Lok Sabha Election 2024

ছুটছেন মাধবীলতা, ওয়েইসি মাটি কামড়ে হায়দরাবাদেই

চারমিনারের মূল প্রবেশপথের গা ঘেঁষে ভাগ্যলক্ষ্মী মন্দির। এই মন্দিরেই মাথা ঠুকে প্রচার শুরু করেছিলেন মাধবীলতা। স্ত্রী-কে নিয়ে পুজো দিতে এসেছিলেন গঙ্গাধর রেড্ডি।

Advertisement

অনমিত্র সেনগুপ্ত

হায়দরাবাদ শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০২৪ ০৮:৪২
Share:

আসাদুদ্দিন ওয়েইসি। —ফাইল চিত্র।

প্রচারে নেমে তির ছুড়ে চলেছেন মাধবীলতা। যত্র তত্র। লক্ষ্য আসাদুদ্দিন ওয়েইসি। কিন্তু হায়দরাবাদের বুকে দাঁড়িয়ে এমআইএম নেতা ‘ওয়েইসি বধ’ কি আদৌ সম্ভব? না কি ডেভিড আর গোলিয়াথের মতো এক অসম লড়াইয়ে নেমেছেন বিজেপি প্রার্থী মাধবীলতা? ৪৯ বছরের মহিলা নেত্রী, যাঁকে নিয়ে এই মুহূর্তে উত্তাল নিজ়ামের শহরের সনাতন সমাজ।

Advertisement

চারমিনারে এক সন্ধ্যা। গোটা হায়দরাবাদ যেন উঠে এসেছে চারমিনার চত্বরে। গিজগিজ করছে ভিড়। সারা দিনের ভ্যাপসা গরম অনেকটাই কেটে গিয়ে, হুসেন সাগরের হালকা ভেজা হাওয়া হাত বুলিয়ে দিচ্ছে চারমিনারের দেওয়ালগুলোয়। মূল প্রবেশদ্বারের সামনেই পানের গুমটি মনসুরের। তাঁর মতে, হায়দরাবাদের মাটিতে ওয়েইসিকে হারানো কার্যত অসম্ভব। তাঁর কথায় ‘‘কোনও প্রশ্ন নেই। হায়দরাবাদ লোকসভার অন্তর্গত সাতটি বিধানসভার প্রত্যেকটিতে এমআইএম-এর বিধায়ক। এর পরে কোনও লড়াই হয় না।’’

চারমিনারের মূল প্রবেশপথের গা ঘেঁষে ভাগ্যলক্ষ্মী মন্দির। এই মন্দিরেই মাথা ঠুকে প্রচার শুরু করেছিলেন মাধবীলতা। স্ত্রী-কে নিয়ে পুজো দিতে এসেছিলেন গঙ্গাধর রেড্ডি। পেশায় ব্যবসায়ী। মাধবীলতা যে ভাবে এ বারে আসাদুদ্দিনকে দৌড় করাচ্ছেন তাতেই খুশি তিনি। মন্দিরে পুজো সেরে বেরিয়ে বললেন, ‘‘আগে তো একতরফা ভোট হত। হায়দরাবাদ থেকে কোনও বিজেপি প্রার্থী যে লড়ছেন, তা বোঝাই যেত না। এ বার তো পরিস্থিতি আলাদা। গোটা হিন্দু সমাজ মাধবীলতার পিছনে রয়েছে।’’

Advertisement

স্থানীয় সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ভীষণ ভাবে চাইছেন হায়দরবাদে ক্ষমতার পরিবর্তন। মাধবীলতা যেখানে যাচ্ছেন সেখানেই প্রবল ভিড় করে তাঁকে দেখতে আসছেন মহিলারা। প্রচারে নেমে দূরত্বের সব আগল ভেঙে পরিচিত-অপরিচিত সকলের বাড়িতে ঢুকে পড়ছেন মাধবীলতা। বাদ যাচ্ছে না সংখ্যালঘুদের ঘরগুলিও। সেখানেও পৌঁছতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা করছেন না তিনি। বোঝাচ্ছেন, বিজেপি মানেই মুসলিম-বিরোধী হতে হবে এমনটা আদৌ নয়। মহিলা হয়ে তিনি যে আসাদুদ্দিনকে লড়াইয়ে ফেলে দিয়েছেন, তা স্পষ্ট খোদ এমআইএম প্রধানের গতিবিধিতেই। মাধবীলতার মুহুর্মুহু আক্রমণ ঠেকাতে হায়দরাবাদের বাইরে কার্যত যেতে পারেননি ওয়েইসি। মাটি কামড়ে পড়ে রয়েছেন নিজের কেন্দ্রেই।

হায়দরাবাদ লোকসভার সাতটি বিধানসভার মোট আঠাশ কিলোমিটার এলাকায় হিন্দুরা সংখ্যালঘু। ষাট শতাংশ মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে লড়ে হায়দরাবাদ কেন্দ্রে যে জেতা সম্ভব না, তা মেনে নিচ্ছেন খৈয়রতাবাদের বিজেপি দফতরে বসে থাকা শরদ রাও। তাঁর মতে, ‘‘জেতা কঠিন। কিন্তু মাধবীলতা প্রার্থী হওয়ায় এখানকার হিন্দু সমাজ একজোট হওয়ার বার্তা দিচ্ছে। এতে শুধু হায়দরাবাদে নয়, গোটা রাজ্যেই সুফল পাওয়া যাবে বলেই মনে করা হচ্ছে। বিশেষ করে মহিলা সমাজে ভীষণ ভাবে সাড়া পাওয়া যাচ্ছে।’’ এমআইএম নেতৃত্বও মনে করছেন, গত বার তিন লক্ষ ভোটে ভগবত রাও-কে হারালেও, এ যাত্রায় মাধবীলতা সে ব্যবধান কমাবেন নিশ্চিত ভাবেই।

তবে সামগ্রিক ভাবে জেতা নিয়ে দ্বিধা নেই আসাদুদ্দিন ওয়েইসির। ১৯৮৪ সাল থেকে এই আসনে জিতে এসেছে ওয়েইসি পরিবার। প্রথমে পিতা সালাউদ্দিন ওয়েইসি, ২০০৪ সাল থেকে আসাদুদ্দিন হায়দরাবাদ কেন্দ্রের ‘একচ্ছত্র বাদশা’। কিন্তু ওয়েইসি পরিবার চল্লিশ বছর ধরে হায়দরাবাদ থেকে জিতে আসা সত্ত্বেও পুরনো শহরের রাস্তাঘাট সংকীর্ণ, প্রবল যানজট, রাস্তার কোণে কোণে আবর্জনার স্তুপ উপচে পড়ছে। স্বাস্থ্য পরিষেবা বলে কিছু নেই। রয়েছে পানীয় জলের সমস্যাও। স্কুল বলতে কেবল মাদ্রাসা। তাতেও পড়ুয়ারা পর্যাপ্ত খাবার পায় না। বিদ্যুৎ-সঙ্কটে নাজেহাল সাধারণ মানুষ থেকে ব্যবসায়ী শ্রেণি। চাকরির কোনও সুযোগ নেই স্থানীয় যুব সমাজের কাছে। অধিকাংশ দরিদ্র মুসলিম পরিবারের শিশুরা একটু বড় হলেই পড়া ছাড়িয়ে তাদের কোনও না কোনও শ্রমিকের কাজে ঢুকিয়ে দেন বাবা-মায়েরা। বাড়তি আয়ের আশায়। আর নিজেদের এই হতদরিদ্র দশা নিয়ে গত চার দশক ধরে ক্ষোভ জমা হয়েছে হায়দরাবাদের মুসলিম সমাজের মনেও।

ট্যাক্সিচালক আরশাদ ‘ওল্ড সিটি’-র বাসিন্দা। প্রবল ক্ষুব্ধ ভাইজান ওয়েইসির উপরে। তাঁর কথায়, ‘‘কেবল নিজের পরিবারের কথা ভেবেছেন ওয়েইসি। ওয়েইসি পরিবার ফুলে ফেঁপে উঠেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের কোনও উন্নতি হয়নি। তিন দশক আগে আমরা যেখানে ছিলাম, এখনও সেই অন্ধকারেই পড়ে রয়েছি।’’

ক্ষোভের ওই ছিদ্র-পথে মুসলিম মহল্লায় প্রবেশ মাধবীলতার। তিন তালাক বিল পাশের পরে প্রথম বার মুসলিম মহিলাদের এই আইনের সুফল বোঝাতে সংখ্যালঘু ময়দানে পা দিয়েছিলেন। সেই থেকে পড়ে রয়েছেন হায়দরাবাদের মুসলিম মহল্লায়। মাধবীলতা নিজে একাধিক শিক্ষা সংগঠন ও হাসপাতালের চেয়ারপার্সন। তাই নিজের প্রভাব খাটিয়ে নিয়মিত ভাবে স্বাস্থ্য শিবির চালিয়ে গিয়েছেন গত এক-দেড়
বছর ধরে। যেখানে বিনামূল্যে চিকিৎসার সুযোগ পেয়েছেন স্থানীয় মুসলিমেরা। সংখ্যালঘু সমাজের যে সব ছাত্র মেধাবী, তাদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন তিনি। সব মিলিয়ে হিন্দুদের তো বটেই, মুসলিমদের ঘরে ঘরেও পরিচিত নাম হয়ে উঠেছেন তিনি।

কিন্তু তার পরেও বিস্তর প্রশ্ন রয়েছে সাধারণ মানুষ তো বটেই, বিজেপির অন্দরেও। প্রশ্ন উঠেছে, হায়দরাবাদের গোঁড়া মুসলিম পল্লিগুলিতে আদৌ কি মহিলাদের মন জিততে সক্ষম হবেন উগ্র হিন্দুত্বের পরিচয় নিয়ে মাঠে নামা মাধবীলতা? ওই মহল্লাগুলোই ওয়েইসির মূল ভোটব্যাঙ্ক বলে পরিচিত। তার চেয়েও বড় প্রশ্ন রয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, বিজেপি কি হায়দরাবাদ কেন্দ্র থেকে সত্যিই ওয়েইসিকে হারিয়ে জিততে মরিয়া? ভরতনাট্যমে পারদর্শী মাধাবীলতা প্রচারে বেরিয়ে অদৃশ্য প্রতিপক্ষ ওয়েইসিকে লক্ষ্য করে যতই তির ছুড়ুন না কেন, বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব কি ওয়েইসির হার চাইছেন সত্যিই? হায়দরাবাদের ভোট বিশেষজ্ঞ সঞ্জয় মেগার ব্যাখ্যা, ‘‘জাতীয় রাজনীতিতে ওয়েইসি বিজেপির ‘বি টিম’ বলেই পরিচিত। বিহার হোক বা উত্তরপ্রদেশ বা মহারাষ্ট্র, বিরোধীদের মুসলিম ভোটে ভাগ বসিয়ে বরাবর বিজেপির সুবিধে করে দিয়েছেন ওয়েইসি। তা ছাড়া বিজেপির মুসলিম বিরোধিতার প্রশ্নে সবচেয়ে বড় ‘পোস্টার বয়’ ওয়েইসি নিজেই। যাঁকে সামনে রেখে মুসলিম বিরোধিতার অস্ত্রে নানা ভাবে শান দেয় বিজেপি। বিরোধিতার সেই একমাত্র মুখও যদি সংসদে না থাকেন, তা হলে বিজেপির একটা বড় অস্ত্রই ভোঁতা হয়ে যাবে না?’’

নিজ়ামের দেশে এই প্রশ্নটাই তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহদের। মাধবীলতাকেও।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement