প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল ছবি।
বাংলায় অপরাধীরাই সিদ্ধান্ত নেয় যে, তারা কবে আত্মসমর্পণ করবে আর কবে গ্রেফতার হবে! সন্দেশখালিতে শেখ শাহজাহানকে দীর্ঘ দিন পুলিশের ‘খুঁজে না পাওয়া’ এবং শেষমেশ গ্রেফতারির প্রসঙ্গ তুলে শনিবার কৃষ্ণনগরের জনসভায় এমন আক্রমণেই বাংলায় ‘দুষ্কৃতী-রাজে’র বিরুদ্ধে সরব হলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সেই সঙ্গে একশো দিনের কাজ থেকে রেশনের প্রসঙ্গ এনে বার বার তুললেন তৃণমূলের দুর্নীতির প্রসঙ্গও। লাগামছাড়া দুর্নীতির কারণেই যে কেন্দ্র একশো দিনের প্রকল্প বকেয়া টাকা বা কাজ দিচ্ছে না, তা-ও প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করলেন।
হুগলির আরামবাগের জনসভায় শুক্রবারই সন্দেশখালি নিয়ে সরব হয়েছিলেন মোদী। নদিয়ার কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজের মাঠে এ দিন জনসভায় মোদীর বক্তব্য, “বাংলায় পরিস্থিতি এমন যে পুলিশ নয়, অপরাধী ঠিক করে যে, সে কবে আত্মসমর্পণ করবে বা গ্রেফতার হবে! রাজ্য সরকার তো চাইছিলই না যে, সন্দেশখালির অপরাধী গ্রেফতার হয়। কিন্তু বাংলার নারী শক্তি দুর্গা হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছে!” হুগলির পরে নদিয়াতেও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে ইঙ্গিত মিলছে, রাজ্যের বিষয়কে অস্ত্র করেই বাংলায় লোকসভা ভোটের রণকৌশল সাজাচ্ছে বিজেপি। কৃষ্ণনগরে মোদীর সভায় ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতোই।
সাধারণত কেন্দ্রীয় সংস্থার কাজে রাজ্য পুলিশ সহযোগিতা করবে, এটাই দস্তুর। কিন্তু সন্দেশখালিতে শাহজাহানের ‘উধাও’ হয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা অন্য রকম ছিল বলে প্রথম থেকেই দাবি করে আসছে বিজেপি এবং বামেরা। ফের তৃণমূলের ‘মা-মাটি মানুষ’ প্রসঙ্গ তুলে এ দিন মোদী দাবি করেছেন, “আজ মা, মাটি আর মানুষ সবাই তৃণমূলের কুশাসনে কাঁদছে। সন্দেশখালির বোনেরা সুবিচারের দাবি জানিয়ে গিয়েছেন, কিন্তু তৃণমূল সরকার তাঁদের কথা শোনেনি। বিজেপির প্রতিটি কার্যকর্তা ওঁদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে গিয়েছেন, তখন এই রাজ্য সরকার ঝুঁকতে বাধ্য হয়েছে।”
অপরাধীদের দাপট প্রসঙ্গে যে কথা মোদী বলেছেন, তা নিয়ে অবশ্য পাল্টা সরব হয়েছে তৃণমূল, সিপিএম ও কংগ্রেস। মণিপুর, হাথরস-সহ নানা ঘটনার কথা স্মরণ করানোর পাশাপাশিই তৃণমূলের সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘আরামবাগ আর কৃষ্ণনগরে বিজেপির সভা তো পুরো ফ্লপ! এই সভা বলছে, এ বার আর মোদীর মুখে ভোট হবে না। আর নরেন্দ্র মোদী কোনও প্রতিশ্রুতিই পূরণ করেন না। ফলে, কত অঙ্কের প্রকল্প শুরু করলেন, তার থেকে গুরুত্বপূর্ণ তার পরিণতি।’’ সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর প্রশ্ন, ‘‘বাংলায় যে দুষ্কৃতীদের শাসন চলছে, সে কথা আমরা বহু বার বলেছি। কিন্তু মোদী এই কথা বললে তাঁকে আগে উত্তর দিতে হবে, মণিপুরে কী করেছেন? দিল্লিতে মহিলা কুস্তিগিরেরা যৌন হেনস্থার অভিযোগ তুলে রাস্তায় বসে থাকার পরেও ব্রিজভূষণ শরণ সিংহকে কি পুলিশ গ্রেফতার করেছে? আসলে নিজের জায়গায় বিজেপি আর তৃণমূলের কোনও ফারাক নেই।’’ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীরও বক্তব্য, “শাহজাহানের গ্রেফতার, মোদীর আগমন, দিদির রাজভবনে সাক্ষাৎ— এই তিনটের মধ্যে কি কোথাও সমঝোতা আছে? মণিপুরে মা-বোনদের অত্যাচারের সময়ে, আপনি গেলেন না। হাথরস নিয়েও কিছু বললেন না। মোদীর নজরটা আছে। কিন্তু কখনও কখনও ঠুলি পরে নেন!”
তৃণমূলের দুর্নীতির প্রসঙ্গও ফের টেনেছেন মোদী। তাঁর মতে, তৃণমূল সরকার অত্যাচার ও বিশ্বাসঘাতকতার, পরিবারতন্ত্র ও দুর্নীতির সমার্থক হয়ে গিয়েছে। রেশন-দুর্নীতির পাশপাশি এ দিন তিনি টেনে এনেছেন একশো দিনের কাজের প্রসঙ্গও। এই প্রকল্পে কাজ বন্ধ রাখা এবং হয়ে যাওয়া কাজ বাবদ কেন্দ্রের কাছে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বকেয়া যে আসন্ন লোকসভা ভোটে তৃণমূলের প্রধান হাতিয়ার হতে চলেছে, তা সম্ভবত বিজেপি নেতাদের কাছে পরিষ্কার। শুধু দিল্লিতে দরবার করা নয়, সাম্প্রতিক প্রায় প্রতিটি সভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এই নিয়ে লাগাতার সরব হয়েছেন। মোদী এ দিন বলেন, “আপনারা স্বপ্নেও ভাবতে পারবেন না যে, এখানে মনরেগা (একশো দিনের কাজের প্রকল্পে) ২৫ লক্ষ ভুয়ো জব কার্ড তৈরি করা হয়েছে। যে জন্মায়নি, তারও কার্ড তৈরি করেছে! যে পয়সা গ্রামের গরিব মজদুরের পাওয়ার কথা ছিল, সেটা তৃণমূলের তোলাবাজেরা লুট করেছে।” দুর্নীতির জন্যই টাকা আটকে গিয়েছে, এই কথাই সাম্প্রতিক কালে বারবার বলেছেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা।
রাজ্যের মন্ত্রী, তৃণমূলের শশী পাঁজা অবশ্য পাল্টা বলেছেন, “প্রধানমন্ত্রী মিথ্যা ভাষণ দিচ্ছেন! আপনারা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা দেখিয়ে বাংলায় যাঁরা একশো দিনের কাজ করেছেন, তাঁদের টাকা বন্ধ করে দিয়েছেন। বাংলায় নয়, সব থেকে বেশি ভুয়ো জব কার্ড হয়েছে উত্তরপ্রদেশে। সেখানে কি টাকা বন্ধ করে রাখা আছে?”
বাংলার ছ’কোটি মানুষ বিনামূল্যে রেশন পাচ্ছেন এবং আগামী পাঁচ বছর এই যোজনা চলবে বলে ‘গ্যারান্টি’ দিয়ে মোদী অভিয়োগ করেন, “এই প্রকল্পের তৃণমূল নিজেদের স্টিকার লাগিয়ে দিচ্ছে। গরিবের রেশন লুট করার ক্ষেত্রে এরা পিছিয়ে নেই। তৃণমূল এই বাংলার লোককে গরিব বানিয়ে রাখতে চায় যাতে ওদের রাজনীতি চলতে পারে।” মোদীর কটাক্ষ, এখন ‘টিএমসি’ কথার মানে হয়ে গিয়েছে ‘তু ম্যায় অউর করাপশন’। যা কিছু উন্নয়নের ‘স্কিম’ (প্রকল্প) ছিল সব ‘স্ক্যাম’ (কেলেঙ্কারি) হয়ে গিয়েছে। তাঁর কথায়, “তৃণমূল সরকার প্রতিটি স্কিমকে স্ক্যামে বদলে দিয়েছে।” যা শুনে সিপিএমের সুজনের কটাক্ষ, ‘‘তু মানে মমতা আর ম্যায় মানে নিজের কথা বুঝিয়ে মোদী স্বীকার করে নিয়েছেন, তাঁরা দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেন!’’
মহিলাদের ভোট যে মমতার বড় সন্বল, সম্ভবত তা মাথায় রেখেই মোদী এ দিন দাবি করেন, তৃণমূল সরকার রাজ্যে ‘বেটি বচাও বেটি পড়াও’ কর্মসূচি বলবৎ করতে দেয়নি, মহিলা হেল্পলাইন-কে গুরুত্ব দেওয়া হয় হয় না, রাজ্যের গরিব মহিলাদের ১৩ লক্ষ উজ্বলা গ্যাসের আবেদন জমা পড়া সত্ত্বেও তার জন্য জেলায় জেলায় কমিটি গঠন করা দরকার, তা হয়নি। রাজ্যের শাসক দলকে তোপ দেগে বাংলার সব আসনেই ‘পদ্ম ফোটানো’র ডাক দিয়ে গিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।