রাজু নস্কর
আদর্শ— পরেশ পাল।
তিনি বেলেঘাটার ‘অনুব্রত মণ্ডল’। নিজেও সদর্পে তেমনটাই বলেন।
চেহারায় মিল, গোটা চারেক মোবাইলে এলাকা জুড়ে নিয়ন্ত্রণ রাখাতেও। ‘গুড়-জল’ খাওয়ানো বা ‘চড়াম চড়াম’ ঢাক বাজানোর মতো শব্দ-প্রয়োগে নেই বটে। তবে কাকে কোন কথায় কাজ করানো যাবে, ভাষার উপরে সে দখল তাঁর রয়েছে। এলাকায় নির্মাণ ব্যবসা-সহ ‘ছেলে পোষার’ দায়িত্ব তাঁর উপরেই ন্যস্ত। এমনকী, ভোটের দিন এলাকার বাইরে অন্যত্র দলের জন্য ‘ডিউটি’ও করতে হয় তাঁকে।
পুলিশের খাতায় বোমাবাজি, তোলাবাজি, খুনের চেষ্টা-সহ একাধিক মামলায় ‘তিনি’ আছেন। ভয় দেখানো, শাসানির অভিযোগ তো রয়েছেই। গত বিধাননগর পুরসভার নির্বাচনেও সদলবল দেখা গিয়েছিল তাঁকে। পুলিশ অবশ্য তাঁকে ধরে না। কেন? জানতে চাইলেই জবাব আসে, ‘‘ওকে তো এলাকাতেই দেখা যাচ্ছে না। এলেই দেখা হবে।’’ আর থানা থেকে বেরিয়ে ইস্ট কুলিয়া রোডে শীতলা মন্দিরের পাশের বাড়িতে গিয়ে শোনা যায়, ‘এই তো ছিল। বেরিয়ে গেল এখনই।’
বেলেঘাটার ‘অনুব্রত’ রাজু নস্করের ‘ধর্মগুরু’ অবশ্য ট্যাংরা-বেলেঘাটার তৃণমূল কাউন্সিলর জীবন সাহা। গত লোকসভা নির্বাচনে পরেশ পালের ‘ঘোর শত্রু’ সেই রাজু বছরখানেক হল পরেশেরই ছত্রচ্ছায়ায়। এ বার নির্বাচনে পরেশ পালের হয়ে একাধিক মঞ্চেও তাঁকে দেখা গিয়েছে বলে জানাচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারাই। আর জীবন সাহার দাবি, ‘‘আমি ওঁকে চিনি। তবে অনেকেই তো তৃণমূল করে। যে কেউ বলতে পারে আমি ওর লোক, তার লোক।’’
বেলেঘাটার পুরনো খেলোয়াড় রাজুর ব্যাট হাতে ম্যাচে নামা সেই বাম আমলেই। দাদাদের হাত ধরেই পেশিশক্তির প্রয়োগ। ট্যাংরার একটি খুনের মামলাতেও নাম জড়ায় তখনই। পরিবর্তনের পরে দল বদলেছেন। বিরোধীদের জব্দ করার মূলমন্ত্র যাঁদের কাছ থেকে রপ্ত করেছিলেন, এখন সেই মন্ত্রে ঘায়েল করছেন তাঁদেরই। সিপিএমের কাছে ব্যুমেরাং হয়ে ফিরছেন রাজু নস্কর। এলাকার বাসিন্দারা জানান, বাম আমলেই বেলেঘাটার এক সিপিএম নেতার হাত ধরে দলীয় রাজনীতিতে প্রবেশ রাজুর। তার পরে প্রভাব খাটিয়ে নির্মাণ ব্যবসা। সেই ব্যবসাই এখন সিন্ডিকেট। গত বিধানসভা নির্বাচনের পরেই পরিবর্তনের স্রোতে গা ভাসিয়ে সোজা ঢুকে পড়েন তৃণমূলের শিবিরে। ওই এলাকায় তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের সুযোগে ঘাঁটি গেড়েছিলেন পরেশ-বিরোধী গোষ্ঠীতে। তার পরে গোষ্ঠী বদল।
এলাকায় কোনও বাড়ি খালি করতে হবে? ‘রাজুদা’ ভরসা। ইট-বালি-সিমেন্ট সরবরাহ? ডাক পড়ে তাঁর দলবলের। রাজুদার অধীনে বহু ছেলে। সালকিয়া থেকে খিদিরপুর, সল্টলেক থেকে বেহালা— বাঙাল, শান্তি, রাজু সেনের মতো এলাকার পরিচিত নামেরা সকলেই রাজু নস্করের লোক বলে অভিযোগ। কয়েকশো ছেলে ইট-বালি সরবরাহ করে। বড় প্রোজেক্টের কাজ এলে অন্য কোনও নির্মাণ ব্যবসায়ীকে কাছে ঘেঁষতে দেন না ‘দাদা’।
বেলেঘাটার মিয়াবাগান, কে জি বসু সরণি, কবি সুকান্ত সরণিতে কান পাতলেই শোনা যায়, এলাকায় যে কোনও কাজ করতে গেলে খুশি করতে হবে রাজুদাকে। কারণ, দাদার মাথায় হাত রয়েছে তৃণমূলের হেভিওয়েট নেতার। তাঁর জোরেই একে একে তাঁর প্রতিদ্বন্দী নির্মাণ ব্যবসায়ীদের কার্যত এলাকা ছাড়া করেন রাজু। মাঠ ফাঁকা করার খেলার কৌশলে পটু বাম আমলের ওই ‘প্রোজেক্ট’ই এখন তৃণমূলের ‘রত্ন’। যে কারণে ভোটের কাজে পুরোদমে নেমে পড়েন বেলেঘাটার ‘অনুব্রত’।
২০১৪ সালে চৌরঙ্গি কেন্দ্রের উপনির্বাচনে বেলেঘাটায় বিরোধীদের এক তরুণীকে রাস্তা ফেলে মারধরের অভিযোগ উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে। বিধাননগর পুরসভায় সাংবাদিকদের লক্ষ করে ইট ছুড়তেও দেখা গিয়েছিল তাকে। সেই তিনিই এ বারও বেলেঘাটার ভোটের কাণ্ডারী। ‘দাদা’র দাপটে সাধারণ মানুষও ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকেন।
রাজুদা নিজে কিন্তু ‘কুল’। ফোনে বললেন, ‘‘আমি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সামনে রেখে পরেশ পালের আদর্শে শুধু রাজনীতিটা করি। অন্য কোনও কাজের সঙ্গে যুক্ত নই। বাকি থাকা নির্মাণগুলো শুধু করছি। আর মোবিলের ডিলারশিপ রয়েছে। আমার বিরুদ্ধে কুৎসা করা হচ্ছে। আমি কোনও সমাজবিরোধী বা তোলাবাজ নই।’’
দল বদলালেন কেন? জবাব আসে, ‘‘খুনের অভিযোগে সিপিএম আমাকে ফাঁসিয়েছিল। বেকসুর খালাস পেয়েছি। আমি কোনও ঝামেলায় জড়িত নই।’’
তারই ফাঁকে মঙ্গলবার এক সিপিএম কর্মীর বাড়িতে চড়াও হওয়ার অভিযোগ ওঠে। এমনকী মিডিয়া ডাকলে ফের বিপদ আসতে পারে বলে আক্রান্তের পরিবারকে হুমকিও দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ। ভয়ে আদৌ ভোট দিতে পারবেন কি না, তা নিয়েই এখন সংশয়ে তাঁরা।