মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। মঙ্গলবার সাংবাদিক বৈঠকে। —নিজস্ব চিত্র।
কাঁথি-সহ রাজ্যের আরও চার-পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ আসনে তাঁদের জোর করে হারানো হয়েছে, এমনকি, জিতলেও জয়ের শংসাপত্র দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করলেন তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মঙ্গলবার রাজ্যের ২৯টি লোকসভা আসনে তৃণমূলের জয় প্রায় নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পরেই সন্ধ্যায় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে পাশে নিয়ে একটি সাংবাদিক বৈঠক করেন মমতা। সেখানেই তিনি বলেন, কাঁথিতে আমরা জিতেছিলাম। কিন্তু বিজেপির পর্যবেক্ষকেরা আমাদের শংসাপত্র আটকে রেখেছে।
প্রসঙ্গত, কাঁথি আসনটি এর আগের লোকসভায় জিতেছিল তৃণমূলই। তৎকালীন তৃণমূল নেতা তথা বর্তমান বিজেপির বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারীর বাবা শিশির অধিকারী ছিলেন তৃণমূলের কাঁথির সাংসদ। কিন্তু কালে কালে বাংলার রাজনীতির পরিস্থিতি বদলেছে। শুভেন্দু যোগ দিয়েছেনবিজেপিতে। কাঁথির আসনটি তৃণমূলের থেকেও আর তৃণমূলে থাকেনি। সেই কাঁথিতে এ বারে তৃণমূলের প্রার্থী ছিলেন উত্তম বারিক। অন্য দিকে, বিজেপির তরফে প্রার্থী করা হয়েছিল শুভেন্দুর ভাই সৌমেন্দু অধিকারীকে। মঙ্গলবার সৌমেন্দু আর উত্তমের মধ্যে দীর্ঘ ক্ষণ হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলেছে। কখনও কখনও দু’পক্ষের ব্যবধান ৬০০-৮০০ ভোটেরও থেকেছে। মমতার বক্তব্য ওই আসনে জিতেছেন উত্তমই। কিন্তু বিজেপির পর্যবেক্ষক ইচ্ছাকৃত ভাবে শংসাপত্র দেয়নি।
মমতা বলেন, ‘‘চার-পাঁচটা জায়গায় এখনও বিজেপি আমাদের জেতা আসনগুলিতেও শংসাপত্র দিচ্ছে না। কাঁথিতে জেতার পরও বিজেপির পর্যবেক্ষক আটকে রেখে দিয়েছে শংসাপত্র বিজেপিকে জয়ী ঘোষণা করার জন্য। এই ভাবে নরেন্দ্র মোদী আরও কয়েকটা বড় আসন আটকে রেখেছেন যে হেতু উনি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাননি। ’’
যদিও রাত ৮টা নাগাদ কাঁথি আসন সম্পর্কে দেওয়া নির্বাচন কমিশনের হিসাব বলছে, সৌমেন্দু এই আসনে ৪১ হাজার ৯০৪ ভোটের ব্যবধানে জিতেছে। যদিও মমতার বক্তব্য, কাঁথিতে বা তমলুকে ভোট হয়নি। তাঁর কথায়, ‘‘তমলুকে আপনারা দেখেছেন, ওটা ভোট নয়। নন্দীগ্রামে আমার সঙ্গে যা করেছিল, ওখানেও তেমন রিগ করেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভিভিপ্যাট কাউন্টিং হলে দেখা যাবে ওটাতেও হেরেছে। কাঁথির আসন আমরাই জিতেছি। কিন্তু বিজেপির হয়ে কাজ করা পর্যেবক্ষকেরা রাজনীতি করেছে। বিজেপি অবজ়ার্ভার দেখে দেখে এ রাজ্যে পাঠানো হয়েছে। রাজ্য পুলিশকে কাজেই লাগানো হয়নি।’’
মমতার কথায়, ‘‘তৃণমূলের ভোটের সংখ্যা বেড়েছে। যেখানে হেরেছে খুব অল্প ভোটে হেরেছে। জোর করে হারানো হয়েছে। পর্যবেক্ষকেরা যদি রাজনীতি করেন, তবে আমরা দুঃখিত। কিন্তু আমি জানি আমাদের আসন বাড়ত। আরও কয়েকটি আসন আমাদের পাওয়ার কথা ছিল। দরকার হলে কিছু আসনে পুনর্গণনাও হবে।’’
মমতা জানিয়েছেন, বাংলার মানুষের কাছে তিনি চিরকৃতজ্ঞ। কিন্তু বিজেপি শংসাপত্র আটকে রেখে এখনও রাজনীতি করছে। তাই তিনি বিজেপিকে ছেড়ে দেবেন না। রাজনৈতিক ভাবে এর বদলা নেবেন। দরকারে পুনর্গণনা হবে।
মমতা বললেন, ‘‘মোদী, তোমার ভোট অন্য কোথাও যায়নি। তোমার ম্যাজিক শেষ। তোমাকে পদত্যাগ করতে হবে।’’
মমতা বললেন, ‘‘মোদী যদি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেত তবে দেশ থাকত না। এনডিএ এখন ‘লস্ট কেস’। তাই যাঁরা ওঁদের সমর্থন করবেন বলে ভাবছেন, তাঁদের আমরা বারণ করব। এর থেকে বেশি কিছু করতে পারি না। তবে মানুষকে আমি ধন্যবাদ জানাব। তাঁদের ভালবাসার কাছে আমার মাথা নত করতে ইচ্ছে করছে। এর পরে আমাদের লক্ষ্য হবে একটাই , বাংলার যে সমস্ত অর্থ ওরা আটকে রেখেছে, বাংলাকে যে সমস্ত সুবিধা থেকে কেন্দ্র বঞ্চিত করেছে, সেই সব আদায় করে আনা। কেন্দ্রে আর ওদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকবে না। তাই যথেচ্ছ বিল পাশ করতে পারবে না। আমরা আমাদের অধিকার আদায় করতে পারব।’’
মমতা বললেন, ‘‘এখানে ওরা সিআরপিএফ রেখে দিয়েছে। সিআরপিএফকে যত দিন রাখব, তত দিন আমাদের খরচ বাড়বে। আমরা কেন খরচ করব? ওই অর্থে উন্নয়ন করব। তা ছাড়া আমাদের স্কুল-কলেজগুলোও তো খুলতে হবে। ওরা থাকলে কী করে খুলব!’’
মমতা বললেন, ‘‘মোদী একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে অত্যাচার করত। যত খুশি বিল পাশ করিয়ে নিয়েছে। রাজ্যের প্রধানদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে। এজেন্সির রাজনীতি করেছে। এ বার ওরা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। এ বার কি আমরা ছেড়ে দেব? আশা করি ইন্ডিয়ার সদস্যেরাও ছেড়ে দেবে না। বরং আমাদের টিম বাড়বে। কমবে না। ’’
উত্তর দিনাজপুরের আসন নিয়ে আইএসএফকে নাম না করে আক্রমণ করলেন মমতা। বললেন, ‘‘ওই একটা সিট বিজেপিকে পাইয়ে দিয়ে কী হল? বিজেপিকে না দিলে আরও দুটো আসন বিজেপির কম হত। কিন্তু এখন কী লাভ হল?’’
অধীররঞ্জনের হার প্রসঙ্গে মমতার মন্তব্য, ‘‘উনি কংগ্রেসের নেতা নন। উনি আসলে বিজেপি। আর বিজেপিকে মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছেন।’’ বহরমপুরে তৃণমূল প্রার্থী ইউসুফ পাঠানের জয় প্রসঙ্গে বললেন, ‘‘উনি আমাদের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলেন। ভোটে লড়ার ব্যাপারে। আমি পাঠানকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।’’
মমতা বললেন, ‘‘যাঁরা বুথফেরত সমীক্ষা করেছিলেন, তাঁরা অনেকের মনোবল ভেঙে দিয়েছিলেন। ওই রিপোর্ট কোথা থেকে হয়েছিল জানি। আমি নিশ্চিত, বিজেপির দফতর থেকে মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্যই ওই রিপোর্ট তৈরি করেছিল।’’
মমতা বললেন, ‘‘এই জয় মানুষের জয়, বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র জয়। আমি আমার সমস্ত ‘ইন্ডিয়া’র সঙ্গীদের সমর্থন জানাচ্ছি। যাঁরা আছেন। যাঁরা আমাদের সঙ্গে জুড়তে চান। তাঁদের প্রত্যেককে আমার শুভেচ্ছা।’’
নির্বাচন কমিশন বিজেপির ‘হিজ় মাস্টার্স ভয়েস’ অর্থাৎ প্রভুর আজ্ঞাবহ দাসের মতো কাজ করছে। মোদী অনেক রাজনৈতিক দলকে ভেঙেছে, এ বার জনতা ওদেরকেই ভেঙে দিয়েছে। মোদী এবং অমিত শাহের উচিত অবিলম্বে পদত্যাগ করা।
মমতা বললেন, ‘‘ওরা কম চেষ্টা করেনি। বিধায়কদের অর্থ দিয়েছে, ভয় দেখিয়েছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছু করতে পারেনি। উল্টে যে অযোধ্যা নিয়ে ওরা এত কিছু করল, সেখানেই হেরে গিয়েছে। ’’
মমতা বললেন, ‘‘রাহুলকেও অভিনন্দন জানিয়েছি, কিন্তু ওরা এখনও জবাব দেয়নি। সে ওরা যা করে করুক। যোগাযোগ না করলে কোনও অসুবিধা নেই। ’’
মমতা বললেন, ‘‘আমি খুশি নরেন্দ্র মোদী হেরেছেন। মানুষ ওঁকে জবাব দিয়েছে। ওঁর উচিত অবিলম্বে পদত্যাগ করা। ’’
মমতা বললেন, ‘‘চার-পাঁচটা জায়গায় এখনও বিজেপি আমাদের জেতা আসনগুলিতেও শংসাপত্র দিচ্ছে না। কাঁথিতে জেতার পরও বিজেপির পর্যবেক্ষক আটকে রেখে দিয়েছে শংসাপত্র বিজেপিকে জয়ী ঘোষণা করার জন্য। এই ভাবে নরেন্দ্র মোদী আরও কয়েকটা বড় আসন আটকে রেখেছেন যে হেতু উনি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাননি। ভারতবর্ষের জনগণকে তাই আমার ধন্যবাদ যে তাঁরা মোদীর দলকে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসাবে বেছে নেননি। বাংলার মানুষকেও আমরা ধন্যবাদ দেব যে তাঁরা দুই তৃতীয়াংশের বেশি আসনে আমাদের বেছে নিয়েছেন। আমাদের ভোটের সংখ্যা বেড়েছে। যেখানে হেরেছে খুব অল্প ভোটে হেরেছে। জোর করে হারানো হয়েছে। তবে ওরা যে রাজনীতি করছে। আমি ছেড়ে দেব না। রাজনৈতিক বদলা নেব। দরকারে পুনর্গণনা হবে।’’
সবাইকে অভিনন্দন জানালেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে হাজির হলেন। অভিষেককে পাশে নিয়ে সাংবাদিক বৈঠক শুরু করলেন। তার আগে বললেন, ‘‘অভিষেক সাত লক্ষের বেশি ভোটে জিতেছে। গোটা দেশে রেকর্ড করেছে। ওকে দেখে দিল্লির শেখা উচিত, শুধু রিগিং করে ভোট হয় না। ওকে আপনারা সবাই অভিনন্দন জানান।’’
রাহুল বললেন, ‘‘ইন্ডিয়া গঠবন্ধন যেখানেই লড়েছে এক হয়ে লড়েছে। এই পারফরম্যান্স ইন্ডিয়ার পারফরম্যান্স। দেশ নরেন্দ্র মোদীকে পরিষ্কার বলে দিয়েছে, আমরা আপনাকে চাই না। আমরা চাই না মোদী এবং শাহ এই দেশ চালান, যে ভাবে এই সংবিধানের অধিকার খর্ব করা হয়েছে, তারা পছন্দ করেনি। এই সংবিধান বাঁচানোর কাজ করেছেন দেশের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির মানুষেরা। তাঁদের ধন্যবাদ।’’
লোকসভার ভোটের প্রচারে প্রতিটি সভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলতেন, ‘‘ওরা বলছে ৪০০ পার করবে। আগে ৩০০ পেরিয়ে দেখা। তবে বুঝব।’’ সে কথা শুনে পাল্টা কটাক্ষ হানতেন বিরোধী বিজেপি নেতৃত্ব। অবশেষে মঙ্গলবার মোটামুটি স্পষ্ট, বিজেপি ৩০০ পার করতে পারবে না। আপাতত ২৪০-এর ঘরেই থমকেছে পদ্মের অশ্বমেধের ঘোড়া। মিলেছে মমতার ভোট-পূর্বাভাস। বিষয়টি স্পষ্ট হতেই মঙ্গলবার কালীঘাটের বাড়িতে প্রথমে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে বৈঠক করেন মমতা। তার পরেই আসেন সাংবাদিক বৈঠকে।