Maldah

Bengal Polls: গুলি, কীর্তন আর গনি খানের ভোট

Advertisement

স্যমন্তক ঘোষ

মালদহ শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০২১ ১৬:৪৩
Share:

মহম্মদপুরে মুসলিম শেখের বাড়িতে। নিজস্ব চিত্র।

ধুলোমাটি লেপা দেওয়ালে ইতিহাস হয়ে জেগে আছেন বরকত গনি খান চৌধুরী। কয়েক দশক আগের ওই ভোটলিখন মলিন হয়েছে কিন্তু বিস্মৃত হয়নি।

Advertisement

গনি খান আসতেন এই অঞ্চলে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের মহব্বতপুর এখনও গনি খানের মহব্বতে।

মালদহ স্টেশন থেকে মহব্বতপুর সীমান্তে পৌঁছনো খুব সহজ কথা নয়। মহদিপুর সীমান্ত বাঁ হাতে রেখে সুজাপুর থেকে বাঁ দিক ঘুরে ঘণ্টাখানেক চলার পরে আচমকাই চোখের সামনে ভেসে ওঠে কাঁটাতারের বেড়া। বেড়া বরাবর কালো পিচের রাস্তা বিএসএফ-এর তৈরি। মিনিট দশেক সেখানে ছবি তোলার পরেই খবর হল, স্থানীয় বিএসএফ ক্যাম্পে সাংবাদিকের তলব হয়েছে। অনুমতি না নিয়ে কাঁটাতারের ছবি তোলা অপরাধ। তত ক্ষণে অবশ্য যখের ধন ক্যামেরায় ঢুকে গিয়েছে। ঠা-ঠা রোদে সীমান্তের ধার ঘেঁসে বসে থাকা কয়েক জন বিড়ি শ্রমিক যে এমন টান টান কাহিনির সন্ধান দেবেন, মিনিটকয়েক আগেও ভাবা যায়নি। ওই ভোটারদের কাছ থেকেই ধুলোমাটি লেপা বাড়ির খোঁজ মিলল।

Advertisement

কাঁটাতার থেকে পঞ্চাশ গজ দূরত্বে বাড়ির দরজা। দরজা থেকে ১০ হাত দূরে উঠোন। ডালমাশিয়ান রঙের চারটে ছোপ ছোপ ছাগল মাথায় মাথা লাগিয়ে লড়াই করছে। বাড়িতে প্রাণ বলতে ওইটুকুই। তার ঠিক বাঁ দিকে বাঁশে হেলান দিয়ে বছর সত্তরের যে ভদ্রলোক বসে, তাঁকে মৃত বললেও অত্যুক্তি হয় না। হারমোনিয়ামের রিডের মতো বেরিয়ে আছে পাঁজর। ঘোলাটে চোখে দৃষ্টি আছে, আলো নেই। ঝুলের মতো উসকোখুসকো চুলে আঙুল বোলাতে বোলাতে কথা বলতে রাজি হলেন মুসলিম শেখ। সারা দিনে কাজ বলতে ঘর থেকে দাওয়া, দাওয়া থেকে ঘর। অধিকাংশ দিন খাওয়া হয় এক বেলাই।

মুসলিম শেখের বাড়ির দেওয়ালে গনি খান চৌধুরীর নির্বাচনী প্রচার। নিজস্ব চিত্র।

গনি খান তখনও বেঁচে। মাঝরাতে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে ছেলে সদর দরজা খুলেছিল। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে গুলির শব্দ। পর পর দু'বার। সীমান্তের দিক থেকে ভেসে আসা সেই শব্দ অনুসরণ করে গ্রামের মানুষ মিনিট দশেকে যেখানে পৌঁছলেন, সেখানে নিথর শুয়ে আছে একটি দেহ। গলার কাছ থেকে রক্তের স্রোত নেমে ভাসিয়ে দিচ্ছে জমি। সার্চলাইট ঘুরে চলেছে নিজের নিয়মে। সেই রাতেই ছেলেকে নিয়ে প্রথমে গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্র, তারপর মালদহ হাসপাতালে পৌঁছে ছিলেন মুসলিম। হাসপাতালের চিকিৎসক জানান, ছেলের জান আছে, গলায় গুলিও। বাঁচানোর চেষ্টা করতে পারে একমাত্র কলকাতা। কলকাতার দু’টি হাসপাতালে ছ’মাসে পাঁচ বার অপারেশনের পর ছেলে বেঁচে গিয়েছে, তবে অথর্বের মতো। জানের দাম দিতে জমিজমা সবটুকু বেচে দিতে হয়েছিল। সেই তখন ইনসাফের আশ্বাস দিয়েছিলেন গনি খান। কিছু টাকাও।

তখন থেকেই বাড়ির দেওয়ালে গনি খানের ভোটলিখন বাঁচিয়ে রেখেছেন মুসলিম। নেতা মারা গিয়েছেন। গনি পরিবারের তৃণভূমিতে ফাটল ধরেছে। কোতুয়ালির এক দিকে কংগ্রেস অন্য দিকে তৃণমূলের গাড়ি দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সময় থমকে গিয়েছে সীমান্তের ধারে। এখনও ভোটের কথা উঠলে শুধুই গনি খানের কথা বলেন অশীতিপর মুসলিম শেখ। গনি পরবর্তী মালদহের রাজনীতি তাঁকে ইনসাফের আশ্বাসটুকুও দেয়নি। আদালতে গিয়ে সীমান্তের দু’পারে দাঁড়িয়ে থাকা কোনও উর্দিধারীর দিকেই আঙুল তুলতে পারেননি তিনি। তাঁর কাছে পৌঁছয়নি কোনও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। রাজনৈতিক ইস্তেহার।

সীমান্তে বিড়ি বাঁধছেন মহিলারা। নিজস্ব চিত্র।

পড়ন্ত বিকেলে মুসলিম শেখের বাড়ি থেকে বিক্রি হওয়ার মতো এক ঝুলি ফুটেজ নিয়ে যখন সাংবাদিক বেরোচ্ছে, গাছে গাছে তখন নামকীর্তনের সুর বাজতে শুরু করেছে। সেই শব্দেই ক্যাকোফোনির মতো মিশছে ফাটা চোঙের আজান। শব্দের ঘূর্ণিঝড়। কানে হাত দিয়ে ঘরে ঢুকে গেলেন মুসলিম। মুসলিমের স্ত্রী দরজা দিলেন। বাড়ির বাইরের ভিড় ফাটতে শুরু করেছে। সকালে আলাপ হওয়া বিড়ি বাঁধা যে মহিলা মুসলিমের বাড়ি চিনিয়ে দিয়েছিলেন, এগিয়ে এলেন তিনি, ‘‘আমাদের কথাও ছাপবে তো বাবু! ভুলে যাবা না তো!’’

সাংবাদিকের ভোলা-না ভোলায় যে তাঁদের জীবনের কোনও পরিবর্তন হবে না, সীমান্তের বউ সে খবর রাখেন না। কথা ধরিয়ে দেয়নি পেশাদার। যত ক্ষণ খবর, তত ক্ষণ অ্যাড্রিনালিন রাশ।

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত। নিজস্ব চিত্র।

মহব্বতপুর সীমান্তে প্রথম আলাপ হয়েছিল ওই ভদ্রমহিলার সঙ্গে। ক্যামেরার সামনে জড়তা নেই। কথা বলায় ভয় নেই।

গ্রামের রাস্তা যেখানে গিয়ে কাঁটাতারে ধাক্কা খায়, সেখান থেকে ডান দিকে ঘুরে সামান্য এগোলে একটি মুদিখানার দোকান। দোকানের ধারে গোলগোল কাঁটাতার বিছিয়ে রাখা। তার পাশ দিয়ে ওঠা যায় বিএসএফ-এর রাস্তায়। রাস্তার ধারে সীমান্তের বেড়া। বেড়ার গায়ে কালো দরজা। সেই দরজার ঠিক উল্টো দিকে দোকানের পিঠোপিঠি যাত্রী প্রতীক্ষালয়। কংক্রিটের সেই ঘরে গাদা গাদা তামাকপাতা। কোলে বাচ্চা নিয়ে নাগাড়ে বিড়ি বেঁধে চলেছেন একদল মহিলা। দু’একজন পুরুষও এদিক ওদিক ছড়িয়ে। সাংবাদিক দেখে চলে এসেছেন।

সীমান্তের ধারে মুদির দোকান। নিজস্ব চিত্র।

তত ক্ষণে নিজেদের কথা বলতে শুরু করে দিয়েছেন মেয়েরা— ‘‘সরকারে যে-ই আসুক, আমাদের জীবনটা যেন একটু স্বাভাবিক করে দেয়। এই যন্ত্রণা আর নিতি পারছি না গো!’’

যন্ত্রণা, কাঁটাতার। দেশভাগ যখন হয়েছিল, তখন কাল্পনিক সীমান্তরেখা কার্যত ওঁদের বাড়ির উপর দিয়ে গিয়েছিল। তাতে কোনও সমস্যা হয়নি। ভারতে থাকতে চাওয়া মানুষগুলো সীমান্ত সাজিয়ে নিয়েছিলেন নিজেদের মতো। রেশন কার্ড, ভোটার কার্ডও পেয়েছেন। মুশকিল হল কাঁটাতার লাগিয়ে। বাড়ি চলে গিয়েছে কাঁটাতারের ওপারে। বিএসএফ-এর বক্তব্য, কাঁটাতারের ওপারেও ভারতের বেশ খানিকটা জায়গা আছে। তা হলে কাঁটাতার তার পরে লাগানো হলো না কেন? এ প্রশ্নের ব্যাখ্যা তারা দিতে চায় না। অন্য দিকে বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পোস্টও স্পষ্ট দেখা যায়। আর তার মাঝখানে কার্যত নো ম্যানস ল্যান্ডে বসবাস করতে হয় এই মানুষগুলোকে। বিএসএফ কার্ড বানিয়ে দিয়েছে। সকালে, দুপুরে, বিকেলে কারখানার গেট খোলার মতো সীমান্তের কালো দরজা খোলে। ঘড়ি মিলিয়ে কার্ড দেখিয়ে ভারতের মূল ভূখণ্ডে ঢোকেন তাঁরা। শেডের তলায় বসে বিড়ি বাঁধেন। গরু চরান। বলা যায় না এমনও কিছু কাজ করেন নিশ্চয়! আবার ঘণ্টা বাজলে, গেট খুললে বাড়ি যান খেতে। আবার ফেরা, সূর্য ডোবার আগে। জাল পেরিয়ে বাড়ি ঢোকা। আশ্চর্য জীবন! বাড়িতে আত্মীয়স্বজনের যাতায়াতে নিষেধ। রাতের খাবার পরে দাওয়ায় বসে বিড়ি টানারও উপায় নেই। গেটের ওপারে বিড়ি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া যায় না। খালি হাতে পারাপারই নিয়ম।

রাতে যদি কারও শরীর খারাপ হয়? ‘‘বিএসএফ-কে খবর দিতে হয়। ওরা প্রথমে লোক পাঠায় সত্যি বলছি কি না দেখতে। তারপর গেট খোলে। তারপর যদি গাড়ি পাই, তাহলে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া যায়।'’’ কথা বলতে বলতে চোয়াল শক্ত হল মহিলার। কয়েকবছর আগে এমনই এক রাতে আট বছরের ছেলেকে কাঁটাতার পেরিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারেননি তিনি। দরজা খোলার আগেই মৃত্যু হয়েছিল ছেলের। এ গল্প যখন শুনছি, মোবাইলে সংবাদমাধ্যমের অনর্গল নোটিফিকেশন ঢুকছে। বিজেপি-র সভায় অমিত শাহ নির্বাচনী প্রচারে অনুপ্রবেশকারীদের মুণ্ডপাত করছেন। তুলনা করছেন উইপোকার সঙ্গে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অন্য এক জনসভায় ঘিরে ধরতে বলছেন কেন্দ্রীয় বাহিনীকে।

সীমান্তের গেট। নিজস্ব চিত্র।

এ শুধু মহব্বতপুরের কাহিনি নয়। মালদহ, দিনাজপুর, মুর্শিদাবাদ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিস্তীর্ণ সীমান্তে এমন অনেক গল্প ছড়িয়ে আছে। কাঁটাতার সাক্ষী রেখে ভোট দিতে যাবেন তাঁরা। ভোটের মৌতাতে উড়তে থাকবে লুকোচুরির কথকতা। কী ভাবে পাচার হয় ফেনসিডিল। সীমান্ত বাহিনীর চোখের উপর দিয়ে কী ভাবে পাচার হয়ে যায় অস্ত্র। এমনকি, মানুষও! গরু পাচারের দু'রকম পদ্ধতি। কলার ভেলায় চার পা বেঁধে জলে ভাসিয়ে দেওয়া। কানের পিছনে আলকাতরার নম্বর। অথবা বড় বড় ঢেঁকিতে কাঁটাতারের উপর দিয়ে গরু ছুড়ে দেওয়া। উল্টো দিকে শূন্যে ভাসমান গরুকে জালে ধরে নেওয়া হয়।

তবে এসবই এখন অনেক কমেছে। কাঁটাতার লাগিয়ে কমেছে। সীমান্তের কড়াকড়িতেও কমেছে। ভোটের আগে চোরাচালান প্রায় বন্ধ। মানছেন গ্রামবাসীরা। বলছেন নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক বিএসএফের আধিকারিকরাও। বিএসএফের আরও দাবি, কাঁটাতারের অন্য পারে যে ভারতীয়রা থাকেন, তাঁদের কোনও রকম সমস্যায় পড়তে হয় না। উর্দিধারীরা সবরকম সাহায্য করেন। চেনা ন্যারেটিভ।

সারা দিনের কাজের মাঝে স্থানীয় বিএসএফ ক্যাম্পে বসতে হয়েছিল প্রায় দু’ঘণ্টা। অনুমতির সরকারি সিলমোহরের অপেক্ষায়। ন্যারেটিভ, বর্ডার ডিসকোর্সের গল্পগুলো শামিয়ানার তলায় চায়ের সঙ্গে দিব্য লাগছিল।

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাঁটাতার। নিজস্ব চিত্র।

পড়ন্ত বিকেলে গাড়ির এয়ার কন্ডিশনার পুরো দমে চালিয়ে শহুরে স্বস্তির দম নিল সাংবাদিক। ফাটা চোঙের কীর্তনের দাপট বন্ধ কাচ ভেদ করে অস্বস্তি বাড়াচ্ছে। গরমও। প্রায় দু’ঘণ্টার ফিরতি পথে রাস্তার দু’ধারে, গ্রামের পথে অন্তত গোটা তিরিশ বড় বড় কীর্তনের ফটক দেখা গিয়েছে। শহরে, শহরতলিতে এমনই দেখতে হয় জনসভার গেট! সঙ্গে ‘ওম’ লেখা বড় বড় গেরুয়া তিনকোণা পতাকার চেন। জমিন-আসমানের মাঝে কাঁটাতারের মতো দেখতে লাগছে চেনগুলো।

স্থানীয় সোর্স চৌরাস্তার মোড় পর্যন্ত ছাড়তে এসেছিলেন। গাড়ি থেকে নামার মুহূর্তে প্রয়োজনের চেয়ে গলা সামান্য চড়িয়েই বললেন, ‘‘এভাবেই বাড়ছে গেরুয়া হাওয়া। ভোটের খবর করতে এসেছিলেন না! এই অঞ্চলেও বিজেপি প্রচুর ভোট পাবে। শুধু হিন্দু নয়, মুসলিম ভোটও যাবে গেরুয়া শিবিরে। বর্ডারে থাকার কী জ্বালা, একদিনে বুঝতে পারবেন না।’’ খানিক বিস্ময়ের সঙ্গেই তাকিয়ে রইলাম তাঁর দিকে। গোটা রাস্তায় ঘাসফুলের দেওয়াল যা দেখেছি, তার সামনে পদ্ম প্রতিযোগিতাতেও আসে না। তবে কি কীর্তনই রাজনীতি? এর উত্তর পাওয়া যাবে পরে।

ফিরতি পথে ক্লান্ত চোখ প্রতিটি দেওয়ালেই গনি খানের নাম পড়ছিল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement