জয়া বচ্চনকে কি প্রচারে আনা হল মিঠুন চক্রবর্তীর ‘পাল্টা’ হিসাবে?
বাংলার রাজনীতিতে এই প্রথম ‘জয়াধ্বনি’। অর্থাৎ, জয়া বচ্চনের আগমন। সোমবার থেকে তৃণমূলের হয়ে প্রচারে নামবেন সমাজবাদী পার্টির রাজ্যসভার সাংসদ জয়া। তাঁর প্রথম প্রচারই দক্ষিণের টালিগঞ্জ কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী তথা রাজ্যের বিদায়ী মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের হয়ে। তার পরে তিনি আরও কিছু বিধানসভা কেন্দ্রেও প্রচারে যাবেন। জয়াকে প্রথমেই ‘টলিপাড়া’য় প্রচারে নামিয়ে দেওয়া ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ বলেই মনে করছেন তৃণমূলের লোকজন। রবিবার রাতেই কলকাতায় পৌঁছেছেন জয়া। আগামী তিন-চারদিন কলকাতায় থাকার কথা তাঁর।
জয়াকে প্রচারে আনতে পেরে উচ্ছ্বসিত তৃণমূল। কিন্তু পাশাপাশিই বাংলার রাজনীতিতে বচ্চন-জায়ার এই প্রথম সক্রিয় আবির্ভাব কিছু প্রশ্নেরও জন্ম দিয়ে গিয়েছে। যা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে শাসক তৃণমূল এবং বিরোধী বিজেপি— উভয় শিবিরেই। প্রথম এবং প্রধান প্রশ্ন, জয়াকে কি প্রচারে আনা হল মিঠুন চক্রবর্তীর ‘পাল্টা’ হিসাবে? ব্রিগেডে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সভায় বিজেপি-তে যোগ দিয়েছিলেন তৃণমূলের প্রাক্তন সাংসদ মিঠুন। তার পর থেকে তিনি যে শুধু রাজ্য জুড়ে বিজেপি-র হয়ে প্রচার এবং রোড-শো করছেন, তা-ই নয়, তিনি কলকাতার ভোটারও হয়েছেন। ভোটের প্রচারে তাঁকে ঘিরে উৎসাহ এবং উদ্দীপনাও চোখে পড়ার মতো। যদিও তা নির্বাচনে ভোটারদের উপর কতটা প্রভাব ফেলবে, তা এখনও বলা সম্ভব নয়। কিন্তু জয়াকে প্রচারে আনার মধ্য দিয়ে মিঠুনের প্রচারে ‘সাড়া’ পাওয়াকে কি একরকম ‘বৈধতা’ দিয়ে দেওয়া হল? ঘটনাচক্রে, সোমবারই বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেছেন, ‘‘জয়া বচ্চনের সঙ্গে বাংলার কোনও যোগাযোগই নেই। বাঙালির এই প্রজন্ম জয়াকে চেনেও না। মিঠুন’দা কিন্তু বাংলার সঙ্গে নিজেকে সবসময়েই জড়িয়ে রাখেন। এখানে ছবি করা তো বটেই, টিভি-তে রিয়্যালিটি শোয়েও নিয়মিত অংশ নেন। ফলে মিঠুন’দার সঙ্গে সঙ্গে বাংলার যোগাযোগ যতটা, জয়া বচ্চনের সঙ্গে তাঁর সিকিভাগও নেই।’’ যা শুনে তৃণমূলের নেতারা বলছেন, ‘‘দিলীপবাবু ভয় পেয়েছেন! তাই তিনি জয়া বচ্চনকে এই ভাবে আক্রমণ করছেন।’’
দ্বিতীয়ত, ‘বহিরাগত’ অস্ত্রে বিজেপি-কে লাগাতার আক্রমণ করে কেন জয়ার মতো একজন ‘বহিরাগত’-কেই প্রচারে আনার প্রয়োজন পড়ল তৃণমূলের। বিশেষত যখন জয়া বহুদিন ধরে রাজ্যসভার সাংসদ থাকলেও বাংলার রাজনীতিতে যখন তাঁকে আগে এ ভাবে কখনও দেখা যায়নি। এমনকি, বাংলায় সাম্প্রতিক অতীতে সে ভাবে তিনি কোনও পেশাগত কাজও করেননি। সে অভিনয়ই হোক বা অন্য কোনও ক্ষেত্রে। তাঁর বাস মুম্বইয়ে। রাজনাতিক কাজকর্ম সবই দেশের রাজধানীতে।
এই প্রশ্নের জবাবে তৃণমূলের নেতাদের বক্তব্য, ‘‘প্রবাসী হলেও জয়া আগাপাশতলা বাঙালি। বিবাহসূত্রে তিনি ‘বচ্চন’ হলেও আদতে ‘ভাদুড়ি’। ফলে তিনি কেন বহিরাগত হতে যাবেন!’’ তাঁদের আরও বক্তব্য, বাংলার রাজনীতিতে এর আগে সে ভাবে অংশ না নিলেও বাংলার সঙ্গে জয়ার যোগাযোগ যথেষ্ট ‘ঘনিষ্ঠ’। চলচ্চিত্র উৎসবের সময় তিনি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবেদনে বারবার সাড়া দিয়েছেন। সমাজবাদী পার্টির সাংসদ হওয়ায় তাঁর ‘বিজেপি-বিরোধিতা’ও প্রশ্নাতীত। ফলে বাংলায় মমতা তথা তৃণমূলের হয়ে তাঁর ভোটের প্রচারে আসার মধ্যে কোনও প্রশ্ন নেই।
জয়ার আগমনে তৃতীয় যে প্রশ্নটি উঠছে— তা হলে কি দেব, নুসরত জাহান বা মিমি চক্রবর্তীর মতো তৃণমূলের ‘তারকা প্রচারক’-রা সে ভাবে জনতার উপর কোনও অভিঘাত তৈরি করতে পারছেন না? নাকি তাঁরা খানিকটা ‘নির্লিপ্ত’? সেই কারণেই কি তড়িঘড়ি জয়াকে মুম্বই থেকে নিয়ে এসে কলকাতার প্রচারে নামিয়ে দেওয়া? এবং প্রচারসূচির প্রথমেই রাখা টালিগঞ্জকে? যেখানে অরূপের বিরুদ্ধে লড়ছেন বিজেপি-র ‘ওজনদার’ প্রার্থী বাবুল সুপ্রিয়। যিনি একধারে খ্যাতনামী এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী।
তৃণমূলের শীর্ষনেতৃত্বের মতে অবশ্য, ‘তারকা’ প্রচারকের কোনও অভাব তাঁদের দলে নেই। তাঁরা প্রচারও করছেন নিয়মিত। কিন্তু ‘অধিকন্তু ন দোষায়’। দেব, নুসরত এবং মিমির মতো তারকা সাংসদ তো বটেই, রয়েছেন সাংসদ শতাব্দী রায়ও। প্রতিদিনই রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় তাঁদের প্রচারসূচি থাকছে। শতাব্দীকে তো অসমের বিধানসভা ভোটেও প্রচারের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তৃণমূলের এক প্রথমসারির নেতার কথায়, ‘‘আমাদের দলে তারকা প্রচারকের কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু যদি আরও তারকা মমতা!দির হয়ে প্রচার করেত আসেন, তা হলে অসুবিধা কোথায়! যে সব প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, তার সঙ্গে বাস্তবের কোনও সম্পর্ক নেই।’’
তৃণমূলের রাজ্যসভার দলনেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন রবিবার বলেছেন, ‘‘জয়া’জি আমাদের হয়ে নির্বাচনী প্রচারে সামিল হবেন। বাংলার মানুষ কেন তাঁর মেয়েকেই চায়, তা জনসমক্ষে ব্যাখ্যা করবেন।’’ এখনও পর্যন্ত বচ্চন-জায়ার যা প্রচারসূচি, তাতে মমতার হয়ে প্রতিদিন দু’টি করে বিধানসভা কেন্দ্রে প্রচার করবেন তিনি। তৃণমূল নেতৃত্বের দাবি, জাতীয় রাজনীতিতে বিজেপি-র অন্যতম বিরোধী শক্তি সমাজবাদী পার্টির প্রতিনিধি হয়েই কলকাতায় এসেছেন জয়া। নিজের দলের অবস্থান জেনেই মমতাকে সমর্থন জানিয়ে তৃণমূলের প্রচারে অংশ নেবেন তিনি। আপাতত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত শহরেই থাকবেন তিনি। তার আগে তিন দিন রাজ্য জুড়ে ‘বাংলার মেয়ের’ হয়ে তিনি প্রচার করবেন। সোমবার বিকেলে তৃণমূল তাঁকে তৃণমূলের সংসদীয় দল সংবর্ধনা জানাবে। তার পর তৃণমূল ভবনেই সাংবাদিক বৈঠক। তার পর প্রচার শুরু।