আবার ভোট। এ বার ভোট। অনেকটা সময় ধরে; প্রলম্বিত। এই পর্যন্ত অনেকটাই চেনা। কিন্তু তার পর। অচেনা জমি। তৃণমূল নেত্রী অবশ্য বলছেন একই কথা। ভোট পাখিদের আনাগোনা! কিন্তু, সত্যিই কি তাই? পশ্চিমবঙ্গের চিরাচরিত ছবিটাই তো গরহাজির। কোথায় সেই তীব্র মেরুকরণ? রাজনীতি চেতনার সেই বিভাজনের স্পষ্ট রেখাচিত্র? পূর্ব নির্ধারিত, পূর্ব নির্দিষ্ট মতাদর্শের শাণিত সংঘাত ? আর তাই এই অচেনা ছবি। জোট। মানুষের জোট। না রাজনীতিহীন নয়; রাজনীতি বিবর্জিত তো নয়-ই। কিন্তু, শুধুই কতগুলো রাজনৈতিক দলের নেতাদের পারস্পরিক আলাপ আলোচনার, আদানপ্রদানের পরিণতি-ই নয়। শরীরী চেহারা তো নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু ওটা গৌন। আসল মানুষের চাহিদাকে ‘আপন বেগে বইতে’ দেওয়া স্বচ্ছন্দে, বাধাহীন। রাজনৈতিক দলনেতা নয়। মানুষই এই জোটের ধাত্রী— অভিভাবক। যাঁরা মানুষের চেতনা, উপলব্ধির এই স্রোতের গতি আর অভিমুখকে অনুভব করতে পারবেন না, তাঁদের পক্ষে এই অজানা সমীকরণের গণিতটা মেলানো মুশকিল।
কে দায়ী এই অচেনা ছবিটি সৃষ্টি করবার জন্য? জনচেতনার এই স্বতঃস্ফূর্ত বিস্ফোরণের জন্য? অবশ্য-ই সরকার। তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে চলা সরকার। গণচাহিদা, গণদাবির সঙ্গে নির্বাচিত সরকারের মতপার্থক্য গণতন্ত্রের একটি মূল বৈশিষ্ট্য। আর এই মতপার্থক্যই যখন সংঘাতের চেহারা নেয়, তখনই একটি নির্বাচিত সরকার বাধ্য হয় তার দায়বদ্ধতা স্বীকার করতে, কার্যকরী করতে। এটাই গণতন্ত্র। অন্যায় হলে আইনের শাসনকে নির্বিঘ্ন করতে। রাজনৈতিক বিরোধে তৃতীয় পক্ষীয় নিউট্রাল আম্প্যায়ারকে বিরোধের নিষ্পত্তি করতে দিতেই হয়। অন্যথা মানুষের বিচারহীনতা গুমরে গুমরে অবাধ্যতার নিশান তোলে, আর সমব্যথীদের সঙ্গে মিলে জোট বাধে। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কৃষি-শিল্প-কর্মসংস্থান-সামাজিক ন্যায়-মেয়েদের অধিকার স্বাধীনতা; সব কিছুর মধ্যেই গত পাঁচ বছরে এই ঘটনাটাই ঘটেছে। গণতন্ত্র নেই, আইনের শাসন অন্তর্হিত। তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে ২০১১ সালের নির্বাচনের সময় ছিল ২২টি ছোট বড় রাজনৈতিক দল। পরিবর্তন। অবশ্যই আরও উন্নত গণতন্ত্রের জন্য আর্তি। কিন্তু, এই পাঁচ বছর এনেছে নিরঙ্কুশ আধিপত্য। আমিই শাসন, আমিই আইন। নিরঙ্কুশ গণতন্ত্রহীনতা সামনে এনেছে সমস্ত ধরনের বদ রক্ত। দুর্নীতি, স্বজনপোষন, হিংসা, রক্তপাত। বিরোধীরা তো বটেই, শাসক দলের ভাগ্যহীনদেরও জুটেছে অত্যাচার।
গত দু’বছরে বাড়তি প্রাপ্তি। কেন্দ্রীয় সরকার। বিজেপির নেতৃত্বে মোদী সরকার। ‘সুদিন’ আসবে। জিনিসপত্রের দাম কমবে, কর্মসংস্থান হবে, শিল্প-কৃষিতে দেশ এগোবে। আর সবচেয়ে বড় কথা, দুর্নীতি নির্মূল হবে। কালো টাকা ঘরমুখো হবে, সবার ব্যাঙ্কের খাতায় জমা পড়বে। ‘না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা’। কিন্তু কোথায় কী? সারদা মালিককে বেচা দিদির ছবির দাম বিশ বাঁও জলে! সিবিআই ভাগলবা! কারণ দিল্লিতে দিদি বি-টিম— আর কলকাতায় মোদীও তথৈবচ! রাজ্যসভায় বিল পাশ করাতে গেলে সিবিআই কোনও রাঘববোয়ালের কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারবে না। ‘খাঁচার তোতা’ খাঁচাতেই বন্দি থাকবে! আর এর সঙ্গেই ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ নির্মাণের উন্মত্ত অভিযান। যাঁরা হিন্দু রাষ্ট্রের সঙ্গে, তাঁরা দেশপ্রেমিক— আর যাঁরা বিরুদ্ধে, তাঁরা বিশ্বাসঘাতক, দেশবিরোধী। মেরুকরণের তীব্র আবহ। সংখ্যালঘুদের মধ্যে অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতা। আর সাম্প্রদায়িকতার আবেদন। দিদির রাজত্বও হিন্দুত্বের রাজনীতির সঙ্গে দ্বৈত সঙ্গীত; ঠিক যেন বাঁয়া তবলার যৌথ মূর্চ্ছনা। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে এই ছায়াযুদ্ধ— এই যৌথ সঙ্গত কাজে দিয়েছিল। মেরুকরণ। আর দেশের সরকার পরিবর্তনের আবহে মোদীর উত্থানের ডানায় ভর করে বিজেপির অভূতপূর্ব অগ্রগতি। ফসল উঠল তৃণমুলের ঘরে। তাই আবারও। দু’বছর যুদ্ধবিরতির পর চেনা ছক। কিন্তু দু’বছরে হুগলি দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গিয়েছে।
কাজেই চেনা ছক অজানা জমিতে আর কাজ করছে না। ‘মদন ভাগ’, ‘মুকুল ভাগ’, ‘মমতা ভাগ’ স্লোগানের ধার, দু’বছরের ব্যবধানে চিঁড়ে ভেজাতে পারছে না! বিরোধী নেতা মোদীর বাগাড়ম্বর দু’বছর প্রধানমন্ত্রিত্বের ভারে ঠাট্টার মতো শোনাচ্ছে। ফলে টিভি শো’র তর্জন-গর্জন, আর মোদীর সারদা-নারদ-ফ্লাই ওভার-সিন্ডিকেট নিয়ে চোখা-চোখা শব্দবন্ধের কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা থাকছে না। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি দ্বিতীয় বার প্রহসন হিসাবেই ঘটে!
আর তাই অপ্রতিরোধ্য জোট, মানুষের জোট। রাজনীতির ভিত্তিটাও স্পষ্ট। গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা।আইনের শাসন ফিরিয়ে আনা। আর রক্ষা করা সম্প্রীতি, ঐক্য। জীবন–জীবিকা, অর্থনৈতিক–সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রশ্নগুলি নিশ্চয়ই রয়েছে; কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই মানুষের জোটের অনুঘটক। অচেনা এই ভোটের মরসুম তাই এখন দ্রোহকাল। অঙ্কটাও তাই সমাধান হবে রসায়নে, পাটিগণিতে নয়। মানুষের পদচারণায় কর্ষিত বাংলার এই হিংসা-রক্তসিঞ্চিত ভূমিতে পরিবর্তনের ঝড়ের পূর্বাভাস। সেটিং বিশেষ কাজে আসবে না!