Lok Sabha Election 2024

গ্যারান্টির দামামায় আস্থা কই, মরাঠি অস্মিতাও যে আহত

মূল্যবৃদ্ধি এবং বেকারত্বের থাবায় আপাতত সব সঙ্গীতই থেমে গিয়েছে, দামামা বাজানো ‘গ্যারান্টি’ তাদের আর বাঁচাতে পারবে বলে মনে করছে না মহল্লা।

Advertisement

অগ্নি রায়

মুম্বই শেষ আপডেট: ১৩ মে ২০২৪ ০৮:৩৯
Share:

—প্রতীকী ছবি।

খেজুরের পর্বত কন্দরে ভোঁ ভোঁ করছে নীল মাছি। পর্বতের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় দেওয়ালে ঝুলছে জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী, ফারুক আবদুল্লার ঝাপসা হয়ে আসা ছবি। দোকান বেড় দেওয়া মোটা ক্যানভাসের চাদর, বাইরের গনগনে রোদ্দুরের আঁচ আটকাতে পারছে কই!

Advertisement

বরফ ঠাসা দইয়ের ছাঁচ এসেছে আতিথেয়তায়। ‘‘এই দোকান স্বাধীনতারও আগের, মহল্লার অন্যতম পুরনো দোকান। অনেক প্রধানমন্ত্রী নেতা বক্তৃতা-ফেরত ঘুরে গিয়েছেন এখানে।’’ এ কথা বলতে গেলে যে ছটাক গর্ব বা প্রসন্নতা থাকতে হয়, আজ তার ধারেকাছেও নেই প্রবীণ আনওয়ার কুশেরির কণ্ঠে। উত্তরাধিকার সূত্রে দক্ষিণ মুম্বই নির্বাচনী ক্ষেত্রের সুপ্রাচীন ভেন্ডিবাজারের পশ্চিম কোণে এই ‘গাজি খেজুর সেন্টার’-এর মালিক তিনি। দোকানের পাশেই বিস্তীর্ণ চাতাল ও মঞ্চ, এখন আবর্জনা দখল নিয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে বড় বা ছোট নেতাদের পদার্পণ বিশেষ ঘটে না, এই মুসলিম প্রধান ঘিঞ্জি ভেন্ডিবাজারে।

একে ঠা ঠা দুপুর, তায় সপ্তাহের মাঝখানে— তাই কি ক্রেতার থেকে বেশি দেখাচ্ছে বিক্রেতা এবং ছোট-বড় দোকানের সংখ্যা? আনওয়ারের মতো গোটা বাজারটাই যেন টুল পেতে হাপিত্যেশ করে ঢুলছে লাগসই খদ্দের ধরতে না পেরে। ‘‘কোভিডের আগে থেকেই কাম-ধান্দায় মন্দা আসতে শুরু করে। বলতে পারেন নোট বাতিলের পরই। তার পর তো করোনার সময়ে ব্যবসা চালাতে শেঠরা ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে গলা পর্যন্ত ডুবে গেল। দোকানে বা নিজের অন্য ব্যবসায় বাড়তি লোক রাখবে কী করে? হাজারে হাজারে বেকার হতে শুরু করল। এই ভেন্ডিবাজারেই দশ বছর আগে এলে ভিতর দিয়ে হাঁটতে সমস্যা হত না। কিন্তু এখন নিজেই তো দেখছেন, যে যেখানে পাচ্ছে মাটিতে কিছু না কিছু নিয়ে বসে যাচ্ছে।’’

Advertisement

কথাটা সত্যি। দু’ডজন কলা, কিছু দোমড়ানো মোচড়ানো কামিজ, পঞ্চাশ প্যাকেট ন্যাপথালিনের মতো পণ্য একটি পাত্রে নিয়ে যত্রতত্র বসে পড়েছেন মানুষ। যাঁরা কয়েক বছর আগে নির্দিষ্ট বেতনের বিনিময়ে চাকরি করতেন। ফলে স্থান সংকুলান নেই, প্রায় দমবন্ধ অবস্থা।

‘‘গত কয়েক বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতায় আমাদের মতো সাধারণ মানুষের দিকে নজরই ছিল না কারও। তবুও বলব উদ্ধব ঠাকরে মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বলে কোভিডের দু’বছর আমরা বেঁচেবর্তে ছিলাম। আর সেই কৃতজ্ঞতা থেকেই আগাড়ির প্রার্থী অরবিন্দ সাওয়ন্তকে এ বার ভোট দেবে আমাদের গোটা মহল্লা’’, বলছেন নিকটবর্তী সালওয়ার স্যুটের দোকানি সুনীল গায়কোয়াড়। শুধু তিনিই নন, দক্ষিণ মুম্বইয়ের এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল সমস্বরে বলছে, লকডাউনের সময়ে, বাড়িতে রেশন পৌঁছনো, বারবার খোঁজ নেওয়া, চিকিৎসায় সাহায্য, হাসপাতালে বে়ডের ব্যবস্থা সবই যন্ত্রের মতো করে গিয়েছেন আদি শিবসৈনিকরা। অরবিন্দ নিজেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন বলে দাবি করছেন কেউ কেউ।

অথচ আজকের এই মুষড়ে পড়া ভেন্ডিবাজারকে বাদ দিয়ে দক্ষিণ মুম্বই তো বটেই, মুম্বইকেই কল্পনা করা যায় না। ব্রিটিশ আমলে এখানে ক্রফোর্ড মার্কেটের দক্ষিণে বসবাস করতেন সাহেবরা। আর অন্য পারে ছিল এই অনাদরে পড়ে থাকা এলাকা, যাকে ‘বিহাইন্ড দ্য বাজার’ উল্লেখ করতেন তাঁরা। সেই শব্দবন্ধ মুখচলতি ভাষায় হয়েছে ‘ভেন্ডিবাজার’। সে সময় থেকেই কাওয়ালি, গজ়ল আর ধ্রুপদী সঙ্গীতে গমগম করত এলাকা। উনিশ শতকের শেষে মোরাদাবাদের কাছে বিজনৌর থেকে এখানে আসেন উস্তাদ দিলওয়ার হুসেন খানের তিন সন্তান। ধ্রুপদী সঙ্গীতের চর্চা করে এক সঙ্গীত ঘরানারই জন্ম দেন তাঁরা এখানে।

মূল্যবৃদ্ধি এবং বেকারত্বের থাবায় আপাতত সব সঙ্গীতই থেমে গিয়েছে, দামামা বাজানো ‘গ্যারান্টি’ তাদের আর বাঁচাতে পারবে বলে মনে করছে না মহল্লা। মহারাষ্ট্রের সমাজ-অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ এবং লেখক দিনেশ সাধের কথায়, ‘‘কোভিডের পরেও এক বছর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলেছে কাজ-কারবার। ডাল-রুটি খেয়ে, লোকে মাইনে কম নিয়েও কাজে গিয়েছে। তার পর গতিক সুবিধার নয় দেখে, সমস্ত ছোট বড় শিল্প উদ্যোগ, কারখানার মালিকরা তাঁদের টাকা তুলে শেয়ার বাজারে ঢেলে দিয়েছেন। হীরক রফতানিকারীরা দেখেছেন ব্যবসা পড়ে আসছে, মূলধন তুলে ঢেলেছেন শেয়ারে। এতে এক দিকে বহু কর্মী কাজ হারিয়েছেন, অন্য দিকে শেয়ার বাজারে কৃত্রিম বেলুন তৈরি হয়েছে। তাকে তেজিয়ান দেখাচ্ছে। সেটাকেই মোদী স্থিতিশীল সরকারের প্রতীক হিসাবে তুলে ধরে মানুষকে বোকা বানাচ্ছেন।’’ তাঁর দাবি, হিরের বাণিজ্য একনাথ শিন্দের জমানায় মহারাষ্ট্র থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে গুজরাতের দিকে চলে গিয়েছে, পথে বসেছেন শ্রমিকরা।

মুম্বইয়ের সবচেয়ে পুরনো বস্ত্র বাজার হিন্দমাতা দাদার মার্কেটেও ছবিটা উনিশ-বিশ। ‘‘রীতিমতো লেখাপড়া করা লোক বেকার ঘুরে বেড়াচ্ছে দাদা। শুধুমাত্র আইটি সেক্টরে যা চাকরির সুযোগ। আমরা তো স্লোগান তুলছি আগাড়ির হয়ে, অব কি বার তরি পার! বিজেপি মহারাষ্ট্রের সব ব্যবসায় আরও বেশি করে গুজরাতি ঢোকানোর চেষ্টা করে গিয়েছে, শিন্দে এসে তাদের সেই সুবিধা করে দিয়েছেন’’, জানাচ্ছেন স্থানীয় বস্ত্র ব্যবসায়ী কিশোরা আকোলকর।

এটা ঘটনা যে মুম্বইয়ের পাবে, কফিশপে বা অভিজাত মহল্লায় বিষয়টি তেমন শোনা না গেলেও ফুটপাথে, বস্তিতে, বাজার-মহল্লায় গুজরাতি-মরাঠা দ্বন্দ্বের আঁচ ভোটের বাজারে খুবই চড়া। উদ্ধব-পুত্র আদিত্য ঠাকরে প্রতিটি জনসভায় বিজেপিকে নিশানা করে বলছেন, ‘‘গত দু’বছরে সুপরিকল্পিত ভাবে এখানকার সব শিল্পে, কারখানায়, উদ্যোগে গুজরাতিদের ঢোকার সুবিধা করে দেওয়া হচ্ছে। এখানকার অনেক শিল্প গুজরাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বিজেপির দালালি করতে চাওয়া শিন্দে মরাঠি অস্মিতার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে এখানকার যুবশক্তির ভবিষ্যতের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে সেই কাজে সাহায্য করেছেন।’’ সম্প্রতি ঘাটকোপাের এক গুজরাতি আবাসনে উদ্ধবপন্থী নেতাদের প্রচারপত্র নিয়ে ঢুকতে না-দেওয়া নিয়ে সংঘাত চরম পর্যায়ে পৌঁছয়। বিষয়টি শেষ পর্যন্ত শিবসেনা বনাম বিজেপির আধিপত্যের লড়াইয়ে সংযুক্ত হয়ে গিয়েছে।

এ বারের নির্বাচনে পুলওয়ামা নেই। পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের জিগিরে জাতীয়তাবাদের প্রবল তরঙ্গ নেই। ভোটের ফলাফল যাই হোক না কেন খেটে খাওয়া মানুষের বিচারে— চব্বিশের ভোটের মূল বিষয়, মূল্যবৃদ্ধি এবং বেকারি। আরব সাগরতীরের তরঙ্গাভিঘাত সে কথাই বলছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement