চেন্নাইয়ের মায়লাপোরের কপালেশ্বর মন্দির। —নিজস্ব চিত্র।
কপালেশ্বর মন্দিরে সকাল থেকে শিবের পুজো চলছে। প্রায় একশো কুড়ি ফুট উঁচু তাক লাগানো কারুকার্যময় গোপুরম বা তোরণ পেরিয়ে অষ্টম শতাব্দীতে তৈরি প্রাচীন মন্দিরের সামনে ভক্তদের ভিড়। নাদস্বরম বাজছে। প্রধান পুরোহিত বেঙ্কট সুব্রমনিয়ম মন্ত্র পাঠ করে চলেছেন।
তামিলনাড়ু জুড়ে ছড়িয়ে থাকা হাজার হাজার শিব বা বিষ্ণুর মন্দিরের সঙ্গে এ মন্দিরের আপাত ভাবে কোনও ফারাক নেই। ফেলুদা হলে নিশ্চিত তোপসেকে প্রশ্ন করত, একটা ছোট্ট ফারাক রয়েছে, কী বল দেখি? একটু কান খাড়া করে থাকলে পার্থক্যটা ধরা পড়ে। সংস্কৃতে মন্ত্র পাঠ নয়। মন্ত্রোচারণ হচ্ছে তামিলে।
করুণানিধির পুত্র এম কে স্ট্যালিনের নেতৃত্বে তিন বছর আগে নতুন করে ডিএমকে সরকার তৈরি হয়েছে। এরপরেই সরকারি উদ্যোগে মন্দিরে তামিলে পুজোঅর্চনা করার প্রকল্প চালু হয়েছে। তার সূত্রপাত হয়েছিল এই কপালেশ্বর মন্দিরে। মায়লাপোরের পরে শ্রীরঙ্গম, মাদুরাই, থাঞ্জাভুরের একাধিক মন্দিরে এই ব্যবস্থা চালু হয়েছে। কোনও ভক্ত চাইলেই পুরোহিতকে বলে সংস্কৃতের বদলে তামিল মন্ত্রপাঠ করে পুজো দিতে পারবেন।
তামিলনাড়ুর শাসক দল ডিএমকে সাংসদরা প্রায়ই সংসদে অভিযোগ তোলেন, মোদী সরকার ধ্রুপদী ভাষাগুলির মধ্যে তামিলের থেকে সংস্কৃতের উন্নয়নে বিশ গুণ টাকা বেশি খরচ করে। এ কি তারই মধুর প্রতিশোধ!
এই টুকুতেই চমকে গেলেন? তামিলনাড়ু সরকারের হিন্দু ধর্মীয় ও সেবামূলক সম্পত্তি বিভাগের মন্ত্রী পি কে শেখর মুচকি হাসেন। “জানেন কি, আমাদের রাজ্যে মন্দিরে মন্দিরে এখন অব্রাহ্মণরা পুরোহিত হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন! অব্রাহ্মণ হলেও তাঁরা মন্দিরে পুজোঅর্চনার দায়িত্ব পেয়েছেন? রীতিমতো দেড় বছর ধরে প্রশিক্ষণ দিয়ে সরকার তাঁদের বেতন দিয়ে পুরোহিত হিসেবে নিয়োগ করেছে?”
বুজরুকি নয়। বাস্তবেই। মাদুরাইয়ের আয়াপ্পন মন্দিরের টি মারিচামী থেকে তিরুচিরাপল্লীর ভায়ালুর মুরুগান মন্দিরের এস প্রভু—রোজ পুরোহিত মন্ত্রপাঠ করে, রীতি, আচার মেনে পুজো করেন। কিন্তু তাঁদের কেউই ব্রাহ্মণ নন। দু’একজন নন, স্ট্যালিন সরকার এমন ২৩ জন হিন্দু পুরোহিত বা অর্চক নিয়োগ করেছে। তাঁদের কেউ দলিত, কেউ অনগ্রসর, কেউ বিশেষ রকমের অনগ্রসর শ্রেণির প্রতিনিধি।
বিজেপি তামিলনাড়ুর ডিএমকে দলের নেতাদের বিরুদ্ধে সনাতন হিন্দু ধর্মকে অপমান করার অভিযোগ তোলে। কারণ, তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিনের পুত্র উদয়নিধি সনাতন হিন্দু ধর্মকে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, করোনার মতো নিকেশ করার কথা বলেছিলেন। তা নিয়ে বিজেপি গোটা দেশে তোলপাড় ফেলে দিয়েছিল। ডিএমকে বিরোধী মঞ্চ ‘ইন্ডিয়া’র শরিক। বিজেপি এ নিয়ে গোটা ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চকেই সনাতন হিন্দু বিরোধী বলে আক্রমণ করেছিল। এখনও বিজেপি সুযোগ পেলেই সনাতন প্রসঙ্গ তুলছে। অমিত শাহ কন্যাকুমারীতে প্রচারে গিয়ে ডিএমকে-র বিরুদ্ধে তামিলদের আবেগে আঘাত করার অভিযোগ তুলছেন। তার প্রতিশোধ নিতে কি ডিএমকে সরকার তামিলনাড়ুতে সনাতন ধর্মের বিরুদ্ধে গিয়ে অব্রাহ্মণদের মন্দিরে পুরোহিত করছে? সংস্কৃতকে পিছনে ফেলে তামিলের দাপট দেখাতে মন্দিরে মন্দিরে তামিল মন্ত্রপাঠের বন্দোবস্ত করছে?
ভুল। আসলে উত্তর ভারত বা হিন্দিভাষী গোবলয়ের সনাতন ধর্মের সংজ্ঞা দ্রাবিড় ভূমিতে এসে হেঁয়ালির মুখে পড়েছে। ভারতের বাকি অংশে সনাতন ধর্মের অর্থ, হিন্দু রীতিনীতি মেনে জীবনযাত্রা। তামিলনাড়ুতে সনাতনের অর্থ বর্ণবিদ্বেষ, জাতপাতের ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা। স্ট্যালিন-পুত্র উদয়নিধি যখন বামপন্থী প্রগতিশীল লেখক-শিল্পী সংগঠনের অনুষ্ঠানে গিয়ে সনাতন ধর্মকে নিকেশ করার কথা বলেছিলেন, তখন তাতে কেউ চমকাননি। তা নিয়ে বিজেপি হইচই শুরু করায় বরং দলের নেতারাই অবাক হয়েছিলেন।
ডিএমকে-র প্রবীণ নেতা টি কে এস এলানগোভান বুঝিয়ে দেন বিষয়টা। সত্তরের দশকে তামিলনাড়ুর সমাজসংস্কারক পেরিয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন, মন্দিরের দরজা সকলের জন্য খোলা থাকবে। ব্রাহ্মণদের আধিপত্য থাকবে না। থাকবে না বর্ণবিদ্বেষ, জাতপাতের ভেদাভেদ। সেই সময়েই করুণানিধি মুখ্যমন্ত্রী হয়ে হিন্দু ধর্মের সকলের জন্য মন্দিরের পুরোহিত হিসেবে কাজ করার প্রকল্প চালু করতে চেয়েছিলেন। এত বছর পরে, নানা আইনি জট কাটিয়ে অবশেষে করুণানিধি-পুত্র স্ট্যালিনের আমলে এই ব্যবস্থা চালু হয়েছে। তামিলনাড়ু সরকারের হিন্দু ধর্মীয় ও সেবামূলক সম্পত্তি বিভাগের অধীনে রাজ্যের প্রায় ৪৪ হাজার মন্দির রয়েছে। সমস্ত মন্দিরেই অব্রাহ্মণদের জন্য পুরোহিত হিসেবে কাজ করার সুযোগ থাকবে। সব মন্দিরেই সংস্কৃতের বদলে তামিল মন্ত্রপাঠ করে পুজোর ব্যবস্থা থাকবে।
গোটা তামিলনাড়ুতে এ নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। বিজেপি কি সনাতনের অপমানের কথা বলে ভোট পাবে? প্রশ্ন শুনলে সবাই অবাক হয়ে তাকান। এ সব ভোটের বিষয় নাকি? যে-টুকু গাত্রদাহ ব্রাহ্মণদের। কিন্তু তাঁরা তো তামিল জনসংখ্যার মাত্র ৩ শতাংশ। এলানগোভান প্রশ্ন ছোড়েন, “এ বার বলুন তো, এই তামিলনাড়ুতে বিজেপি সনাতন ধর্মের দোহাই দিয়ে ভোট কুড়োতে পারবে? হিন্দুত্ব, সনাতন ধর্ম বলতে বিজেপি কী বোঝে? মনুস্মৃতি, নাকি ব্রাহ্মণ্যবাদ? ওঁরা তো সেই ব্যাখ্যা করেন না!”
বিবিধের মাঝে এই মিলন মহানের সত্যিই ব্যাখ্যা মেলে না। কপালেশ্বর মন্দিরে নাদস্বরমের সুর গোপুরমের কারুকার্যে মিশে যায়।