—প্রতীকী চিত্র।
মালদহ-রতুয়া রাজ্য সড়ক ধরে যাওয়া গাড়ির পিছু ধাওয়া করে ধুলোর কুণ্ডলী তখন থিতু হচ্ছে পথের পাশে গাছের পাতায়। কাঁধের গামছা দিয়ে মুখ মুছে রতুয়ার পরানপুর কালীতলায় বসে এক সংখ্যালঘু যুবক বললেন, ‘‘লক্ষ্মীর ভান্ডারের দয়ায় ঘরে তো দু’পয়সা বাড়তি আসছে। কেন তৃণমূলকে ভোট দেবে না মেয়ে-বউরা!’’ পাশ থেকে শেখ লালনের পাল্টা, ‘‘আমার মা-কে প্রশ্নটা কোরো, ভাল উত্তর পেয়ে যাবে। ভূগোল নিয়ে এমএ পাশ করে এখন গাড়ি চালাই, বুঝলে।’’
রতুয়া থেকে গাজল কিংবা হরিশ্চন্দ্রপুর থেকে চাঁচল— নানা প্রশ্নে সংখ্যালঘু ভোটারদের মধ্যে মতের ভিন্নতা চোখে পড়ার মতো। মালদহ উত্তরের বিজেপি প্রার্থী খগেন মুর্মু সবই দেখছেন এবং মুচকি হাসছেন। কংগ্রেস এবং তৃণমূল পাল্টা যুক্তি খাড়া করে বলছে, অচিরেই হাসি মিলিয়ে যাবে!
মালদহ উত্তর কেন্দ্রে এ বার ভোটযুদ্ধে প্রধান দুই প্রতিপক্ষ কারা, সেই প্রশ্নেও ধন্দ রয়েছে। অনেকের মতে, লড়াই খগেনের সঙ্গে কংগ্রেসের মোস্তাক আলমের। অনেকের ধারণা, লড়াইটা খগেনের সঙ্গে সদ্যপ্রাক্তন পুলিশকর্তা, তৃণমূলের প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের। কেউ কেউ মনে করছেন, এই কেন্দ্রে সংখ্যালঘু প্রার্থী এক জন, তাই সংখ্যালঘু ভোট ভাগাভাগিও কম হতে পারে। গত বার এই কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী মৌসম নুর চার লক্ষ ২৫ হাজার এবং কংগ্রেসের ইশা খান চৌধুরী তিন লক্ষের বেশি ভোট পেয়েছিলেন। ভোট-কাটাকাটির ফায়দা তুলেছিল গেরুয়া শিবির। পাঁচ লক্ষের কিছু বেশি ভোট পেয়ে ৮৪ হাজার ভোটে জিতেছিলেন খগেন। গত বিধানসভা নির্বাচনে জাতীয় নাগরিকপুঞ্জি এবং সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বিতর্ক ঘিরে তৈরি হওয়া মেরুকরণের হাওয়ায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল বাম-কংগ্রেস। এ বার জোটপ্রার্থী মোস্তাক বদলে দিতে পারেন সমীকরণ, এমন আশঙ্কাও রয়েছে শাসক শিবিরে।
গত পঞ্চায়েত ভোটে জেলায় বাম-কংগ্রেসে সার্বিক ঐক্য হয়নি। তবুও ভোটপ্রাপ্তির নিরিখে জেলায় বিজেপিকে অনেক পিছনে ফেলেছিল জোট। সিপিএম জেলা কমিটির সদস্য শেখ খলিলের সঙ্গে মোস্তাকের ‘মধুর’ সম্পর্কের কথা সুবিদিত। সেই খলিলই এখন বলছেন, ‘‘দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে বৃহত্তর স্বার্থে কংগ্রেসের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ছি।’’ সে কথা স্বীকার করছেন মোস্তাকও।
হবিবপুরের বুলবুলচণ্ডী বাসস্ট্যান্ডে বাম-কংগ্রেসের মিছিলে মোস্তাকের পাশে দাঁড়িয়ে সিপিএম নেতা প্রণব ভট্টাচার্যের হুঙ্কার, ‘‘এক ভোটে হলেও হারাব খগেনকে।’’ কংগ্রেসের সমাজমাধ্যম শাখার নেতা রাজা ভট্টাচার্য অঙ্ক কষে বলছেন, ‘‘লুটের পঞ্চায়েত ভোটেও বাম-কংগ্রেস মালদহ উত্তর লোকসভা এলাকায় সাড়ে চার লক্ষ ভোট পেয়েছে। মনে রাখবেন, এ বার এই কেন্দ্রে এক জনই সংখ্যালঘু প্রার্থী।’’ মোস্তাক বলছেন, ‘‘পরিযায়ী শ্রমিকের তথ্যে কারচুপি করেছিল প্রশাসন। আমরা প্রকৃত চিত্র তুলে ধরছি। বিড়ি শ্রমিকদের দুরবস্থার কথাও বলছি।’’ সিপিএমেরই অন্য এক জেলা নেতা অবশ্য বলছেন, ‘‘গাজল, হবিবপুর ও মালদহে বিজেপির সঙ্গে লড়াই হচ্ছে তৃণমূলের। বাকি চার বিধানসভায় বিজেপির প্রধান প্রতিপক্ষ জোট। ফলে ভোট কাটাকাটির আশঙ্কা থাকছেই।’’ কংগ্রেসের এক নেতার কথায়, ‘‘মালতীপুর, চাঁচল ও হরিশ্চন্দ্রপুরে এগিয়ে থাকব। রতুয়ায় টক্কর হবে। হবিবপুরে বিজেপির সঙ্গে ব্যবধান কমবে।’’
গাজল বাসস্টপ দিয়ে রামনবমীর মিছিলটা সবেমাত্র গিয়েছে। ভোটের প্রসঙ্গ উস্কে দিতেই তর্কে জড়ালেন দুই ভ্যানচালক। তুলসীডাঙার ভ্যানচালকের মন্তব্য, ‘‘রাজ্যে উন্নয়ন হয়েছে। তবে হাওয়া মোদীর দিকেই।’’ সরকারপাড়ার ভ্যানচালকের পাল্টা, ‘‘তুই কিচ্ছু বুঝিস না। তৃণমূল অনেক এগিয়ে।’’ কিছুটা দূরে আখের রস বিক্রি করছিলেন এক দম্পতি। মহিলার কথায়, ‘‘লক্ষ্মীর ভান্ডার পেয়েছি। সংসারে অভাব কিছুটা হলেও কমেছে।’’ তাঁর স্বামী বলছেন, ‘‘...তবে এত লুটতরাজ, দুর্নীতি কি সহ্য করা যায়!’’ চাঁচল বাসস্টপে দাঁড়িয়ে আজিজ আলির সাফ কথা, ‘‘লড়াইটা চলছে তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপির। মনে হচ্ছে তৃণমূলই এগিয়ে।’’ পাশে এক চা বিক্রেতার মন্তব্য, ‘‘বোঝা যাচ্ছে না, হাওয়া কোন দিকে। তবে তৃণমূলের প্রভাব কমেছে।’’ গাজল বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে দোগাছি গ্রামের দুই মহিলা বলেন, ‘‘রাস্তা না হওয়ায় পঞ্চায়েত ভোট বয়কট করেছিলাম। ভোট মেটার পরেই রাস্তা তৈরির জিনিসপত্র পড়েছে। আমরা খুশি।’’
হবিবপুরে বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা কলাইবাড়ি এলাকায় বাস মূলত নমশূদ্র ও মতুয়াদের। কিছু দিন আগেও সেখানে তৃণমূলের দাপট ছিল। গত কয়েক মাসে চিত্র বদলেছে। গ্রামের অনেকে বলছেন, ‘‘এখানে ৭০% লোক এখন বিজেপি।’’
ঘুরতে ঘুরতে মনে হয়েছে, এনআরসি, সিএএ নিয়ে ভয় অনেকটাই কেটেছে। আলোচনায় আগ্রহ কম। শিক্ষক নিয়োগ বা রেশনে দুর্নীতি নিয়ে রাজ্য রাজনীতি তপ্ত হলেও এখানে তার প্রভাব তেমন একটা নেই। তবে পঞ্চায়েতে ‘দুর্নীতি’ হয়েছে বলে অভিযোগ শোনা গিয়েছে।
ফল নিয়ে সব শিবির ‘আত্মবিশ্বাসী’। যদিও ঘরোয়া আলোচনায় অস্বস্তিও প্রকাশ পাচ্ছে। বিজেপির অন্দরমহলের খবর, প্রতিটি বিধানসভা এলাকায় বেশ কিছু ‘অভিমানী’ নেতা রয়েছেন। অনেক চেষ্টাতেও তাঁদের মন গলছে না। সাংসদ হিসেবে খগেনের কাজেও সন্তুষ্ট নয় দলের একাংশ। সংখ্যালঘু প্রধান অনেক এলাকায় বুথ কমিটিই গড়া যায়নি। যদিও খগেনের দাবি, ‘‘সংগঠনে সমস্যা নেই। কাজ আর প্রধানমন্ত্রীকে দেখে মানুষ ভোট দেবেন।’’
খগেনকে ‘অ্যাক্সিডেন্টাল এমপি’ বলছেন তৃণমূল প্রার্থী প্রসূন। তাঁর কথায়, ‘‘দুর্ঘটনা বারবার ঘটে না।’’ যোগ করছেন, ‘‘গঙ্গাভাঙন নিয়ে কিছুই করতে পারেননি সাংসদ। আমি জিতলে প্রত্যেক বছর ৩১ ডিসেম্বর রিপোর্ট কার্ড পেশ করব।’’ খগেনের পাল্টা, ‘‘যে কাজ করেছি, তা ছাপিয়ে বিলি করা হয়েছে।’’ নদীভাঙন সমস্যা নিয়ে বলেন, ‘‘লিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, গঙ্গা ও ফুলহার নদীর দু’ধারে বাঁধ নির্মাণ করব।’’
তৃণমূলের অন্দরে কান পাতলে শোনা গিয়েছে, এই কেন্দ্রে টিকিট প্রত্যাশী ছিলেন জেলা সভাপতি রহিম বক্সী। না পেয়ে কিছুটা ‘হতাশ’ তিনি। যদিও রহিমের দাবি, ‘‘এমন কোনও কথা আমার জানা নেই। একশো শতাংশ যোগ্য লোক প্রার্থী হয়েছেন।’’ এ-ও শোনা গিয়েছে, প্রার্থী নাকি এখনও তৃণমূল কর্মী হয়ে উঠতে পারেননি। আচরণ সেই ‘পুলিশকর্তার’ মতোই। প্রসূনের বক্তব্য, ‘‘রোজই কর্মীদের সঙ্গে কথা হচ্ছে। আগে এই জেলায় কাজ করার সুবাদে অনেকেই চেনা।’’
কংগ্রেসের একটি সূত্রে দাবি, অনেকেই এই আসনে প্রার্থী হিসেবে চেয়েছিলেন প্রাক্তন এক বিধায়ককে। মোস্তাককে প্রার্থী করায় তাঁর অনুগামীরা ময়দানে নামেননি প্রথম দিকে। এখন তাঁদের প্রচারে দেখা যাচ্ছে।