—প্রতীকী ছবি।
সিরাজ-উদ-দৌলার নামে সব বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। ৩ জুলাই, ১৯৪০ ‘সিরাজ-উদ-দৌলা দিবস’ পালনের ডাক দেওয়ার পরেই সুভাষকে গ্রেফতার করা হয়। এ বার ভোট-আবহে সিরাজের নাম উঠে আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন উঠছে, তা হলে কি বাঙালির চেনা সিরাজের মূর্তিটিও ভেঙেচুরে কালি ছেটানো হবে?
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ সুগত বসু বলছিলেন, ১৯২৫ সালে বর্মার মান্দালয় জেলে সুভাষ লেখেন, ‘দেড়শত বৎসর পূর্বে বাঙালি বিদেশিকে ভারতের বক্ষে প্রবেশের পথ দেখিয়েছিল, সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত বিংশ শতাব্দীর বাঙালিকে করতে হবে।’ সুগতের কথায়, ‘‘সিরাজের প্রতি সুভাষচন্দ্র বার বার তাঁর শ্রদ্ধার কথা বলেছেন। দেশের মাটিতে তাঁর শেষ আন্দোলনই সিরাজের নামে।’’ বিজেপি-শিবিরের একাংশ সেই সিরাজকেই অত্যাচারী, হিন্দু-বিদ্বেষী শাসকের তকমা দিচ্ছে।
ভোটে মেরুকরণের রাজনীতিতে ইতিহাসের নায়ককে ধ্বস্ত করাও এখন দেশে নব্য রীতি। গত বছর কর্নাটকের ভোটে ব্রিটিশের সঙ্গে যুদ্ধে আত্মবলিদানকারী টিপু সুলতানের বিষয়ে সংগঠিত ভাবে মিথ্যাচার, ভুয়ো কাহিনি নির্মাণে নামেন বিজেপি নেতারা। ভোটে তার ফল অবশ্য ভাল হয়নি। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পরিবারের বধূ, বিজেপি প্রার্থীরও ব্যাখ্যা, হিন্দু-বিদ্বেষী সিরাজের হাত থেকে ধর্ম, ভাষা বাঁচাতেই কৃষ্ণচন্দ্র, জগৎ শেঠেরা ব্রিটিশের দ্বারস্থ হন। মুর্শিদাবাদের ১৮ শতকের মিনিয়েচার চিত্রকলায় কিন্তু শিল্পীরা এঁকেছেন শ্রীকৃষ্ণের রূপে সিরাজের দোল খেলার ছবি। পলাশির যুদ্ধে সিরাজের সেনাপতি মোহনলাল। মন্ত্রীদের মধ্যে হিন্দু, মুসলিম সমান।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের আশুতোষ অধ্যাপক অমিত দে-র মত, “বাংলার মুসলিম শাসকেরা বেশির ভাগই বাংলা ভাষার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ফার্সির ব্যবহার থাকলেও পূর্ব পাকিস্তানের সরকারের মতো অন্য ভাষা চাপাননি। তা ছাড়া হিন্দুত্ব বা মুসলিমত্ব প্রচারের রাজনীতি উনিশ শতকের আগে বাংলায় ছিলই না।’’ কৃষ্ণচন্দ্রকেও দেখা যাচ্ছে বসিরহাটের রওশন বিবির সুফি দরগার পৃষ্ঠপোষক হিসেবে। সিরাজের সঙ্গে তাঁর সংঘাত হিন্দু-মুসলিম বিরোধ বলে দেখতে অনেকেই রাজি নন।
তবে প্রধানমন্ত্রী মোদীর বহুচর্চিত পঞ্চ-পণের মধ্যে যে ঔপনিবেশিক সংস্কার বা গোলামির ভাব দূর করার কথা বলা হয়েছে, তাতে ইসলামি সংস্কৃতিও ‘অপর’ বলেই চিহ্নিত। বিজেপি-শিবিরের মতে, মুসলিম শাসনকালের ৮০০-৯০০ বছর ধরেই দেশের পরাধীনতা-পর্ব। স্কুলপাঠ্যে মোগল আমল কাটছাঁট হয়। ইলাহাবাদ, মোগলসরাইয়ের নাম পাল্টায়। হিন্দু রাজা বা হিন্দুত্ববাদী নেতাদের ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে মেলে ধরার অভিযোগ ওঠে। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তীর প্রশ্ন, ‘‘ইজ়রায়েলে তা-ও আরব-ইহুদিতে জমি নিয়ে ঝগড়ার সূত্রপাত। ভারতে হিন্দু-মুসলিম সংঘাতের পিছনে কি সূদূর অতীতের কিছু টুকরো ঘটনা!” তাঁর মতে, “এক ধরনের স্মৃতির রাজনীতি গেঁড়ে বসছে। তাতে ইতিহাস বিকৃতিও ঘটছে।”
দেখা যাচ্ছে বিজেপি প্রার্থী প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় পর্যন্ত টেলিভিশনে সাক্ষাৎকারে গান্ধী এবং গডসের মধ্যে বাছতে দ্বিধা করছেন। টিপু সুলতানকে নিয়ে অপপ্রচারের দিনে টিপুর উত্তরপুরুষ কলকাতাবাসী আনোয়ার আলিও বলেছিলেন, ‘‘এটা হবেই, কারণ ওরা গডসেকে নায়ক বানিয়েছে।”