গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
শাপমুক্তিই বটে! শূন্যের গেরো কাটিয়ে উত্তরবঙ্গে অবশেষে খাতা খুলল তৃণমূল। সেই খাতায় নথিভুক্ত হল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের ‘ডেপুটি’ অর্থাৎ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিকের হার! তাঁকে হারিয়ে কোচবিহার আসনে জিতলেন তৃণমূল প্রার্থী জগদীশচন্দ্র বসুনিয়া।
উত্তরবঙ্গে মোট আটটি আসন— আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, মালদহ উত্তর, মালদহ দক্ষিণ, রায়গঞ্জ ও বালুরঘাট। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে এই আটটির মধ্যে চারটি তৃণমূলের দখলে ছিল। কিন্তু গত বারের ভোটে উত্তরবঙ্গের সব ক’টি আসনই হারায় তারা। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে এ বারের ভোটে উত্তরে আবার খাতা খোলাই সবচে়ড়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল শাসকদলের কাছে। নিশীথকে হারিয়েই তা পূর্ণ হল। শুধু তা-ই নয়, গত বারের তুলনায় এ বার প্রাপ্ত ভোটের হারও বে়ড়েছে তাদের। ২০১৯ সালের ভোটে উত্তরের আটটি আসন মিলিয়ে তৃণমূল ৩৬ শতাংশের কাছাকাছি ভোট পেয়েছিল। এ বারের ভোটে তা আড়াই শতাংশ বেড়েছে।
অধরা উত্তরের মাটিতে দলের পতাকা দেখতে মরিয়া ছিল তৃণমূল। শাসকদল সূত্রে খবর, ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের পর থেকেই এই পরিকল্পনা করেছিলেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। গত তিন বছরে দফায় দফায় আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি এবং কোচবিহারে সভা-সমাবেশ করেছেন তিনি। স্থানীয় স্তরে রাজনৈতিক এবং সামাজিক বিষয়ে একাধিক সমীক্ষা করিয়ে সেই মতো বেশ কিছু পদক্ষেপের ব্যবস্থাও করেছিলেন অভিষেক। একই সঙ্গে, কোচবিহারে নিশীথের বিরুদ্ধে গোড়া থেকেই কোমর বেঁধে নেমেছিল তৃণমূল। দলের হিসাব, আগের লোকসভা ও বিধানসভা ভোটে না পেলেও এ বার কম-বেশি ৩০ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোট পুরোপুরি তৃণমূলের ঝুলিতে গিয়েছে। সেই সঙ্গে রাজবংশী ভোটের একাংশ বিজেপির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ফলাফলে কার্যত তা-ই প্রতিফলিত হল। দলের জেলাস্তরের এক নেতার কথায়, ‘‘এই অঞ্চলে উত্তরবঙ্গের বঞ্চনার অভিযোগকে আলাদা রাজ্যের দাবিতে নিয়ে গিয়ে প্রচার করে গত লোকসভা বিজেপি বাড়তি সুবিধা পেয়েছিল। এ বার স্থানীয় স্তরে সেই সংক্রান্ত কোনও প্রশ্নেরই জবাব দিতে পারেনি তারা। বরং, তৃণমূল গোটা রাজ্যের সঙ্গে উত্তরবঙ্গের অভিন্ন পরিচিতির পক্ষে মানুষের মন পেয়েছে।’’
জয়ের পর জয়ী তৃণমূল প্রার্থী জগদীশ বলেন, ‘‘এই জয় কোচবিহারবাসীর। দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দলের সেনাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জয়। কোচবিহারবাসী এ বার গুন্ডারাজ খতম করতে চেয়েছিলেন। সেটাই ফলাফলে দেখা গেল।’’ দলীয় কর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশে তাঁর বার্তা, ‘‘আমি সকলকে শান্ত থাকতে বলব। কারণ কোচবিহারের মানুষ দু’হাত ভরে আমাদের আশীর্বাদ করেছেন।’’ তৃণমূল সূত্রে খবর, জগদীশকে জিতিয়ে আনতে উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী উদয়ন গুহের উপর বিশেষ ভাবে নির্ভর করেছিলেন তৃণমূল নেতৃত্ব। দলের জয়ের পর উদয়ন বলেন, ‘‘এটা জয় না, এটা জ্বালা মেটানো। নিশীথ প্রামাণিক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হওয়ার পরে পাঁচ বছর ধরে অত্যাচার চলেছে। বাড়িতে যত সমাজবিরোধীদের আড্ডা, যত বেআইনি অস্ত্র জোগাড় করা, অর্থ দিয়ে মানুষকে কিনে নেওয়ার চেষ্টা— এ সব কিছুর জবাব এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মানুষ দিয়েছেন।’’ তাঁর হুঁশিয়ারি, আগামী বিধানসভা ভোটে কোচবিহারের ন’টি আসনের মধ্যে সব ক’টিতেই বিজেপিকে হারাবে তৃণমূল।
অন্য দিকে, বিজেপির জেলা সম্পাদক বিরাজ পোস্ট বলেন, ‘‘আমাদের যা ফলাফল এসেছে, মানুষের রায়কে সম্মান জানিয়ে তা মেনে নিয়েছি। কোনও ঘাটতি হয়তো আমাদের ছিল। সেটা বুঝতে পারিনি। এটার থেকে আমরা শিক্ষা নিচ্ছি, যাতে আগামীতে আমাদের কোনও ত্রুটি না থাকে। ভোট আসবে, ভোট যাবে। কেউ হারবে, কেউ জিতবে। এটাই গণতন্ত্রের নীতি। কেন আমাদের ফল খারাপ হল, সেটা নিয়ে আমরা বিচার-বিশ্লেষণ করব।’’
শুধু কোচবিহারই নয়, গত বারের তুলনায় দার্জিলিং, আলিপুরদুয়ার আসনেও ভাল ফল করেছে তৃণমূল। শাসকদল সূত্রে খবর, আলিপুরদুয়ারে সাংগঠনিক শক্তি কম। এই লোকসভা কেন্দ্রে সাতটি বিধানসভার একটিও তৃণমূলের হাতে নেই। সে ক্ষেত্রে লোকসভায় জয় না পেলেও ব্যবধান কমানো গিয়েছে। অন্তত দু’টি বিধানসভা আসনে জমিও তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। গত বার দার্জিলিং আসনে চার লাখেরও বেশি ভোটে জিতেছিলেন বিজেপির রাজু বিস্তা। এ বারও তিনি জিতেছেন। কিন্তু ব্যবধান কমে হয়েছে ১ লাখ ৭৬ হাজারের সামান্য বেশি।
এ বার রায়গঞ্জ আসনকে নিশ্চিত প্রাপ্তি বলে মনে করছিলেন তৃণমূলের একাংশ। গত ২০১৯ সালে এই আসনে ৬০ হাজারের বেশি ভোটে পিছিয়ে ছিল তৃণমূল। তবে গত বিধানসভা ভোটে সাতটি আসনের চারটিতে জিতেই বিজেপির থেকে ১ লক্ষ ৩৯ হাজার ভোটে এগিয়ে গিয়েছিল তারা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই আসনে সুবিধা করতে পারল না তৃণমূল। বরং গত বারের থেকেও বেশি ব্যবধানে তৃণমূলের কৃষ্ণ কল্যাণীকে হারিয়েছেন বিজেপির কার্তিকচন্দ্র পাল। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের বালুরঘাট আসনও। সেখানে তৃণমূল রাজ্যের মন্ত্রী বিপ্লব মিত্রকে প্রার্থী করেছিল। মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত সুকান্ত ন’হাজারের বেশি ভোটে এগিয়ে ছিলেন। গত বারের ভোটে মালদহ দক্ষিণ আসনটি জিতেছিল কংগ্রেস। সেই আসন এ বারও তাদের দখলেই রয়েছে। মালদহ উত্তর আসনটিও গত বারের মতো বিজেপির দখলেই থাকছে।