Narendra Modi

২০১৪: সাক্ষাৎকার শূন্য! ২০১৯: অক্ষয়-সাক্ষাৎকার! ২০২৪: সাক্ষাৎকার ১০০! হঠাৎ কেন কল্পতরু মোদী?

২০১৯ সালের ভোটের আগে কেবল অভিনেতা অক্ষয় কুমারকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন মোদী। যে অক্ষয় নিজেকে ‘পদ্মভক্ত’ বলতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। সেই সাক্ষাৎকারের ‘নিরপেক্ষতা’ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল।

Advertisement

শোভন চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০২৪ ১৯:৫৬
Share:

নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র।

তিনি কেন সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন না? প্রশ্নের মধ্যে কি ‘জুজু’ দেখেন? সংবাদমাধ্যমকে কি তিনি ‘স্তাবক’ করে রাখতে চান? গত ১০ বছরের শাসনকালে এ হেন বিবিধ প্রশ্ন উঠেছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সম্পর্কে। প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধীরা। মোদী সে সবের জবাব দেননি। কিন্তু সর্বভারতীয় বিজেপির অনেক নেতা সে সব প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে অনেক সময় হোঁচট খেয়েছেন। কিন্তু ২০২৪ সালে মোদী সাক্ষাৎকারে ‘কল্পতরু’ হয়েছেন।

Advertisement

শনিবার মোদীর লোকসভা কেন্দ্র বারাণসীতে ভোটগ্রহণ। বৃহস্পতিবার প্রচার শেষ হয়েছে। ভোটঘোষণা হওয়া থেকে প্রচার শেষ হওয়া পর্যন্ত কতগুলি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী? বিজেপির অনেক নেতাই ঠিকঠাক সংখ্যা বলতে পারছেন না। কেউ বলছেন, অসংখ্য! কেউ বলছেন অগুনতি! কেউ বলছেন ৮০-৯০টি। তবে দিল্লি বিজেপির একটি সূত্রের দাবি, মোদীর এ বার পরিকল্পনা ছিল মোট ১০০টি সাক্ষাৎকার দেবেন। সেই লক্ষ্যমাত্রা তিনি ছুঁয়ে ফেলেছেন।

২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে মোদী কাউকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বলে কেউ মনে করতে পারছেন না। ২০১৯ সালের ভোটের আগে শুধু বলিউডের অভিনেতা অক্ষয় কুমারকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন মোদী। যে অক্ষয় নিজেকে ‘পদ্মভক্ত’ বলতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। সেখানে সবচেয়ে আলোচিত প্রশ্ন ছিল: মোদী আম ছুলে খান? না চুষে? যে সূত্রে বিরোধীদের বক্তব্য ছিল, সাক্ষাৎকারকে ছায়াছবির পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন মোদী। সাজানো চিত্রনাট্যে অভিনয় করেছেন। মোদী তাতে কান দেননি। বিজেপিও আমল দেয়নি নিন্দামন্দে। ২০১৯ সালের ভোটে দেখা গিয়েছিল, বিজেপি একাই ৩০৩টি আসন নিয়ে দিল্লিবাড়ি দখল করেছে। তার পরেও গত পাঁচ বছরে মোদী একটিও সাক্ষাৎকার দেননি। এমনকি, ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে মাত্র একটিই সাংবাদিক বৈঠক করেছেন। ২০১৯ সালের ভোটের ঠিক আগে দিল্লির দীনদয়াল উপাধ্যায় মার্গে বিজেপির কেন্দ্রীয় দফতরে। কিন্তু ২০২৪ সালে সাক্ষাৎকারের উইকেটে টি-টোয়েন্টির ব্যাটিং করেছেন মোদী। চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে সেঞ্চুরি করে ফেলেছেন!

Advertisement

‘কল্পতরু’ মোদী এ বার সাক্ষাৎকার দিয়েছেন দক্ষিণ ভারতের টেলিভিশন চ্যানেল থেকে শুরু করে হিন্দি, ইংরিজি, বাংলা, পঞ্জাবি এমনকি, অহমিয়া সংবাদমাধ্যমকেও! নিজের রাজ্য গুজরাত তো রয়েইছে।

কেন সাংবাদিক বৈঠক করেন না মোদী? কেন একান্ত সাক্ষাৎকার দেন না?

এই সাক্ষাৎকার সিরিজ়ে তার তিনটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এক, আগে নেতারা সংবাদমাধ্যমকে বলে দিতেন। সে কথা মানুষের কাছে পৌঁছে যেত। কিন্তু তিনি চেয়েছেন মানুষের কাছে সরাসরি পৌঁছতে। তাই আদিবাসীদের জন্য কোনও প্রকল্পের উদ্বোধন হলে তিনি সশরীরে পৌঁছে গিয়েছেন ঝাড়খণ্ডের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। তিনি সরাসরি মানুষের সঙ্গে কথা বলে সরকার চালাতে চেয়েছেন। সংবাদমাধ্যমকে ব্যবহার করতে চাননি। তাঁর কথায়, ‘‘আমি সংস্কৃতিটা বদলাতে চেয়েছিলাম।’’ মোদীর দ্বিতীয় ব্যাখ্যা, সংবাদমাধ্যমও এখন আগের জায়গায় নেই। তাঁর কথায়, ‘‘প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের এক জন করে মুখ হয়ে গিয়েছেন। তাঁদের রাজনৈতিক অভিমতও প্রকাশ্যে চলে আসছে। ফলে তাঁরা কতটা নিরপেক্ষ, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।’’ তৃতীয় ব্যাখ্যা, মোদীর কথায়, ‘‘ধ্রুপদী সংবাদমাধ্যম ছাড়াও এখন অন্য মাধ্যমও রয়েছে। যেখানে আমি কিছু একটা বললে বা লিখলে সাধারণ মানুষ সরাসরি তার ভাল-মন্দ জানাতে পারেন। তাঁদের মতামত ব্যক্ত করতে পারেন। আমি সেই মাধ্যমই ব্যবহার করেছি।’’

কিন্তু এ বার কেন ভূরি-ভূরি সাক্ষাৎকার দিলেন, তার কোনও ব্যাখ্যা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাওয়া যায়নি। সে প্রশ্ন অবশ্য তাঁকে কেউ জিজ্ঞাসাও করেননি।

তবে সাক্ষাৎকারের ঘটা সম্পর্কে রাজ্যসভার তৃণমূল সাংসদ সুস্মিতা দেব বলেছেন, ‘‘বিজেপি বিকশিত ভারতের প্রেক্ষাপট রচনা করে ভোটে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু জনজীবনের বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত মানুষ তা গ্রহণ করেননি। সেটা বুঝতে পেরেই মোদীকে এত সাক্ষাৎকার দিতে হয়েছে। কারণ, বিজেপিও অনুধাবন করেছে, তারা যে অভিমুখ নিয়ে ভোটে যেতে চেয়েছিল, তা পারেনি।’’ সিপিএম পলিটব্যুরোর সদস্য তথা রাজ্যসভার প্রাক্তন সাংসদ নীলোৎপল বসুর বক্তব্য, ‘‘যে সাক্ষাৎকারগুলি প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন, তার বেশির ভাগেরই প্রশ্ন সাজানো। মানুষের প্রশ্ন তাঁর কাছে তুলে ধরা হয়নি। এত দিন পর্যন্ত বিজেপির আইটি সেল, প্রচারমাধ্যম মোদীর বিপণন করত। এখন তাতে কাজ হচ্ছে না দেখে মোদী নিজেই নিজের বিপণন করছেন!’’ তবে রাজ্যসভার বিজেপি সাংসদ তথা বঙ্গ বিজেপির প্রধান মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ‘‘নরেন্দ্র মোদী দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে বেড়িয়ে ১০ বছর ধরে যত সভা করেছেন, তা কোনও প্রধানমন্ত্রী করেননি! তিনি সর্বব্যাপী। তাঁর মনে হয়েছে, এ বার সাক্ষাৎকার দেওয়া প্রয়োজন। তিনি দিয়েছেন। এর মধ্যে বদলের কোনও বিষয় নেই।’’

প্রসঙ্গত, মোদী যে সমস্ত সাক্ষাৎকার সম্প্রচারিত হয়েছে, তার অনেকগুলিই নয়াদিল্লির লোক কল্যাণ মার্গে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে দেওয়া। আবার কিছু রাস্তায় রোড-শোয়ের অবসরে কয়েক মিনিটের কথোপকথন। তাকে প্রথাগত ভাবে ‘সাক্ষাৎকার’ না-বলা গেলেও মোদী নিজে সেগুলিকে ‘সাক্ষাৎকার’ বলেই ধরেছেন। নিজের সমাজমাধ্যমে রাস্তায় চলতে চলতে ওই যৎসংক্ষিপ্ত ‘কথোপকথন’-কেও ‘সাক্ষাৎকার’ বলেই বর্ণনা করেছেন।

তবে সে সব সাক্ষাৎকারেরও নানা ‘ব্যাখ্যা’ রাজনৈতিক পরিসরে রয়েছে। তথ্য-সহ সেই সাক্ষাৎকারসমূহের বিশ্লেষণও করেছেন কেউ কেউ। বিরোধীদের বক্তব্য, যে সাক্ষাৎকারগুলি মোদী এ বার দিয়েছেন, সেখানে তাঁকে কোভিড পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের ভূমিকা, অপরিকল্পিত লকডাউন, দেশে দলিত এবং মুসলিমদের উপর আক্রমণ সংক্রান্ত প্রায় কোনও প্রশ্নই করা হয়নি। গুটি কয়েক সাক্ষাৎকারে মণিপুর এবং সীমান্তে চিনা ফৌজের আগ্রাসন নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে। তা-ও ‘নিরীহ’ গোছের। প্রধানমন্ত্রীর জবাবের ‘পাল্টা’ প্রশ্ন করা হয়নি। তেমনই নির্বাচনী বন্ড, ব্রিজভূষণ শরণ সিংহদের বিষয়ে মোদীকে কতগুলি প্রশ্ন সাক্ষাৎকারে করা হয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন বিরোধীরা। কর্নাটকে বিজেপির জোটসঙ্গী জনতাদল সেকুলারের সাংসদ তথা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এইচডি দেবগৌড়ার নাতি প্রজ্বল রেভান্নার বিরুদ্ধে একাধিক যৌন হেনস্থার ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পরে কমবেশি ৬০টি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন মোদী। কিন্তু তার মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটিতে তাঁকে সেই সংক্রান্ত প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে।

তবে একথা অনস্বীকার্য যে, সাক্ষাৎকারে এ বার দেশজ সংবাদমাধ্যমকে ভাসিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। দেশজোড়া প্রচারের ফাঁকে সময় বার করে ঘণ্টাখানেক বা তারও বেশি সময় ধরে তিনি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বলে দেখা গিয়েছে। ‘কল্পতরু’ই বটে!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement