—প্রতীকী ছবি।
ফোন করতেই কবীরশঙ্কর বসু বললেন, “আগামিকাল চাঁপদানিতে বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ চলে আসুন। ওখানে প্রেস কনফারেন্স করব। এখানকার তৃণমূল প্রার্থীর বিষয়ে কিছু বলার আছে।” ওই সাংবাদিক বৈঠকে না থাকতে পারলেও বেলা গড়িয়ে যখন তাঁর ডানকুনির বর্তমান আস্তানায় দেখা হল, শ্রীরামপুর লোকসভা কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী শুরুই করলেন একই বিষয় দিয়ে— “এখানকার তৃণমূল প্রার্থী আমায় ব্যক্তিগত আক্রমণ শুরু করেছেন। আমার মৃত বাবাকেও ছাড়ছেন না। শ্রীরামপুরের মানুষ এই অপমানের জবাব ইভিএমে দেবে।”
গত বিধানসভা নির্বাচনেও শ্রীরামপুর কেন্দ্র থেকে কবীর বিজেপির হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। অবশ্য তৃণমূল প্রার্থী সুদীপ্ত রায়ের কাছে ২৩ হাজারের কিছু বেশি ভোটে হেরেছিলেন ‘লিঙ্কন’স ইন’-এর বার-অ্যাট-’ল।
এই কেন্দ্রের তিন বারের সাংসদ তৃণমূল প্রার্থী আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে কবীরের অভিযোগ নিয়ে বলা মাত্রই তাঁর উত্তর, “কে চেনে ওকে! আমার পরিচয়েই তো শ্রীরামপুরে ওর পরিচয়। ওর বাবাকেও কি কেউ চেনে এখানে?”
সম্পর্কে প্রাক্তন শ্বশুর-জামাই। ভোটের ময়দানে বিভিন্ন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক আলোচনার পাশাপাশি দু’জনের এই যুযুধান অবস্থা এখন শ্রীরামপুর কেন্দ্রের আলোচ্য বিষয়। কল্যাণ শুধু কবীরশঙ্করে থেমে নেই। এর মধ্যে উত্তরপাড়া বিধানসভা কেন্দ্রে নিজের দলের বিধায়ক অভিনেতা কাঞ্চন মল্লিককে প্রচার গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়েছেন। যুক্তি, গ্রামাঞ্চলে মহিলারা কাঞ্চনকে দেখলে ‘রিঅ্যাক্ট’ করছেন। নিজের দলেই অনেকে কল্যাণের ব্যবহারে ক্ষুব্ধ। আর কল্যাণের উত্তর, “আমি এমনই। আমাকে শ্রীরামপুর কেন্দ্রের ভোটাররা এই ভাবেই চেনেন। এ বারেও তাঁরা আমায় ভোট দেবেন। জেতার মার্জিন দেড় লক্ষের বেশি তো হবেই! মমতাদি একটা মিটিং করে দেবে। ব্যস।” কারণ? কল্যাণের বক্তব্য, “কারণ এ রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই মানুষ একমাত্র ভরসা করে।” আর দলের সেনাপতি? কল্যাণের উত্তর, “উনি আসতে চাইলে আসবেন।”
তৃণমূলের অন্দরের খবর, ‘সেনাপতি’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় কল্যাণকে এ বার টিকিট দিতে আগ্রহী ছিলেন না। চেয়েছিলেন নতুন কোনও মুখ। তবে মমতার উদ্যোগে এ বারও টিকিট পেয়েছেন কল্যাণই। গত বার এই কেন্দ্র থেকে ছ’লক্ষেরও বেশি ভোট পেয়ে বিজেপির প্রার্থীকে প্রায় এক লক্ষ ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে লোকসভায় গিয়েছিলেন কল্যাণ।
সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র নিয়ে শ্রীরামপুর লোকসভা কেন্দ্র। উত্তরপাড়া, জগৎবল্লভপুর, ডোমজুড়, শ্রীরামপুর, চাঁপদানি, চণ্ডীতলা, জাঙ্গিপাড়া। এই মুহূর্তে এই সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রেই রয়েছেন তৃণমূল বিধায়ক। এ বারে কল্যাণের মূল বিরোধী দু’জনই তুলনামূলক তরুণ। বিজেপির কবীরশঙ্কর এবং বাম ও কংগ্রেস জোটের প্রার্থী সিপিএমের দীপ্সিতা ধর। কবীরের দাবি, “তরুণদের মধ্যে খুব সাড়া পাচ্ছি। ওরা তো বলেই দিচ্ছে, এ বার দাদাকে ভোট দেব। দাদুকে নয়।”
অভিজ্ঞজনের বক্তব্য, শ্রীরামপুর কেন্দ্রে বিজেপির সংগঠন তেমন নেই। তবে কালে কালে ভোট বেড়েছে অনেকটাই। অন্য দিকে, সিপিএমের সংগঠন ভাল। গত লোকসভা ভোটে সিপিএম প্রার্থীর অবশ্য ভোট সংখ্যা দু’লক্ষ ছাড়ায়নি। এর সঙ্গে ছিল কংগ্রেসের দেওয়া প্রার্থী।
উত্তরপাড়ার একদা সিপিএমের বিধায়ক শ্রুতিনাথ প্রহরাজের অবশ্য দাবি, এ বারের লড়াই একেবারে সমানে-সমানে। দীপ্সিতা প্রচারও চালাচ্ছেন দুর্বার বেগে। ডোমজুড় বিধানসভা কেন্দ্র থেকে একদা তাঁর দাদু পদ্মনিধি ধর সিপিএমের টিকিটে জিতে তিন বার বিধায়ক হয়েছিলেন। বর্তমানে এসএফআইয়ের সর্বভারতীয় যুগ্ম সম্পাদক দীপ্সিতা জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করছেন। নৈটি অঞ্চলে প্রচার চালিয়ে দুপুরের মুখে স্থানীয় কমরেডের বাড়িতে জিরিয়ে নিতে নিতে বললেন, “এই নির্বাচনে আমাদের লড়াইটা রুটি-রুজির লড়াই। রাজ্যে চাকরি চুরি হচ্ছে। শ্রীরামপুর অঞ্চলের কারখানা একের পর এক সব বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যুব সমাজ করবে কী?” সন্দেশখালি কাণ্ড এবং সেই কাণ্ড নিয়ে প্রকাশিত ভিডিয়োর বিষয়ে দীপ্সিতার বক্তব্য, সিবিআই যা তদন্ত করছে, ভিডিয়ো এনে পরিস্থিতির কিছুই বদল করতে পারবে না তৃণমূল। অন্য দিকে, কল্যাণ উচ্ছ্বসিত। বললেন, “আগেই আমরা বলেছি, এই সব অভিযোগের কোনও সারবত্তা নেই।” কল্যাণ আক্রমণ করছেন দীপ্সিতাকেও। তাঁর কথায়, “কমরেড জেএনইউ আমায় প্রথমে আক্রমণ করেছেন। মিস্টার ইন্ডিয়া বলেছেন। তাই আমি মিস ইউনিভার্স বলেছি।”
কল্যাণের ব্যবহার এবং শব্দ প্রয়োগের পাশাপাশি উঠে আসছে সাংসদ হিসাবে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগও। তিনি কলকাতা থেকে নির্বাচনী কেন্দ্রে আসেন না— এমন অভিযোগ এই কেন্দ্রের একাধিক মানুষের। কল্যাণের অবশ্য বক্তব্য, এই সব বিজেপি, সিপিএমের অপপ্রচার। সপ্তাহের শনি, রবিবার তিনি নিয়ম করে শ্রীরামপুরে আসেন। কার্যালয়ে বসে মানুষের অভাব-অভিযোগ শোনেন। ২০০৯ থেকে কী করেছেন, তার তালিকাও দিলেন। এখনও তাঁর ইচ্ছে, এ বারে জিতলে ২০০ বছরের পুরোনো শ্রীরামপুর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করতে মুখ্যমন্ত্রীকে আর্জি জানাবেন। কেন্দ্রে ইন্ডিয়া জোট ক্ষমতায় এলে শ্রীরামপুর কেন্দ্রের মধ্যে একটি মেডিক্যাল কলেজের জন্য চেষ্টা করবেন।
আর দীপ্সিতা, কবীর— দু’জনেরই বক্তব্য: শ্রীরামপুর কেন্দ্রে যা শিল্প-কারখানা ছিল, একের পর এক বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ডাকব্যাক বন্ধ। হিন্দুস্থান মোটরস-এর কারখানা বন্ধ। ডানকুনি কোল কমপ্লেক্স বন্ধ। এ সব আটকাতে কল্যাণ উদ্যোগী নন। কল্যাণের যুক্তি, বেশিরভাগ কল-কারখানা বন্ধ হয়েছে ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট শাসনে। ডানকুনি কোল কমপ্লেক্স তো কেন্দ্রীয় সরকারের। তারা উদ্যোগী হয়নি। কবীর জানালেন, যে সব কারখানা এখনও আছে, সেখানকার কর্মীদের জীবনযাত্রা অসহনীয়। জিতে এসে তিনি তাঁদের জীবনযাত্রা বদলানোর অবশ্যই চেষ্টা করবেন।
দীপ্সিতার দাবি, এ বারে সিপিএমের দিকেই ভোটের ঢল নামবে। তবে ভোটের প্রার্থী নিয়ে আইএসএফ এবং বামফ্রন্টের মধ্যে চাপানউতোর চলেছিল। আইএসএফ চেয়েছিল, শ্রীরামপুর কেন্দ্রটি তাদের ছেড়ে দেওয়া হোক। শেষ পর্যন্ত আলাদা লড়ছে নওসাদ সিদ্দিকীর দল। এর জন্য ভোট কমবে, এটা দীপ্সিতা মানছেন না। তাঁর যুক্তি, যাঁরা ভুল করে আগের বার বিজেপির দিকে চলে গিয়েছেন, তাঁরাও ফিরছেন। সঙ্গে তফসিলি জাতি, জনজাতির ভোট তাঁদের দিকে আসছে। কল্যাণের পাল্টা দাবি, তফসিলি জাতি, জনজাতির ভোট তৃণমূলের দিকেই আসছে।
বাকিটা? জনগণের হাতে।