ্যে অশান্তির ছায়া থেকে মুক্তি চাইছেন সাধারণ মানুষ। তাই তাঁরা সংযুক্ত মোর্চার উপরেই ভরসা রাখবেন।’’
বজবজ থেকে বেরিয়ে সম্প্রীতি উড়ালপুল পেরোলেই মহেশতলা পুরসভার ২৬টি ওয়ার্ড নিয়ে মহেশতলা বিধানসভা কেন্দ্র। ২০১৬-র বিধানসভা ভোটে এই কেন্দ্রে জিতেছিলেন তৃণমূলের কস্তুরী দাস। তাঁর মৃত্যুর পরে স্বামী দুলাল দাস ২০১৮ সালে উপনির্বাচনে জয়ী হন। তিনি আবার মহেশতলা পুরসভার বিদায়ী চেয়ারম্যানও। লোকসভা ভোটের ফল ধরলে প্রায় ২৯ হাজার ভোটে এগিয়ে রয়েছেন তিনি। এই কেন্দ্রে গত বিধানসভা ভোটে দ্বিতীয় স্থানে ছিল সিপিএম। লোকসভায় দ্বিতীয় হয়েছে বিজেপি।
বাসিন্দাদের মূল অভিযোগ নিকাশি এবং পানীয় জল নিয়ে। স্থানীয় এক অটোচালকের কথায়, ‘‘‘বর্ষার পরেও মাস চারেক বিভিন্ন ওয়ার্ড জলমগ্ন থাকে। জিন্স তৈরির কারখানা থেকে বিষাক্ত রাসায়নিক জমা জলে মিশে পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর করে তোলে। তা থেকে চর্মরোগ ছড়ায়। অথচ, প্রশাসন নির্বিকার।’’ আক্রা ফটক এলাকার এক ব্যবসায়ী বললেন, ‘‘অধিকাংশ বাড়িতেই জল কিনে খেতে হয়।’’
বিজেপি প্রার্থী উমেশ দাস বললেন, ‘‘নাগরিকদের প্রতিদিনই নরক-যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। আর শাসকদলের গুন্ডাবাহিনী সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করে মানুষের মুখ বন্ধ রাখে। এ বার মানুষ ইভিএমে জবাব দেবেন।’’ তাঁর আরও অভিযোগ, ‘‘পুরসভার স্বাস্থ্যকেন্দ্রকে নিজের স্ত্রীর নামে সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে পরিণত করেছেন দুলালবাবু। সেখানে গরিবেরা চিকিৎসা করাতে পারেন না। কারণ, চিকিৎসার খরচ বেসরকারি হাসপাতালের মতোই।’’
দুলালবাবুর অবশ্য দাবি, ‘‘আমার হয়ে অভিযোগের জবাব মহেশতলাবাসীই দেবেন।’’ নিকাশির সমস্যা যে আছে, তা মেনে নিয়েও তাঁর পাল্টা অভিযোগ, ‘‘নিকাশির সমস্যা মেটাতে ৭০০-৮০০ কোটি টাকা দরকার। মানুষ জানেন, ওই টাকা আমার পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব নয়। আবেদন
সত্ত্বেও কেন্দ্র টাকা বরাদ্দ করেনি। তৃণমূল ফের সরকার গড়ে সমস্যার সমাধান করবে।’’ আর হাসপাতাল সংক্রান্ত অভিযোগের জবাবে দুলালবাবু বলেন, ‘‘একটি অত্যাধুনিক হাসপাতাল তৈরি হয়েছে। সেখানে গরিব মানুষেরও চিকিৎসা হয়। বিজেপি প্রার্থীর খবরটা জেনে নেওয়া উচিত ছিল।’’ আর সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী প্রভাত চৌধুরীর বক্তব্য, ‘‘নাগরিক সমস্যার সমাধানে কোনও দলই সক্রিয় নয়।’’
মহেশতলার ন’টি ও কলকাতার চারটি ওয়ার্ড নিয়ে তৈরি হয়েছে সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত মেটিয়াবুরুজ কেন্দ্র। খালপাড় ধরে এগোলে বস্তির অলিগলিতে সংযুক্ত মোর্চার দেওয়াল লিখন। বাকি বেশির ভাগ দেওয়ালই তৃণমূলের দখলে। বিজেপির কোনও দেওয়াল লিখন চোখে পড়ে না। স্থানীয় ওস্তাগর ও দর্জিদের বক্তব্য, ‘‘সেখানকার বাসিন্দারা বরাবরই তৃণমূলের উপরে ভরসা রেখেছেন। গত বিধানসভা এবং লোকসভা ভোটেও সেই ধারা বদলায়নি। এ বারও বদলাবে না।’’ তবে বাসিন্দাদের আর একটি অংশের বক্তব্য, এ বার সংযুক্ত মোর্চার তরফে আইএসএফ প্রার্থী অঙ্ক বদলে দিতে পারেন।
ঘিঞ্জি এলাকায় জামাকাপড়ের ছোট ছোট কারখানা। সেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা-সহ নানা সমস্যা আছে বলে অভিযোগ। তৃণমূল প্রার্থী খালেক মোল্লার নির্বাচনী এজেন্ট সব্যসাচী বসুর অবশ্য দাবি, ‘‘এখানে ভাইজানের তেমন প্রভাব নেই। সংখ্যালঘুদের ভোট তৃণমূলই পাবে।’’ আইএসএফ প্রার্থী নুরজামান মোল্লার কথায়, ‘‘মানুষ আমাদেরই সমর্থন করছেন।’’ বিজেপি প্রার্থী রামজি প্রসাদেরও দাবি, তিনি প্রচারে ভাল সাড়া পেয়েছেন। অতএব জয়ের দাবিদার তিনিও।