কলোনিপাড়ায় রেখার বাড়িতে ঢোকার মুখে বাঁশের গেট। —নিজস্ব চিত্র।
দৃশ্য ১: মাইক-বাঁধা একটি টোটো ঘুরছিল এলাকায়। সেখান থেকে ভেসে এল, ‘‘তৃণমূলের সমস্ত কর্মী-সমর্থকদের জানানো হচ্ছে, কেউ অশান্তি করবেন না। শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখুন।’’
দৃশ্য ২: সন্দেশখালি বাজারে যত টোটো দাঁড়ায়, তার প্রায় অর্ধেকই উধাও। জানা গেল, বিজেপি কর্মী-সমর্থক টোটো চালকেরা কেউ গাড়ি বার করেননি।
দৃশ্য ৩: মাঝেরপাড়ায় বিজেপি কর্মী পিয়ালি দাসের বাড়ির সামনে ডাঁই হয়ে পড়ে আছে সবুজ আবির। পাড়ার এক জন জানালেন, মঙ্গলবার ভোটের ফল স্পষ্ট হতেই গ্রামে আবির খেলেন তৃণমূল কর্মীরা। পিয়ালির বাড়ির সামনে এসে অনেকক্ষণ ধরে নাচানাচি চলে।
বুধবার সন্দেশখালিতে দমচাপা পরিস্থিতি। গোলমালের আশঙ্কায় সিঁটিয়ে আছে সেই সব পরিবার, যাঁরা কোনও না কোনও সময়ে বিজেপির আন্দোলনে পা মিলিয়েছিলেন। অনেকে মঙ্গলবার দুপুরের পর থেকে গোলমালের আশঙ্কায় বাড়ি ছেড়েছেন বলেও জানা গেল। পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানেরা রয়েছেন। তার পরেও ভরসা মিলছে না।
পিয়ালির বাড়ির গেট এ দিন ভিতর থেকে তালা বন্ধ ছিল। তিনি ফোনে জানালেন, বাড়িতে নেই। সেখানে অন্য লোকজন আছেন। ফিরছেন কবে, কখন? স্পষ্ট উত্তর মিলল না। পাত্রপাড়ায় বিজেপি পরিবারের এক মহিলা রান্না করছিলেন। মুখ ভার। বললেন, ‘‘দলের কারও সঙ্গে ভোটের পর থেকে কথা হয়নি। এখন ভয়ে ভয়ে আছি, কখন যে আক্রমণ হয়!’’
ভোটের আগে পুকুরপাড়ায় একটি বাড়ি ভাড়া নিয়েছিল বিজেপি। নেতারা বিভিন্ন সময়ে এসে থাকতেন। এ দিন সেই বাড়ি ছিল তালাবন্ধ। পাড়ার বিজেপির সমর্থক এক মহিলা বললেন, ‘‘আন্দোলন তো বৃথা হয়নি, বিধানসভা জয়ী হয়েছি। এখানে অন্যায় দেখলে ফের পথে নামব।’’ তাঁর কথায়, ‘‘আক্রমণ এখনও হয়নি, তবে হতেও পারে।’’
সন্দেশখালি বাজারে টোটোচালক লক্ষ্মণ দাস জানালেন, যে সব টোটোচালক বিজেপি করেন, তাঁরা অনেকে ভয়ে এ দিন স্ট্যান্ডে গাড়ি নিয়ে আসেননি। বেড়মজুরে কাটপোল বাজার এলাকায় এ দিন দুপুরে দু’এক জন পুলিশ কর্মীর দেখা মিলল। তাতে ভরসা পাচ্ছেন না অনেকেই। বিজেপির হয়ে যে সব মহিলা আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলেন, তাঁদের বাড়িতে গিয়ে কারও দেখা মিলল না। কোথায় গেলে দেখা করা যাবে? জবাব মেলেনি। টেলিফোনে এক বিজেপি নেত্রী বললেন, ‘‘আমার নাম লিখবেন না। তবে এটুকু জেনে রাখুন, ভয়ে বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় চলে এসেছি। তৃণমূল হুমকি দিচ্ছে, দেখে নেবে বলে।’’
বিজেপি নেতা বিকাশ সিংহ বলেন, ‘‘বিভিন্ন পঞ্চায়েত এলাকায় হুমকি দিচ্ছে তৃণমূল। এখনও অশান্তি হয়নি, তবে হতে কতক্ষণ!’’ তৃণমূল বিধায়ক সুকুমার মাহাতোর পাল্টা জবাব, ‘‘ভোটের আগে থেকে ওরা আমাদের সঙ্গে যা ব্যবহার করে এসেছে, সে কথা মনে করে নিজেরাই ভয় পাচ্ছে। কিন্তু আমরা বদলা নেব না। আমরা শান্তি চাই।’’ তাই টোটোয় মাইক বেঁধে শান্তিরক্ষার বার্তা দেওয়া হচ্ছে বলে জানালেন তিনি।
সবুজ আবির মেখে বাইকে ঘুরছেন তৃণমূল নেতা দিলীপ মল্লিক। বললেন, ‘‘বলেই তো ছিলাম, মানুষ আমাদের জয়ী করলে কোনও অশান্তি হবে না সন্দেশখালিতে। অশান্তি এড়াতে বিজয় মিছিলও হচ্ছে না এখনে।’’
কিন্তু রেখা পাত্র কোথায়? কলোনিপাড়ায় রেখার বাড়ির সামনে সাদা পোশাকে এক সিভিক ভলেন্টিয়ার বসেছিলেন। বাড়িতে ঢোকার মুখে বাঁশের গেট। তাতে ঝুলছে তালা। অনেক ডাকাডাকিতে বাড়ি থেকে বেরোলেন এক যুবক। গড়গড় করে বলে গেলেন, ‘‘আমরা কিছু জানি না, কিছু বলব না। রেখা এখানে থাকে না। রেলিং খোলা যাবে না।’’
রেখা এ দিন ফোন ধরেননি। তাঁর স্বামী সন্দীপের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি ফোনে জানান, ডাক্তার দেখানোর জন্য সল্টলেকে আছেন। কথা না বাড়িয়ে ফোন কেটে দেন। দলের পক্ষ থেকে বসিরহাট শহরে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়া হয়েছিল রেখার জন্য। সেই ফ্ল্যাটেও এ দিন তালা। আশপাশে কথা বলে জানা গেল, ফ্ল্যাট ছেড়ে দিচ্ছেন মালিকপক্ষ। জিনিসপত্র বের করে নিয়ে যাবেন বলে জানিয়ে গিয়েছেন।
তথ্য সহায়তা: নির্মল বসু