নরেন্দ্র মোদী। ছবি: এক্স থেকে নেওয়া।
প্রচারের শেষে ধ্যানে বসেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। গোটা দেশ উত্তাল তাঁর কন্যাকুমারীর বিবেকানন্দ শিলায় টানা ৪৮ ঘন্টা ধ্যানমগ্ন থাকা নিয়ে। কিন্তু কেন কন্যাকুমারী? সে প্রশ্নেরও জবাব খুঁজছে দেশ।
ঘটনাচক্রে, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগেও তিনি ধ্যানে বসেছেন। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রচার শেষে তিনি (তখনও মোদী প্রধানমন্ত্রী হননি) গিয়েছিলেন মহারাষ্ট্রের প্রতাপগড়ে। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে ২০১৯ সালে প্রচারের শেষে গিয়েছিলেন উত্তরাখণ্ডের কেদারনাথে। পশ্চিম এবং উত্তর ভারতের পরে এ বার দাক্ষিণাত্য। কেন?
অনেকে বলছেন, ‘রাজনীতিক’ মোদী ভোটের অঙ্ক মেলাতে কন্যাকুমারী বেছেছেন ঠিকই। কিন্তু এর সঙ্গে তাঁর পূর্বাশ্রমের স্মৃতিও রয়েছে।
সরল রাজনৈতিক বিশ্লেষণ বলছে, এ বার ভোটপ্রচারে মোদী দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। কারণ, এখনও পর্যন্ত ভারতের অন্যত্র যে ভাবে পদ্ম ফুটেছে, দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে তা হয়নি। মোদী প্রচারে এমনও দাবি করেছেন যে, এ বার দক্ষিণের ‘মন’ বদলেছে। বিজেপির আসন এবং ভোট বাড়বে বলেও আশা প্রকাশ করেছেন। ফলে ভোটের ভাবনা তাঁর প্রচার-পরবর্তী ধ্যানের স্থান নির্বাচনে যে কাজ করেছে, তা সরল জবাব। কিন্তু এর বাইরেও একটা লক্ষ্য রয়েছে। সেই লক্ষ্যের নাম ‘একনাথ রানাডে’।
কে এই একনাথ রানাডে? যাঁর জন্মশতবর্ষে মোদী জানিয়েছিলেন, তাঁর কাছে ‘বড় প্রেরণা’ একনাথের জীবন। বলেছিলেন, ‘‘আমি ওঁর থেকে অনেক কিছুই শিখেছি। একনাথজির সঙ্গে জীবনের অনেক মূল্যবান সময় কাটানোর সৌভাগ্য হয়েছে আমার। তিনি যে ভাবে নিখুঁত কাজ করতেন, তা আমি এখনও পারি না।’’
কন্যাকুমারীর বিবেকানন্দ শিলায় মোদী যখন ধ্যানে বলেছেন, তখন বিজেপি এবং সঙ্ঘের একাংশ ‘একনাথ-সংযোগ’ খুঁজে পাচ্ছেন।
ভারতের দক্ষিণতম প্রান্তে তামিলনাড়ুর মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় ৫০০ মিটার দূরে দু’টি পাথর রয়েছে। কিংবদন্তি অনুযায়ী, তারই একটি শিলায় দেবী কন্যাকুমারী (পার্বতী) শিবের জন্য তপস্যা করেছিলেন। আর ইতিহাস বলে, স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর আমেরিকা সফরের আগে শিলাটির উপরে বসে টানা তিন দিন ধ্যান করেছিলেন। ১৮৯২ সালে সেখানেই তিনি কন্যাকুমারী সঙ্কল্পের ভিত্তি হিসেবে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন বলেও জানা যায়। এমনও কথিত যে, মূল ভূখণ্ড থেকে সাঁতার কেটে সমুদ্রের মধ্যে জেগে-ওঠা ওই শিলায় পৌঁছেছিলেন স্বামীজি। ১৮৯২ সালের ডিসেম্বরের শেষে সেই ধ্যানের পরে ১৮৯৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর শিকাগো বিশ্বধর্ম সম্মেলনে তাঁর সেই ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়েছিলেন বিবেকানন্দ।
স্বামীজি তথা রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর যোগাযোগের কথা সর্বজনবিদিত। একটা সময়ে স্বামী আত্মস্থানন্দ মহারাজের ‘সেবক’ ছিলেন মোদী। পরে রাজনীতিতে যোগ দেন। তবে মোদীর মূল সংগঠন আরএসএসের সঙ্গেও কন্যাকুমারীর গভীর যোগ রয়েছে। যে ভাবে অযোধ্যায় রামমন্দির তৈরির দীর্ঘ আন্দোলনে যোগ ছিল আরএসএসের, ততটা না হলেও কন্যাকুমারীতে বিবেকানন্দ শিলা স্মারক স্থাপনেও ছিল। অল্প সময়ের মধ্যে হলেও সেই আন্দোলনের পদ্ধতির সঙ্গে মিল ছিল অযোধ্যাপর্বের।
১৯৭০ সালে কন্যাকুমারীতে শিলা স্মারকের উদ্বোধন হয়। তাতে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিলেন একনাথ রানাডে। মরাঠি রানাডে নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়তে পড়তেই আরএসএসের সঙ্গে যুক্ত হন ১৯৩৭ সালে। সঙ্ঘের বয়স তখন সবে ১২ বছর। একের পর এক দায়িত্ব পালন করতে করতে সঙ্ঘের পূর্বক্ষেত্রের প্রচারক হন রানাডে। আরএসএসের সাংগঠনিক বিচারে পশ্চিমবঙ্গ এই পূর্বক্ষেত্রের মধ্যেই। ১৯৪৮ সালে গান্ধীজি খুন হওয়ার পরে দেড় বছরের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যায় আরএসএস। অনেকে গ্রেফতার হলেও রানাডে হননি। তিনি তখন কলকাতাতেই আত্মগোপন করেছিলেন। আরএসএসের প্রবীণ প্রচারক বিজয় আঢ্যের কথায়, ‘‘একনাথজির যেমন দেশভক্তি ছিল তেমনই স্বামীজির আদর্শ নিয়ে চলতেন। যখন সঙ্ঘ কন্যাকুমারীতে বিবেকানন্দ শিলা তৈরির সিদ্ধান্ত নেয় তখন একনাথজিকে সর-কার্যবাহের দায়িত্ব থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। এটা খুব বড় সিদ্ধান্ত ছিল।’’
সেই সময়ে আরএসএসের সর-সঙ্ঘচালক অর্থাৎ প্রধান ছিলেন মাধব সদাশিবরাও গোলওয়ালকর। যিনি ‘গুরুজি’ নামেই পরিচিত। তাঁর ঠিক পরের পদেই ছিলেন একনাথ। স্বামীজির জন্মশতবর্ষের বছর অর্থাৎ ১৯৬২ সালেই শুরু হয়ে যায় কন্যাকুমারীতে শিলা স্মারক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ। ‘বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়াল কমিটি’র সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছিল একনাথকে।
(বাঁ দিকে) একনাথ রানাডে। কন্যাকুমারীর রক মেমোরিয়াল (ডান দিকে)। ছবি: সংগৃহীত।
এই শিলা নিয়েও অবশ্য ধর্মীয় বিতর্ক ছিল। সঙ্ঘের লক্ষ্য ছিল, ওই শিলার উপর একটি স্মৃতিসৌধ এবং শিলায় পৌঁছনোর জন্য একটি সেতু স্থাপন করা। সেটা জানতে পেরে স্থানীয় ক্যাথলিক মৎস্যজীবীরা পাথরের উপর একটি বড় ‘ক্রস’ স্থাপন করেন। যা তীর থেকে দৃশ্যমান। তৎকালীন মাদ্রাজ প্রশাসন সমস্যায় পড়ে। কারণ, হিন্দুরা শিলাটিকে ‘বিবেকানন্দ রক’ বলে দাবি করেন এবং খ্রিস্টানরা বলতে থাকেন ‘সেন্ট জেভিয়ার্স রক’। শেষে হিন্দুদের পক্ষ নিয়ে ক্রসটি গোপনে সরিয়ে দেওয়া হয় এবং ওই শিলাকে সকলের জন্য ‘নিষিদ্ধ’ এলাকা ঘোষণা করা হয়। তামিলনাড়ুর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী এম ভক্তবতসালামের বক্তব্য ছিল, শিলাটি ‘বিবেকানন্দ শিলা’ হলেও তাতে কোনও স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হবে না। শুধু একটি ফলক স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়।
তৎকালীন কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী হুমায়ুন কবিরও সৌধ বানানোর বিপক্ষে ছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, তাতে শিলাটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট হবে। প্রসঙ্গত, হুমায়ুন ছিলেন উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট লোকসভা আসনের কংগ্রেস সাংসদ। দু’বার ওই আসন থেকে জেতেন তিনি। ফলে উপায় ছিল একটাই, প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সমর্থন আদায় করা। লালবাহাদুর শাস্ত্রীর পরামর্শে একনাথ দিল্লিতে গিয়ে ৩২৩ জন সাংসদের স্বাক্ষর জোগাড় করে নেহরুকে জমা দেন। স্মারক নির্মাণের অনুমতি মিলে যায়। এর পরে অর্থসংগ্রহের জন্য নতুন পদ্ধতি নেন একনাথ। প্রস্তাবিত স্মারকের যাবতীয় বিবরণ দিয়ে একটি ‘ফোল্ডার’ ছাপিয়ে গোটা দেশে বিক্রির উদ্যোগ নেন। আরএসএস সারা দেশে এই ভাবে অর্থসংগ্রহ করে। কারণ, একনাথ চেয়েছিলেন, কন্যাকুমারীর স্মারক নির্মাণে গোটা দেশের ‘সহযোগ’ থাক। সেই সময়ের কথা স্মরণ করিয়ে প্রচারক বিজয় বলেন, ‘‘মূলত ১ টাকা করে নেওয়া হলেও একটি ১১ টাকার কুপনও ছাপা হয়েছিল। বাড়ি বাড়ি গিয়ে অর্থসংগ্রহ করা হয়। ধনীদের থেকে ১১ টাকা করে নেওয়া হয়। সেই সময়ে প্রথম উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলি থেকেও স্মারক নির্মাণের অর্থসংগ্রহ করা হয়। কারণ, একনাথজির বক্তব্য ছিল, এটা হলে সবাই যে একই ভারতের অঙ্গ, সেই বার্তাও পৌঁছে যাবে।’’
ঘটনাচক্রে, একনাথের দেখানো সেই পথেই অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণের জন্য অর্থসংগ্রহ করে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। একনাথ যখন ওই কাজ করছেন, তখনই তাঁর সান্নিধ্যে আসেন মোদী। সঙ্ঘের প্রচারক হিসাবে সেই কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকার পাশাপাশি একটা সময়ে তিনি সরাসরি একনাথের সহযোগীও হন। সে কথা তিনি নিজেই জানান ২০১৪ সালে একনাথের জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানে। দিল্লির বিজ্ঞান ভবনে মোদী জানিয়েছিলেন, তাঁর কাছে বড় প্রেরণা একনাথের জীবন।
কন্যাকুমারীতে ধ্যানে বসা মোদীর ভাবনায় বিবেকানন্দের পাশাপাশি একনাথও রয়েছেন বলেই মনে করছেন অনেকে। ছ’বছর লেগেছিল স্মারক বানাতে। প্রধানমন্ত্রী তখন ইন্দিরা গান্ধী। একনাথ স্মারক বানানোয় সমর্থন পেয়েছিলেন ইন্দিরারও। ১৯৭০ সালের ২ সেপ্টেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি উদ্বোধন করেছিলেন ওই শিলার। প্রসঙ্গত, রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেই গোটা কাজটি করেছিলেন একনাথ। এমনকি, যে মন্দির তৈরি হয়েছে, তার নকশায় বেলুড় মঠেরও অনুকরণ রয়েছে।
ওই স্মারক নির্মাণে সাফল্যের পরে একনাথ বিবেকানন্দকে নিয়ে চর্চার জন্য নতুন একটি সংগঠন গড়েন। ‘বিবেকানন্দ কেন্দ্র’ নামের সেই সংগঠনের সঙ্গেও গভীর যোগ ছিল মোদীর। তবে সবই তিনি রাজনীতিতে আসার আগে।