—প্রতীকী ছবি।
ষাট মাস পেরিয়ে গেল, তিনি কি তবে কোনও কথাই রাখেননি?
তোর্সার বাঁধ থেকে নেমে মসজিদপাড়া হয়ে রাস্তাটা ঢুকেছে কোচবিহার শহরে। রাস্তার ধারে বিজেপির দেওয়াল-লিখন, ‘ঘরের ছেলে মিনিস্টার, নিশীথ প্রামাণিক আর এক বার’। বিজেপির প্রথম দফার প্রার্থী তালিকায় ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের ডেপুটির নাম। যাতে তিনি প্রচারের জন্য হাতে আরও সময় পান। প্রধানমন্ত্রী নিজে এসে কোচবিহার রাসমেলার মাঠের সভা থেকে নিশীথের জন্য ভোট চেয়েছেন। বিজেপিরও একাংশের দাবি, নিশীথ অনেকটাই এগিয়ে। কিন্তু সব কি ঠিক আছে? ততটাই কি মসৃণ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর ভোট-পথ?
দলেরই একাংশ বলছে, গত বারে ভোটে দেওয়া অনেক কথাই রাখা হয়নি নিশীথের। তাই লড়াইটা রয়ে গিয়েছে।
২০১৯ সালে তৃণমূল থেকে ‘বহিষ্কৃত’ হওয়ার পরেই বিজেপি প্রার্থী করে নিশীথকে। তখন তৃণমূলের একটি অংশের কাছে, বিশেষ করে যুবদের কাছে নিশীথ প্রবল জনপ্রিয়। একই সঙ্গে, রাজবংশী তরুণ মুখ হওয়ার ফলেও বাড়তি সুবিধা পেয়েছিলেন তিনি। কোচবিহারের লোকজন বলছেন, এ বারে সে সব সুবিধা কম। বিপরীতে তৃণমূলের জগদীশচন্দ্র বসুনিয়াও রাজবংশী মুখ।
গত বার ভোটের আগে নিশীথ একাধিক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। যেমন, কোচবিহারের মহারাজের সেনাবাহিনীর মতো ভারতীয় সেনাতেও ‘নারায়ণী রেজিমেন্ট’ তৈরি করা হবে। সেই প্রতিশ্রুতির শরিক ছিলেন অমিত শাহও। কোচবিহারে চিলা রায় ও ঠাকুর পঞ্চানন বর্মার মূর্তি স্থাপন করা বা রাজবংশী ভাষাকে অষ্টম তফসিলের আওতায় আনা— এই সব নিয়েই কথা দিয়েছিলেন নিশীথ। কিন্তু কোনওটিই পূরণ হয়নি।
রয়েছেন নগেন্দ্র রায়, যিনি অনন্ত মহারাজ নামে পরিচিত। তাঁর বহু দিনের দাবি, কোচবিহারকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করা হোক। অনন্তকে দলের তরফে রাজ্যসভায় পাঠিয়েছে বিজেপি। শোনা যায়, তার পিছনে নিশীথের অবদানও কম ছিল না। কিন্তু ভোট আসতেই অনন্ত কেমন যেন বেসুরো। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে দেখা করে আসার পরে তিনি ‘ক্ষুব্ধ’। বলছেন, শাহ নাকি তাঁকে জানিয়েছেন, কোচবিহার কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হবে না। কোচবিহার উত্তর বিধানসভা এলাকায় অনন্তের বাড়ি। তার থেকে সামান্য দূরে নীলকুঠির বাজারে স্থানীয় যুবক রতন রায় বলেন, ‘‘পাঁচ বছরে কিছুই তো পূরণ হল না। এরা রাজবংশীদের ভোট আশা করেন কী ভাবে!’’
আছে একশো দিনের কাজ, আবাস যোজনার টাকা বন্ধ নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য চাপানউতোরও। ৩১(সি) জাতীয় সড়কের পাশে, বাহান্ন ঘর কলোনির বাসিন্দা শ্রীমতি বিশ্বাস, অঞ্জলি বিশ্বাসেরা বলেন, ‘‘কার সঙ্গে কার বিরোধ, তা বুঝি না। কেউ অন্যায় করলে শাস্তি হোক। কিন্তু আমাদের রুটি-রুজি কেন বন্ধ করে দেওয়া হবে! আমরা কাজ চাই, ঘরও চাই।’’
তা হলে কি তৃণমূলের পালে হাওয়া? গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে রক্তের স্রোত দেখেছিল কোচবিহার। ফলিমারিতে বুথের মধ্যে বিজেপির এক এজেন্টকে বোমা ছুড়ে খুন করা হয়েছিল। ফলিমারির বাসিন্দা দীনেশ বর্মণের কথায়, ‘‘এ বারেও সন্ত্রাসের আবহ। রাত হলেই এলাকায় মোটরবাইক বাহিনীর দাপট। গুলি-বোমার আওয়াজ। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সেই দায় রাজ্যের সরকার এড়াতে পারে কি!’’
রাজ্যে শিক্ষা-দুর্নীতির নজির প্রথম ধরা পরে কোচবিহারেই। যার জেরে, শিক্ষা দফতরের সে সময়ের প্ৰতিমন্ত্রী তথা মেখলিগঞ্জের বিধায়ক পরেশ অধিকারীর মেয়ের চাকরি যায়। যায় পরেশের মন্ত্রিত্বও। পরেশকে ইডি-সিবিআইয়ের জিজ্ঞাসাবাদ, সিবিআইয়ের চার্জশিটে পরেশ ও তাঁর কন্যার নাম— সব মিলে সেই সময়ে প্রশ্নের জবাব দিতে বিস্তর নাজেহাল হয়েছেন স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব। সেই পরিস্থিতি কি বদলে গিয়েছে? পুন্ডিবাড়ির যুবক রুবেল সরকারের হতাশা, ‘‘এমএ পাশ করে আমাকে স্টেশনারি দোকান করতে হচ্ছে। কারণ, লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে চাকরি হচ্ছে রাজ্যে। অত টাকা দেওয়ার ক্ষমতা নেই।’’
একশো দিনের কাজ নিয়েও বহু দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে কোচবিহারের গ্রামে। পারাডুবির এক বাসিন্দার দাবি, ‘‘আমরা একশো দিনের কাজ করেও টাকা পাইনি। আর তৃণমূল নেতাদের ঘরে ঘরে সেই টাকা পৌঁছে গিয়েছে।’’ এর সঙ্গে রয়েছে ঘাসফুলের অন্তর্দ্বন্দ্ব। যা সামলাতে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে কোচবিহারে এসে দলীয় নেতাদের সতর্ক করতে হয়েছে। সেই বৈঠকে তা নিয়ে রাজ্যের উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী উদয়ন গুহের সঙ্গে তাঁর মতানৈক্য হয়েছে বলেও তৃণমূল সূত্রের খবর। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তৃণমূলের জেলা স্তরের এক নেতা এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘দলের দ্বন্দ্ব কিছুতেই মিটছে না। যিনি যত পেয়েছেন, তিনি তত বেশি চাইছেন।’’
কোচবিহার লোকসভা কেন্দ্রে যে সাতটি বিধানসভা আসন আছে, সেগুলির মধ্যে কোচবিহার উত্তর, কোচবিহার দক্ষিণ, নাটাবাড়ি, মাথাভাঙা, শীতলখুচি বিজেপির দখলে। দিনহাটা ও সিতাই তৃণমূলের হাতে। জেলায় পঞ্চায়েতের তিন স্তরে তৃণমূলই সংখ্যাগরিষ্ঠ। তবে লোকসভা ভোট বলে কথা। আলাদা করে প্রার্থী দিয়েছে ফরওয়ার্ড ব্লক ও কংগ্রেস। ফ ব-র নীতীশচন্দ্র রায় এবং কংগ্রেসের পিয়া রায়চৌধুরীর দাবি, লোকসভা আসনের লড়াইয়ে তাঁরা পুরোদস্তুর আছেন। কিন্তু দুই দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা এতটাই যে, তাঁরা আদৌ কতটা লড়াই দিতে পারবেন, তা নিয়ে জেলা রাজনীতির পর্যবেক্ষকেরা সন্দিহান। তাঁদের হিসাবে, মূল লড়াই হচ্ছে বিজেপি এবং তৃণমূলের মধ্যেই।
‘লড়াই’। শব্দটা শুনেই চমকে ওঠেন দিনহাটা শহরের সেই বৃদ্ধ, যিনি দিন কয়েক আগে কেন্দ্রের মন্ত্রী এবং রাজ্যের মন্ত্রীকে একে অন্যের দিকে তেড়ে যেতে দেখেছেন। বলেন, ‘‘নিরাপত্তা রক্ষীরা না হলে হয়তো রক্তারক্তি হয়ে যেত!’’
নিশীথের কথায়, ‘‘জয় নিশ্চিত। আমি গোল্ড মেডেল নিয়ে ভাবছি।’’ জগদীশ বলেন, ‘‘এ বার তৃণমূলকে কেউ হারাতে পারবে না।’’