জ্বলেনি আলো অন্ধকারে, হতাশ ছিটমহল

বিকেল গড়িয়ে পশ্চিমদিকে হেলে পড়েছে সূর্যটা। তিন কিলোমিটার যেতে যেতে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। অন্ধকার সাবেক ছিটমহলে। পুকুরের পাড় ঘেঁষে মাটির রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতেও ভয় হচ্ছে। ভয় অন্য কিছুর নয়, পুকুরে পড়ে যাওয়ার।

Advertisement

নমিতেশ ঘোষ

শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০১৬ ১৬:১৭
Share:

গরমে হাঁসফাঁস করতে করতে ছোট ছোট টিনের ঘরে এ ভাবেই থাকতে হয় ছিটমহল বাসিন্দাদের।

বিকেল গড়িয়ে পশ্চিমদিকে হেলে পড়েছে সূর্যটা। তিন কিলোমিটার যেতে যেতে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। অন্ধকার সাবেক ছিটমহলে। পুকুরের পাড় ঘেঁষে মাটির রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতেও ভয় হচ্ছে। ভয় অন্য কিছুর নয়, পুকুরে পড়ে যাওয়ার। সাবেক ছিটমহলের ভিতরে যখন ঢুকলাম, তখন কুপির আলো ফুটে উঠছে এক একটি বাড়ি থেকে। সেই আবছা আলোতেই ছোট ছোট শিশুরা বই নিয়ে বসেছে। গৃহবধূরা রান্না ঘরে সব্জি কাটছেন। এক জন বৃদ্ধ রেডিও হাতে। খবর শুনছেন। হাওড়া, ২৪ পরগনায় কী হল?

Advertisement

ছিটমহলে যাওয়া আমার নতুন নয়। কখনও মশালডাঙা, কখনও পোয়াতুর কুঠি, কখনও বা শিবপ্রসাদ মুস্তাফি, করলা, বাত্রীগছ থেকে শুরু করে বালাপুখুরি। বার বার শুনেছি তাঁদের কষ্টের কথা। দেখেছি জীবনযাপনের দৃশ্য। দেশে থেকেও তাঁদের দেশ ছিল না। গত ৩১ জুলাই রাত ১২টা, ছিটমহল যখন মুক্ত হল তখন মশালডাঙায় উৎসবের মেজাজ। গান-বাজনা, আবির, আতসবাজিতে মুক্তির গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল চার দিকে। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল আসমা বিবির। সেই ছোট্ট ছেলেটা জেহাদ হোসেন ওবামা মায়ের চোখের জল মুছে দিচ্ছিল বার বার।

নয় মাস পরে সেই কষ্টের দৃশ্য তেমন পাল্টায়নি। আমাকে থামাল জয়নাল। জয়নাল আবেদিন। কত বয়স হবে ওঁর? বড়জোর পঁচিশ পেরিয়েছে। এই কষ্টের মধ্যেও নানা কৌশলে পড়াশোনা করেছে সে। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে গিয়েছে। কলেজে পড়াশোনা করছে। আমি যখনই এখানে এসেছি, দেখা হয়েছে জয়নালের সঙ্গে। যত ক্ষণ থেকেছি, সঙ্গে সঙ্গে থেকেছে। বলল, “দাদা তুমি রাতে এসেছ কেন? এখন তো অন্ধকার।” আবার জয়নাল বলল, “তুমি এর আগে যখন রাতে এসেছিলে তখন জেনারেটর ছিল। ওই আমাদের স্বাধীনতার দিন। সে দিন তো চারদিকে আলো জ্বলে ওঠেছিল।” থেমে গেল জয়নাল। কি যেন ভাবতে লাগল। আমি বললাম, “থেমে গেলি কেন?” বলল, “জান দাদা, আলোটা যেন একদিন জ্বলেই নিভে গেল।”

Advertisement

বললাম, “অন্ধকারে তোরা কতটা অসুবিধেয় থাকিস তা দেখতেই এলাম।” জয়নাল বলল, “এই অন্ধকার তো কেটে যায়। সূর্য উঠলেই। আমাদের জীবনের অন্ধকার তো কাটে না।” এগিয়ে চললাম তার সঙ্গে। বসন্ত শেষ হয়ে গ্রীষ্ম পড়েছে। বৈশাখে এক-দু’দিন বৃষ্টিও হয়েছে। মশালডাঙার এই রাস্তায় একটু জলও হয়েছিল। ফের যে প্রখর দাবদাহ শুরু হয়েছে তাতে সে সব শুকিয়ে গিয়েছে। অন্ধকারে সাপের ভয় রয়েছে। গাছগাছালি, ঝোপজঙ্গল ঘেরা রাস্তা। জয়নালের হাতে একটি ছোট টর্চ ছিল। তা দিয়েই পথ দেখতে লাগলাম।

জয়নালের দাদু আজগর আলি। এই সাবেক ছিটমহলের সব থেকে পুরনো বাসিন্দা। বয়স একশো পেরিয়ে গিয়েছে। কেউ ওই গ্রামে গেলে এক বার তাঁর সঙ্গে দেখা করবেই। আসলে ওই এত দিনকার পুরনো মানুষটাকে এক বার দেখলে যেন একটি শতাব্দী ছোঁয়া যায়। দিন কয়েক হল ভোটার কার্ড (এপিক কার্ড) হাতে পেয়েছেন তিনি। আধভাঙা একটি রেডিও ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শুনছেন। এখনও। আর ভোটার কার্ডটা নেড়েচেড়ে দেখছেন। এই প্রথম বার ভোট দেবেন। ছেলে, নাতির সঙ্গে। মনে মনে একটা আনন্দ আছে। আছে একরাশ বেদনাও।

বললেন, “কত বছরের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছি। এটা অস্বীকার করব না। এখন তো অন্ততপক্ষে এই দেশের মানুষ আমরা।” কিন্তু তার পর? থেমে গেলেন। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, “এই নয় মাসে তো অনেক কিছুই করা যেত। অন্ততপক্ষে জমির কাগজটা তো দেওয়াই যেত।” ওই জমি নিয়েই একটা হতাশার মধ্যে দিন কাটছে ছিটমহলের বাসিন্দাদের। ভেবেছিলেন, বিনিময় হতেই নিজেদের নিজেদের জমির অধিকার পাবেন তাঁরা। পাবেন কাগজপত্র। পাননি। এখনও সে ব্যাপারে কোনও ব্যবস্থাই নেওয়া হচ্ছে না বলে আফশোস করেন তাঁরা। আশঙ্কায় থাকেন, জমি যদি কখনও হাতছাড়া হয়ে যায়। কেন? জয়নাল বলেন, “হতেই পারে। এখনও তো জমির অধিকার পাইনি।”

জয়নালকে থামিয়ে আজগর আলি বলেন, “আচ্ছা বলতে পারেন কি হল এই কয়েক মাসে?” ঠিকই তো বলেছেন তিনি। বিনিময় হওয়ার আগে অনেক প্রতিশ্রুতি তো দিয়েছিল সরকার। অনেক টাকার কথা। কে বলেননি? মুখ্যমন্ত্রী থেকে প্রধানমন্ত্রী। তা হলে এখনও গ্রামে বিদ্যুৎ নেই কেন? পানীয় জল, রাস্তা, সরকারি প্রকল্পে উন্নয়ন, বেকারদের কাজ, কোথায় কী হচ্ছে? তাঁদের জন্য কোটি কোটি টাকা খরচের গল্প শোনানো হয়েছিল বার বার। কোথায় সে সব? জয়নালের সঙ্গেই ঘুরে বেড়াতে লাগলাম গোটা গ্রাম। চার দিক থেকেই সে সব প্রশ্ন ঘিরে ধরেছিলে আমাকে।

শিবপ্রসাদ মুস্তাফি ছিটমহলেও একই প্রশ্ন। ক্ষোভ। সেই ক্ষোভ যেন ছড়িয়ে পড়েছে সাবেক ছিটমহলের ত্রাণশিবিরেও। দিনহাটার কৃষিমেলা বাজার থেকে শুরু করে মেখলিগঞ্জ, হলদিবাড়ি। সেই একই ভাবে দিন কাটছে তাঁদের। টিনের বাড়িতে গরমে হাঁসফাঁস। কৃষিমেলা বাজারের ত্রাণশিবিরের কয়েক জন বাসিন্দা বললেন, “এই গরমে তো পিঠ পুড়ে যায়। ঘুমোই কী করে। সরকার তো কত কথা শোনাল। সে সবের কী হল?”

এই বিধানসভা ভোটে অবশ্য ছিটমহলের পাশে দাঁড়ানোর লোকের অভাব নেই। শাসক দলের নেতা-প্রার্থী থেকে জোট, সবাই কয়েক দফায় সেখানে গিয়েছেন। অনেকে কথাও দিয়েছেন। ক’জন কথা রাখবেন কে জানে!

ছবি: হিমাংশু রঞ্জন দেব।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement