প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছবি: ভিডিয়ো থেকে।
১ মার্চ আরামবাগের সভা থেকেই রাজ্যে লোকসভা ভোটের প্রচার শুরু করে দিলেন মোদী। জনসভায় রাজ্যের তৃণমূল সরকারকে যে আক্রমণ করবেন, তা এক প্রকার নিশ্চিতই ছিল। তবে মোদীর ভাষণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বার বার উঠে এসেছে নারীশক্তি, সন্দেশখালিতে মহিলাদের উপর ‘নির্যাতন’। রাজ্য বিজেপি আগেই এই নিয়ে সরব হয়েছিল। এ বার রাজ্যে প্রচারে এসে সেই নিয়েই জোরালো সওয়াল করলেন মোদী। সেই সঙ্গে বেঁধে দিলেন লোকসভা ভোটের প্রচারের সুর। আগামী দিনে এই ‘মহিলা নির্যাতন’-কে হাতিয়ার করেই যে বার বার রাজ্যের শাসকদল তৃণমূলকে আক্রমণ করা হবে, তা শুক্রবার এক প্রকার স্পষ্ট করে দিলেন মোদী। সঙ্গে থাকবে দুর্নীতির অস্ত্রও, তা-ও বুঝিয়ে দিলেন মোদী।
সভা শেষে ধন্যবাদ জানালেন উপস্থিত জনতাকে। এত বিপুল সংখ্যক মানুষ জনসভায় যোগ দেওয়ার কারণে তিনি আপ্লুত বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী। সব শেষে বলেন, ‘অব কি বার, ৪০০ পার’।
বার বার নারীশক্তির উত্থানের উপরেই জোর দিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। মোদী জানালেন, তিন কোটি ‘লাখপতি দিদি’ তৈরির সঙ্কল্প নিয়েছে তাঁর সরকার। তিনি বলেন, ‘‘তৃণমূল ভাবে একটি ভোটব্যাঙ্ক তাদের নিশ্চিত রয়েছে। এই দম্ভও ভাঙবে। কিন্তু এ বার মুসলিম মা-বোনেরাও তৃণমূলকে ভোট দেবে না। তাদের গুণ্ডারাজকে উপড়ে ফেলার জন্য এগিয়ে আসবেন। তৃণমূলের বিদায়ের কাউন্টডাউন শুরু হচ্ছে।’’
মোদী জানান, পশ্চিমবঙ্গে ৪৫ লক্ষ ঘর তৈরির জন্য টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। কিন্তু তৃণমূল সরকার বাধা দিচ্ছে। দ্রুত কাজ করছে না। যদি কেউ করে, তা বিজেপি করবে। মোদী বলেন, ‘‘সব ঘরে পাইপের মাধ্যমে জল সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে মোদীর। এ ক্ষেত্রেও পশ্চিমবঙ্গ সরকার কচ্ছপের মতো কাজ করছে। গরিবের যাতে ভাল হয়, সব প্রকল্পের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তৃণমূল।’’ মোদী এও জানান, গরিবকে বিনামূল্যে চিকিৎসার খরচ দিতেও বাধা দিচ্ছে তৃণমূল সরকার। কৃষকদেরও অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।তাঁর কথায়, ‘‘পশ্চিমবঙ্গ বিকশিত হলে ভারতও হবে। সে কারণে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যে সকল আসনে কমল ফোটার প্রয়োজন।’’ তার পরেই তিনি স্লোগান দেন, ‘এই বার ৪০০ পার’।
মোদী বলেন, তৃণমূল সরকারের জন্য রাজ্যের বিকাশ আটকে রয়েছে। ভুগছেন মধ্যবিত্ত মানুষ। ঝারিয়া, রানিগঞ্জে কয়লাখনির প্রকল্পের কাজ ৬ বছর আগে শুরু করা হয়েছে। সরকার সেই কাজ হতে দিচ্ছে না। ১৮ হাজার কোটি টাকার কাজ আটকে রয়েছে বোকারো-হলদিয়া পাইপলাইন প্রোজেক্টে। তারকেশ্বর-বিষ্ণুপুর রেল লাইনের কাজ আটকে রয়েছে। কেন্দ্র টাকা বরাদ্দ করলেও কাজ হচ্ছে না। তৃণমূল সরকার গরিবদের ঘরও তৈরি করতে দিচ্ছে না। এই নিয়ে রাজ্যের দিকে আঙুল মোদীর।
প্রধানমন্ত্রীর কটাক্ষ, ‘‘দুর্নীতিতে জর্জরিত বলেই কেন্দ্রীয় সংস্থার তদন্তের বিরুদ্ধে ধর্না হয় এখানে। মুখ্যমন্ত্রী ধর্নায় বসেন। তৃণমূল চায়, লুটে যেন ওদের ছাড় দেওয়া হয়। সে কারণে মোদীকে এক নম্বরের শত্রু মনে করেন। মোদী এ সবে ভয় পান না। আমি কি এই লুট তালাতে দেব? আমি পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে গ্যারান্টি দিচ্ছি, যাঁরা গরিবকে লুটেছেন, তাঁদের হটাতেই হবে। এই মোদী ছাড়ার পাত্র নন। এঁদের গালি বা হামলায়ও ভয় পান না মোদী।’’
মোদী বলেন, ‘‘বাংলায় তৃণমূল অপরাধ, ভ্রষ্টাচারের নতুন মডেল তৈরি করেছে। অপরাধীকে সুরক্ষা দিয়ে তৃণমূল নেতারা টাকা পান।’’ তিনি জানান, শিক্ষক নিয়োগ থেকে পুরসভা নিয়োগ— সব জায়গাতেই দুর্নীতি করেছে তৃণমূল। গরিবদের জন্য জিনিস কিনতে, রেশন, চিটফান্ড, সীমা দিয়ে পশুপাচার— সবেতেই দুর্নীতি করেছে। তাঁর কথায়, ‘‘সে কারণে তৃণমূলের মন্ত্রীদের ঘর থেকে নোটের পাহাড় বার হচ্ছে। এর আগে এত বড় নোটের পাহাড় দেখেছেন? সিনেমাতেও দেখা যায় না।’’
মোদীর কথায় উঠে এসেছে ইন্ডিয়া জোটের প্রসঙ্গ। তিনি বলেন, ‘‘জোটের অনেক নেতা সন্দেশখালির প্রসঙ্গে নাক,কান, মুখ বন্ধ করে বসে রয়েছেন। গান্ধীজির তিন বাঁদরের মতো। পটনা, বেঙ্গালুরু আর কোথায় কোথায় এঁরা এক সঙ্গে বসে বৈঠক করেননি! অথচ বাম এবং কংগ্রেস এখানকার মুখ্যমন্ত্রীর থেকে জবাব চাওয়ার সাহস করেছেন কি? সন্দেশখালির এই বোনদের মতামত এক বারও দেখা হয়নি।’’ তাঁর কথায়, ‘‘কংগ্রেস যা বলেছে, শুনলে চমকে যাবেন। কংগ্রেসের সভাপতি বলেছেন, বাংলায় এ সব চলতেই থাকে। এটা কি বাংলার অপমান নয়! বাংলার সংস্কার, বীরপুরুষের কি অপমান নয়!’’
মোদীর কথায় উঠে এল সন্দেশখালির প্রসঙ্গ। তিনি বলেন, ‘‘বাংলার অবস্থা আজ গোটা দেশ দেখছে। মা, মাটি মানুষ— এই ঢোল যে পেটায়, সেই তৃণমূল সন্দেশখালির বোনদের সঙ্গে যা করেছে, তা দেখে দেশ দুঃখিত।’’ ‘মহিলাদের নির্যাতন’ নিয়ে সরব হলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘যা হচ্ছে সন্দেশখালিতে, তা দেখে রামমোহন রায়ের আত্মা কাঁদছে। যাঁর জন্ম হয়েছিল এই খানাকুলে।’’ তিনি বলেন, ‘‘তৃণমূল নেতা সন্দেশখালিতে দুঃসাহসের সব সীমা পার করেছে। ওখানকার মহিলারা মমতা দিদির কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন। বিজেপির নেতারা রাতদিন মা-বোনদের সম্মানের জন্য লড়াই করেছেন। লাঠির আঘাত সয়েছেন। অবশেষে বৃহস্পতিবার বাংলার পুলিশ আপনাদের সামনে মাথানত করে অভিযুক্তকে গ্রেফতার করেছে।’’ এর পর তিনি বলেন, ‘‘এই তৃণমূলকে কি ক্ষমা করবেন? সব চোটের জবাব ভোটে দিতে হবে। বাংলার লোক দিদিকে বলছে, কিছু লোকের ভোট সন্দেশখালির থেকেও আপনার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’’
মোদীর কথায় উঠে এল অযোধ্যার মন্দির প্রসঙ্গ। তিনি বলেন, ৫০০ বছর পর ঘর পেল রামলালা। নিজের মন্দিরে বিরাজমান বিগ্রহ। পশ্চিমবঙ্গে যে ভাবে রামলালার স্বাগত জানানো হয়েছে, রামের প্রতি যে আস্থা বাংলার, তা দেশ দেখেছে, প্রভাবিত হয়েছে।
মোদী জানান, কিছু ক্ষণ আগেই সাত হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের উদ্বোধন করেছেন। এজন্য রাজ্যবাসীকে অভিনন্দন জানান। তার পরেই দেশের উন্নয়নের প্রসঙ্গ তোলেন। তিনি বলেন, গত ১০ বছরে ভারত অর্থনীতিতে ১১ নম্বর থেকে উঠে পাঁচ নম্বরে এসেছে। জি-২০তে জয়জয়কার হয়েছে দেশের। মহাকাশ গবেষণাতেও অগ্রণী। যা কেউ করতে পারেনি, তা চন্দ্রযান করেছে। ভারত করে দেখিয়েছে। ক্রীড়াজগতেও নতুন রেকর্ড করছে ভারত।
কাছেই খানাকুলে রাজা রামমোহন রায় জন্ম নিয়েছিলেন। তিনি সমাজ সংস্কারক। তাঁর প্রেরণাতেই ভারতে নারীশক্তির উদয়, বলেন মোদী। তাঁর কথায়, ‘‘খানাকুলকে প্রণাম করি।’’ তার পরেই ধন্যবাদ জানিয়েছেন জনতাকে। বলেন, ‘‘এত বিপুল সংখ্যক মানুষ এসেছেন, সকলকে প্রণাম।’’
তারকেশ্বরের মহাদেবের নামে জয়ধ্বনি দিয়ে ভাষণ শুরু মোদীর। বাংলায় সম্বোধন করেন রাজ্যবাসীকে। শুরুতেই বলেন, ‘‘মাতৃশক্তিকে শক্তি জোগায় যে বঙ্গ, তাকে প্রণাম।’’
সুকান্ত আরামবাগের সভায় জানান, শাহজাহানের গ্রেফতারির পর মনে হয়, পুলিশ শাহজাহানকে নয়, শাহজাহান পুলিশকে গ্রেফতার করেছেন। অদৃশ্য দড়ি দিয়ে চালনা করছেন। এর পরেই কটাক্ষ করেন রাজ্য সরকার এবং পুলিশকে।
প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি মঞ্চে উপস্থিত সকলকে স্বাগত জানালেন রাজ্য বিজেপি সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। তার পরেই তোলেন শাহজাহানের গ্রেফতারির প্রসঙ্গ। তিনি বলেন, ‘‘মহিলারা মুখ খুলুন। তৃণমূলকে উৎখাত করুন।’’
শুভেন্দু ভাষণ শেষ করে স্লোগান তোলেন, ‘অব কি বার, ৪০০ পার’। তিনি জানিয়ে দেন, আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে এটাই লক্ষ্য বিজেপির।
প্রতাশ্যামতোই তৃণমূলকে খোঁচা শুভেন্দুর। বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা চুরি হওয়ার অভিযোগ নিয়ে মোদীর সামনে সরব হন শুভেন্দু। বগটুই থেকে সন্দেশখালির প্রসঙ্গও টানেন বিরোধী দলনেতা। তিনি জানান, এই সভা থেকেই শপথ নিয়ে ফিরবেন যে, এ বার লোকসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে ৩৫টি আসন পাবে বিজেপি।
মঞ্চে প্রথম বক্তা শুভেন্দু ‘ভোলে বাবা’ স্লোগান তোলেন। প্রসঙ্গত, শিবধাম তারকেশ্বরের কাছাকাছি আরামবাগে এসে মোদীও সরকারি কর্মসূচিতে বক্তব্য শুরু করেন শিবের নামে ধ্বনি দিয়ে।
মোদীকে মঞ্চে স্বাগত জানালেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার, বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী-সহ রাজ্য নেতারা। পদ্মফুলের মালা পরিয়ে দেওয়া হয় মোদীকে।