পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার প্রাক্তন ডেপুটি স্পিকার সোনালি গুহ।
টিকিট না পেয়ে প্রকাশ্যে কেঁদেই ফেললেন পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার প্রাক্তন ডেপুটি স্পিকার সোনালি গুহ। শুক্রবার কালীঘাটের বাসভবন থেকে তৃণমূলের প্রার্থিতালিকা ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। টিভি দেখে সাতগাছিয়ার বিধায়ক সোনালি জানতে পারেন, দল তাঁকে টিকিট দেয়নি। শোনামাত্রই কান্নায় ভেঙে পড়েন সোনালি। প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ‘‘আমি বিশ্বাস করতে পারছি না দল আমাকে টিকিট দেয়নি! সবকিছু যেন দুঃস্বপ্নের মতো লাগছে। একনিষ্ঠ ভাবে দল করার হয়তো এই পুরস্কারই প্রাপ্য ছিল।’’
প্রসঙ্গত, নয়ের দশকের শুরু থেকেই সোনালি মমতার ছায়াসঙ্গিনী। ২০০১ সালে জ্যোতি বসুর ছেড়ে আসা আসন সাতগাছিয়ায় তাঁকে প্রার্থী করেন মমতা। সিপিএম নেতা গোকুল বৈরাগীকে হারিয়ে প্রথমবারের জন্য বিধায়ক হন তিনি। তারপর ২০০৬, ২০১১ এবং ২০১৬ সালে সেই আসন থেকেই বিধায়ক হন সোনালি। ২০১১ সালে সোনালি জয়ী হলে তাঁকে বিধানসভার ডেপুটি স্পিকার করা হয়। সেই সময়ে মাঝে মধ্যে অবশ্য অহেতুক বিতর্কেও জড়িয়েছেন সোনালি। একবার হাওড়ার একটি বাড়িতে গিয়ে বাসিন্দাদের নিজের সরকারি পদ ব্যবহার করে হুমকি দেওয়ার অভিযোগও উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে। তার পর ২০১৬ সালে সাতগাছিয়া থেকে জিতলেও সোনালিকে আর ডেপুটি স্পিকার বা মন্ত্রী করেননি মমতা। কিন্তু সোনালি বিশ্বাস করতেন, তিনি মমতার ‘ঘরের লোক’। ফলে টিকিট না পাওয়াটা তাঁর কাছে একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল।
অসুস্থ মন্ত্রী তথা ভাঙড়ের বিধায়ক রেজ্জাক মোল্লা যে এবার প্রার্থী হবেন না, তা জানা ছিল। তাই ভাঙড়ে আরাবুল ইসলামের অনুগামীদের ধারনা ছিল টিকিট পাবেন তিনিই। কিন্তু প্রার্থিতালিকা ঘোষণার পর দেখা যায়, ভাঙড়ে প্রার্থী হয়েছেন মহঃ রেজাউল করিম। তার পরেই নেটমাধ্যমে আরাবুল লেখেন, ‘দলের আজ আমার প্রয়োজন ফুরোল’! প্রসঙ্গত, আরাবুলকে নিয়ে বারবরই দল ভাঙড় এব লাগোয়া এলাকায় ‘বিড়ম্বনা’য় পড়েছে। তাঁকে একবার সাসপেন্ডও করা হয়েছিল। শোনা যায়, তিনি রাজ্যের এক ওজনদার মন্ত্রীর ‘স্নেহধন্য’ ছিলেন। তাই তাঁর বিরুদ্ধে কঠোরতম ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। কিন্তু এ বার ভোটের টিকিট বন্টনের সময় প্রথম সুযোগেই আরাবুলকে ছেঁটে ফেলেছেন মমতা।
টিকিট না পেয়ে ক্ষোভ ধরা পড়েছে বসিরহাট দক্ষিণের বিধায়ক প্রাক্তন ফুটবলার দীপেন্দু বিশ্বাসের নেটমাধ্যমে। ফেসবুকে ক্ষোভের সুরে তিনি লিখেছেন, ‘দীর্ঘ সাড়ে ছ’বছরের রাজনৈতিক লড়াইয়ে একবার বাদে প্রতিবার ভোটের লড়াইয়ে দলকে জিতিয়েছি। মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি সর্বক্ষণ। আমার ব্যবহারে কেউ দুঃখ পেলে ক্ষমা করবেন’। পরে ফোনে নিজের প্রতিক্রিয়ায় দীপেন্দু বলেন, ‘‘ফুটবল বা ক্রিকেটে পারফরম্যান্সই শেষ কথা। আমি এটাই জেনে এসেছি। আমি তো ফুটবলার। আমার কাছে ভাল খেলাটাই বড় কথা ছিল। এখন রাজনীতিতে এসেছি। সেখানেও পারফরম্যান্সই শেষ কথা বলে জানতাম। আমি সাধ্যমতো মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তা-ও আমাকে প্রার্থী করা হল না কেন? সেটা আমি দলের কাছেই জানতে চাই।’’
নেটমাধ্যমেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আরও এক টিকিট না-পাওয়া বিধায়ক মৈনুদ্দিন শামস। বামফ্রন্ট সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী তথা ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা কলিমুদ্দিন শামসের পুত্র মৈনুদ্দিন ২০১৬ সালে তৃণমূলের টিকিটে বীরভূমের নলহাটি থেকে বিধায়ক হন। তালিকা ঘোষণার পর নলহাটির এই সংখ্যালঘু বিধায়ক নিজের ‘সরাসরি’ অনুষ্ঠানে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন। দলের বিরুদ্ধে অভিযোগের সুরে বলেন, ‘‘তৃণমূল মুখে মুসলমান প্রীতির কথা বলে আর মুসলমানদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করে। আমাকে বাদ দিয়ে যদি কোনও সংখ্যালঘু ভাইকে প্রার্থী করা হত, তা হলে আমি বুঝতাম! কিন্তু প্রার্থী করা হয়েছে রাজেন্দ্র প্রসাদ সিংহকে। আমি তৃণমূল ছেড়ে দিলাম। আমি নলহাটি বিধানসভাতেই লড়াই করব। কোন দলের হয়ে লড়াই করব, তা আগামী দুদিনের মধ্যেই জানিয়ে দেব।’’ প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালে তৃণমূলের তালিকায় ৫৬ জন সংখ্যালঘু প্রার্থী থাকলেও এবার সেই সংখ্যা নেমে এসেছে ৪৩-এ। তবে টিকিট না পেয়ে প্রকাশ্য ক্ষোভের পাশাপাশি ক্ষোভ জানাতে নারাজ বিধায়কের উদাহরণও আছে। যেমন জোঁড়াসাকোর বিধায়ক স্মিতা বক্সী এবং কাশীপুর বেলগাছিয়ার বিধায়ক মালা সাহা। প্রাক্তন বিধায়ক সঞ্জয় বক্সীর স্ত্রী স্মিতা কোনও প্রতিক্রিয়া জানাতে চাননি। আর মালা কড়া মেজাজে বলেছেন, ‘‘নাহ্! আমার কোনও প্রতিক্রিয়া নেই!’’
একদিকে যেমন টিকিট না-পাওয়ায় ক্ষোভ, অন্যদিকে তেমনই টিকিট বন্টনে ‘পরিবারবাদ’ নিয়েও তৃণমূলের একাংশে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। যেমন, বৃদ্ধ বয়সের জন্য সিঙ্গুরে টিকিট দেওয়া হয়নি ‘সিঙ্গুরের মাস্টারমশাই’ রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যকে। সেখানে টিকিট দেওয়া হয়েছে হরিপালের বিধায়ক বেচারাম মান্নাকে। হরিপালে প্রার্থী হয়েছেন বেচারামের স্ত্রী করবী মান্না। টিকিট না পেয়ে রবীন্দ্রনাথ তৃণমূল শীর্ষনেতৃত্বের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়ে বলেছেন, ‘‘দুটো আসনেই একই পরিবারের লোককে প্রার্থী করা হল। এর থেকেই বোঝা যায়, তৃণমূল কী ভাবে চলছে!’’ প্রসঙ্গত, নদিয়ার রানাঘাট উত্তর পশ্চিমে শঙ্কর সিংহকে আবার প্রার্থী করা হয়েছে। শঙ্করের পুত্র শুভঙ্করকে চাকদহ থেকে তৃণমূল প্রার্থী করা হয়েছে। এ ছাড়াও মহেশতলার বিধায়ক দুলাল দাস ও তাঁর মেয়ে তথা বিজেপি নেতা শোভন চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী রত্না চট্টোপাধ্যায়কে বেহালা পূর্বে প্রার্থী হয়েছে।