Lok Sabha Election 2024

কৃষকের দাবি না মেটালে গণবয়কট, ডাক সাঙ্গরুরে

স্থানীয় গুরুদ্বারের সামনের ভিড় দাবি করছে, শুধু এই জেলা নয়, গোটা রাজ্য ফুঁসছে বিজেপি-র বিরুদ্ধে। এমনকি, শিরোমণি অকালি দলকেও ভোট দেবে না পঞ্জাব।

Advertisement

অগ্নি রায়

সাঙ্গরুর শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০২৪ ০৫:৪৩
Share:

সাঙ্গরুর রাস্তায় কৃষকদের পোস্টার। — নিজস্ব চিত্র।

বসন্তের ফসল কাটার উৎসব এসে গেল প্রায়। বৈশাখীর আগে পঞ্জাবের এই সবুজ, উৎসব হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে দিগন্ত পর্যন্ত। চৈত্রের রোদে খেতজমিতে কাটাকুটি খেলছে আলো। আগে পাটিয়ালা রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত, এই জেলা সাঙ্গরুরের নামোল গ্রামে নির্বাচন আসছে চোয়ালকষা প্রতিজ্ঞা নিয়ে। সেই প্রতিজ্ঞা ফেস্টুন পোস্টার হয়ে ঝুলছে ল্যাম্পপোস্ট, গুরুদ্বারের থাম, অশ্বত্থ বা তেঁতুল গাছের লাগোয়া।

Advertisement

পোস্টার বলছে, ‘যদি এই গ্রামের কোনও ব্যক্তি বিজেপি-র কোনও নেতাকে নিয়ে ঢোকে, তার দায়িত্ব আমাদের নয়।’ কোথাও লেখা ‘কিষান মজদুর মোর্চা জিন্দাবাদ। বিজেপি-র কোনও নেতাকে যেন এই গ্রামে দেখতে না পাওয়া যায়।’ সঙ্গে শুভকরণ সিংহের ছবি, যিনি পঞ্জাব-হরিয়ানা সীমান্তে আন্দোলনরত অবস্থায় সম্প্রতি পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ায় বিক্ষোভের বাষ্প সাঙ্গরুরে পৌঁছেছে।

বিপ্লবী উধম সিংহ, কবি প্রীতম সিংহ রাহীর মাটি এই সাঙ্গরুর যেমনই আবেগপ্রবণ, তেমনই চোয়ালকষা। ‘চারশো পার’-এর ডাক দেওয়া মোদী সরকার তথা এনডিএ-র মুখের উপরে এমন চ্যালেঞ্জ ঝোলাতে দেশে এই মুহূর্তে আর কে-ই বা পারছে! উত্তর ভারতে এমন প্রবল গেরুয়া প্রতাপের মধ্যে? আর শুধু নামোল গ্রাম তো নয়, গোটা সাঙ্গরুর জেলাই এই পোস্টারে ছয়লাপ। যার বক্তব্য, ‘কৃষকদের দাবিদাওয়া নিয়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে আমাদের দিল্লি যেতে দেয়নি বিজেপি সরকার। আমরাও তাদের দলের কোনও নেতাকে এই গ্রামে বা জেলায় ঢুকতে দেব না।’

Advertisement

স্থানীয় গুরুদ্বারের সামনের ভিড় দাবি করছে, শুধু এই জেলা নয়, গোটা রাজ্য ফুঁসছে বিজেপি-র বিরুদ্ধে। এমনকি, শিরোমণি অকালি দলকেও ভোট দেবে না পঞ্জাব। ‘কারণ এখন আলাদা লড়লেও, ওরা আসলে মোদীরই দোসর। ভোটের পর ঠিকই মিলে যাবে।’ এই গ্রামে গত কয়েক দিন সংবাদমাধ্যমের যাতায়াত বেড়েছে সম্ভবত পোস্টারের কারণে। পৌঁছতেই, ভিড়ের মধ্যে থেকে সপ্রতিভ প্রবীণকে সামনে এগিয়ে দিয়ে বটগাছের নীচে বসানো হল। দুধের মালাই দেওয়া চা কাপের পর কাপ।

প্রবীণ হরকৃপাল সিংহ যে বহু ভোটযুদ্ধের সাক্ষী, তা তাঁর ঝুঁকে পড়া অবয়ব এবং হাতের শীর্ণ লাঠিটিই বলে দিচ্ছে। “যে দল বিজেপি-র সঙ্গে জোট করবে তার ঢোকা এখানে বন্ধ। কংগ্রেস তাদের ইস্তাহারে কৃষকদের কথা রেখেছে, আমরা লক্ষ্য করেছি। সেটা নির্বাচনের জুমলা কি না, সেটাও ভাবছি। মনস্থির করিনি এখনও। কিন্তু এটা বলতে পারি বিজেপি-কে আমরা এই রাজ্যে ঢুকতেই দেব না। যে দিতে চাইবে বিরোধ হবে।’’ বলেই যান বৃদ্ধ, ‘‘পঞ্জাবের জন্য কিছুই করেনি বিজেপি। নাঙ্গাল বাঁধ থেকে আমাদের জলের কোটা কমিয়েছে, চণ্ডীগড়ে আমাদের বাচ্চাদের পড়াশোনার সুযোগ কমিয়েছে। এক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অন্যকে লড়িয়ে দিচ্ছে। এই নামোল গ্রামে মুসলমান কিছু কম আছে নাকি? আমাদের মধ্যে কই, এক দিনের জন্যও তো বিবাদ হয়নি। কৃষকদের উপর পীড়নের নীতি
তো রয়েছেই।”

এক টানা আবেগে কথাগুলো বলে একটু হাঁফ ধরেছে হরকৃপালের। অভিযোগ যে শুধু বিজেপি-র দিকেই তা তো নয়, রাজ্যে এত দিনের আপ শাসনও যে কৃষকদরদি থেকেছে, বিষয়টি এমনও নয় তাঁদের কাছে। তাই এ বারের ভোট পড়বে বুঝে শুনে, বিজেপি-বিরোধী প্রার্থীর তুল্যমূল্য বিচার করে (পঞ্জাবে এ বার চতুষ্কোণ লড়াই, বিজেপি, অকালি, আপ এবং কংগ্রেসের)।

পঞ্জাবের মোট ১৮২৮টি মান্ডির জন্য রয়েছে ১৫৪টি মার্কেট বোর্ড। কৃষিপণ্য যাতে ঠিক ভাবে বাজারজাত হয়, কোনও বৈষম্য যাতে না হয়, শস্য যাতে সরকার ঠিক মূল্য দিয়ে কেনে, সহায়ক মূল্য বাড়ানোর জন্য সুপারিশ করা, যাতে কৃষকের টাকা আটকে না থাকে তা দেখা—এই সবই কাজ মার্কেট বোর্ড-এর। স্থানীয় গম ও ধানের সম্পন্ন কৃষকের যশপ্রীত সিংহের বক্তব্য, ‘‘এই বোর্ডগুলি ভরে গিয়েছে নানাবিধ দালালে। ঠিক সময়ে বিজ্ঞপ্তি দেয় না। গোলা উপচে পড়া ফসল রাখার জায়গার অভাবে যখন সামান্য দামে কোনও ফড়েকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হন কৃষক, তখন তা আটকে রেখে, বাজারে চাহিদা বাড়িয়ে, চড়া দামে ছাড়ার যে চক্র, তাকেই ইন্ধন দেয়। এই সব কিছুতেই রাজ্যের শাসক দলের নেতাদেরও আধিপত্য রয়েছে।’’

সব মিলিয়ে এ বার সাঙ্গরুর জেলার স্লোগান, ‘ভোট পে চোট হ্যায়!’ হয় কৃষকের দাবি মেটাও, নয়তো নির্বাচনে গণবয়কট করা হবে। সংযুক্ত কিসান মোর্চা, এক-এক সপ্তাহে এক-এক জন সম্পন্ন কৃষকের বাড়ির দাওয়ায় একটি করে জমায়েত শুরু করেছে গত দু’মাস। আয়োজক বাড়িরই দায়িত্ব থাকে সে দিন সবাইকে খাওয়ানোর। বিজেপি বা অন্য কোনও রাজনৈতিক নেতার নাক গলানোর ব্যাপার নেই। চাতাল ছাড়িয়ে রাস্তায় নেমে যায় ভিড়। কাউকে ডেকে আনতে হয় না। সেখানে পরিস্থিতি সম্পর্কে কৃষকদের বলেন মোর্চার নেতারা। সেখানে তর্জনী মূলত ওঠে দিল্লির দিকে। ডিজ়েলের মূল্যবৃদ্ধির দিকে। ‘‘ডিজ়েলের দাম বাড়ায় ট্র্যাক্টরের ভাড়াও বেড়েছে আড়াই গুণ। এখন ঘণ্টায় চোদ্দশো টাকা নেয়,’’ বলছেন নবীন শিখ, জগজিৎ সিংহ ডালেওয়াল। আরও বলেন, ‘‘ডাই আর ইউরিয়ার দাম গত তিন বছরে বেড়েছে তিন গুণ। বিজলির দাম বেড়েছে। কৃষিমজুর আগে নিতেন ঘণ্টায় তিনশো টাকা, এখন ছ’শোর নীচে পাওয়াই যাবে না। ফসল কাটার মেশিনের ভাড়া ছিল ঘণ্টায় পাঁচশো, এখন হয়েছে হাজার। এই কথাগুলো দিল্লিতে গিয়ে বলতে পারব না কেন?’’

উত্তর যে পাওয়া যাবে না সেটা বুঝেই, ভোটের বাক্সে জবাব দিতে প্রস্তুত হচ্ছে ফসল কাটার মুখে দাঁড়ানো সাঙ্গরুর।

(চলবে)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement