গত বছর পঞ্চায়েত ভোটের দিন ডোমকলে। —ফাইল ছবি।
সারা দিন কেটেছে টানটান। কখনও বোমার আওয়াজ তো কখনও শোনা গিয়েছে গুলির শব্দ। রাত হতেই সারি সারি অ্যাম্বুল্যান্স।
গত বছর পঞ্চায়েত ভোটের দিনটা কিছুতেই ভুলতে পারছিলেন না আসিফ রেজা। মুর্শিদাবাদ জেলার ডোমকলের বাসিন্দা আসিফ বলছিলেন, ‘‘বোমা, গুলি, চিৎকার, আর্তনাদ, অ্যাম্বুল্যান্সের সাইরেন। বিশ্বাস করুন, ভোট শুনলেই যেন ওই আওয়াজগুলো ফিরে ফিরে আসে।’’ একটু থেমে বললেন, ‘‘ভয় লাগে।’’
সেই ভয়টা শুধু আসিফের মতো সাধারণের? না। ডোমকল মহকুমা হাসপাতালের এক চিকিৎসকের কথায়, ‘‘সে যে কী রাত গিয়েছে!’’ স্থানীয় তো বটেই, হাসপাতালের কর্মীরাও অনেকেই বলছিলেন, রাত বাড়তেই হাসপাতাল চত্বরে একটার পর একটা অ্যাম্বুল্যান্স আসছিল মহকুমার নানা জায়গা থেকে। নামানো হচ্ছে এক এক জনকে, রক্তে ভিজে ছিল তাঁদের গোটা শরীর। ওই চিকিৎসক বলেন, ‘‘রক্তে ভেসে যাওয়া শরীর থেকে জামা-গেঞ্জি কেটে কেটে বার করে সেলাই করতে হয়েছে। তা-ও খুব দ্রুত। যা রক্ত বার হচ্ছিল এক এক জনের দেহ থেকে, একটু দেরি হলেই বড় বিপদ হতে পারত।’’
আবার লোকসভা ভোটের ডঙ্কা বাজতেই ডোমকলে ফিরে এসেছে আতঙ্ক। চিন্তা আরও বাড়িয়েছে পাটখেত। অনেকেই বলছিলেন, পাট তো তখন বড় হয়ে যাবে। তাই পাটের আড়াল দেখে বসে তৈরি হবে বোমা, আগ্নেয়াস্ত্রের অংশগুলি আলাদা করে নিয়ে এসে জোড়া হবে। সে সব আবার একসঙ্গে আসে না। টোটো, মোটরবাইক বা বাসে করেও কখনও লোহার নল, কখনও স্প্রিং, কখনও গুলি আসে। নির্জন জায়গায় বসে ‘কারিগরেরা’ সেগুলি জুড়ে আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি করে।
কারা এই ‘কারিগর’? স্থানীয় মানুষের বক্তব্য, আগে মুঙ্গের থেকে আসত তারা। এখন এলাকাতেই কয়েক জন ‘কাজ’ শিখে গিয়েছে। তাতেই গত বছর পঞ্চায়েত ভোটে তুমুল তাণ্ডব হয়েছে। কেউ মারা না গেলেও ভোট পর্বে আহত হয়েছেন শতাধিক লোক। ডোমকলের বাসিন্দা আতিকুর রহমানের কথায়, ‘‘আগে ছিল তৃণমূলের একতরফা আধিপত্য। গত বার থেকে এলাকার কিছু মানুষ বাম-কংগ্রেসের ছায়ায় শাসক দলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে শুরু করেন। তাই উভয় পক্ষই কারিগরদের এনেছিল।’’
কিন্তু কারিগর তো সীমিত। তাই অস্ত্র ‘উদ্ভাবন’ করতে হয়েছে। গত পঞ্চায়েত ভোট থেকে শুরু হয়েছে ক্রিকেটের উইকেটকে ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করা। পঞ্চায়েত ভোটের মুখে গত বছর ভরা গ্রীষ্মে দিন কয়েকের মধ্যে ডোমকল মহকুমায় প্রায় সাড়ে ৫০০ উইকেট বিক্রি হয়। মাত্র কয়েক দিনে ৫০ টাকার উইকেট ৮০-১০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘‘পুলিশ বেশি কড়াকড়ি করায় সন্ত্রাসের নতুন রূপ খুঁজে বার করেছিল ডোমকল।’’ তার পরেই তাঁর মন্তব্য, ‘‘ভোট হবে আর ডোমকলে সন্ত্রাস হবে না, তা কখনও হয়!’’
সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ থেকেই জানা যাচ্ছে, ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটে রাজ্যে ক্ষমতায় ছিল বামেরা। ভোটের দিন হানাহানিতে খুন হন দু’পক্ষের ১৩ জন। স্থানীয়দের একাংশের দাবি, আদতে ভোটের আগের দিন এবং ভোটের পরেও বেশ কিছু দেহ সকলের অগোচরেই কবর দেওয়া হয়। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে ২০১৩-র ভোটেও মৃত্যু হয়েছিল ১৮ জনের। তার পরে মৃত্যুর সংখ্যা কিছুটা কমে।
রাজনৈতিক ভাবেও ডোমকল সব সময় টানটান উত্তেজনার কেন্দ্রে। ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের আগে পর্যন্ত সেখানে রাজপাট ছিল সিপিএম ও কংগ্রেসের। বিধায়ক, সাংসদ তো বটেই, ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের সব ক্ষমতাই ছিল মিলেমিশে এই দুই দলের দখলে।
রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল গত কয়েক বছরে কিছুটা শক্তি বাড়ায়। তা-ও ২০১৯ সালের লোকসভা ভোট ও তার দু’বছর পরে বিধানসভা ভোটে বড় কোনও গোলমাল হয়নি। গত বছর পঞ্চায়েত ভোটে ফের উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ডোমকল। মধুরকুলে গুলিবিদ্ধ হন নবকুমার মণ্ডল ও তাঁর ভাইপো সায়ন মণ্ডল। সায়নের জ্যাঠাইমা রিতা মণ্ডলের দাবি, ‘‘আমরা কল্পনাও করতে পারিনি যে, গণতন্ত্রের নামে শাসকদল এ ভাবে বিরোধীদের গুলি করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে। এখন ভোট এলেই বুকটা কেঁপে ওঠে।’’
বিধায়ক জাফিকুল ইসলামের অবশ্য বক্তব্য, ‘‘ডোমকলে সন্ত্রাসের ‘ঐতিহ্য’ বাম আমল থেকে শুরু। আমরা আসার পরে সন্ত্রাস অনেক কমেছে। তবে এখনও যেটুকু হয়, তা বিরোধীরাই করে। পঞ্চায়েত ভোটে বেশি জখম হয়েছেন আমাদের কর্মীরাই।’’
সিপিএমের জেলা সম্পাদক জামির মোল্লার কথায়, ‘‘শাসকদলের আধিপত্য এখন প্রশ্নের মুখে। তারা জোর করে ক্ষমতা ধরে রাখতেই সন্ত্রাসকে ব্যবহার করছে।’’ যদিও সাধারণ মানুষের ধারণা, এ বার ভোটে ডোমকলে সন্ত্রাস কতটা ছড়াতে পারে, তা কেন্দ্রীয় বাহিনীর ভূমিকার উপরেই নির্ভর করবে।