নবীন পট্টনায়েক। — ফাইল চিত্র।
ভোটের ওড়িশায় রাজনৈতিক জল্পনার ভরকেন্দ্রে তাঁর ‘অসুস্থতা’। আড়াই দশকের মুখ্যমন্ত্রী তথা বিজেডির প্রতিষ্ঠাতা-প্রধান নবীন পট্টনায়কের ‘ভগ্নস্বাস্থ্য’ নিয়ে নির্বাচনী প্রচারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী স্বয়ং! সেই সঙ্গে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, এর নেপথ্যে কোনও চক্রান্ত রয়েছে কি না, সে রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য বিশদে তদন্ত করা প্রয়োজন।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের মতে, সরাসরি কোনও নাম না করলেও মোদীর মন্তব্যের নিশানা ছিল প্রাক্তন আমলা তথা বিজেডি নেতা ভি কার্তিকেয়ন পান্ডিয়ানের দিকে। যিনি নবীনের ‘সম্ভাব্য উত্তরসূরি’ বলে ইতিমধ্যেই আলোচনা শুরু হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে এ বার ওড়িশা সরকার এবং শাসকদল বিজেডিতে নেতৃত্ব বদলের সম্ভাবনা সরাসরি খারিজ করলেন নবীন পট্টনায়ক।
সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বৃহস্পতিবার নবীন বলেন, ‘‘আমি বার বার বলেছি, আমার উত্তরসূরি রাজ্যের জনগণই নির্ধারণ করবে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তেমনটাই হওয়া উচিত। তবে এখনই নেতৃত্ব বদলের কোনও সম্ভাবনা নেই।’’ আদতে তামিলনাড়ুর বাসিন্দা পান্ডিয়ান যে তাঁর উত্তরসূরি হওয়ার দৌড়ে নেই, সে কথাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন নবীন। তিনি বলেন, ‘‘উনি (পান্ডিয়ান) তো লোকসভা বা বিধানসভা, কোনও ভোটেই লড়ছেন না।’’ প্রসঙ্গত, লোকসভার পাশাপাশি ওড়িশাতে বিধানসভার ভোটও হচ্ছে।
সম্প্রতি সমাজমাধ্যমে বিজেডির একটি জনসভায় নবীন এবং প্রাক্তন আমলা তথা বিজেডি নেতা ভি কার্তিকেয়ন পান্ডিয়ানের একটি ভিডিয়ো (আনন্দবাজার অনলাইন যার সত্যতা যাচাই করেনি) প্রকাশ্যে এসেছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে, মঞ্চে বক্তৃতা করার সময় ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রীর পোডিয়ামে রাখা হাত আচমকা কাঁপছে। আর দ্রুত নবীনের সেই হাত ধরে সরিয়ে দিচ্ছেন পান্ডিয়ান। তার পরেই মোদী ওড়িশায় ভোটপ্রচারে গিয়ে বলেন, ‘‘নবীনবাবুর প্রত্যেক শুভাকাঙ্ক্ষী এখন উদ্বিগ্ন এবং চিন্তিত। গত এক বছরে তাঁর স্বাস্থ্যের গুরুতর অবনতি হয়েছে। যাঁরা বছরের পর বছর ধরে তাঁর ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে যখন আমার দেখা হয়, তাঁরা প্রায়শই ওঁর (নবীন) স্বাস্থ্যের অবস্থা নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁরা আমাকে বলেন, তিনি নিজে কিছুই করতে পারেন না। এখন প্রশ্ন হল, নবীনবাবুর শারীরিক অবস্থার অবনতির পিছনে কোনও ষড়যন্ত্র আছে কি না। নবীনবাবুর নামে ওড়িশায় পর্দার আড়ালে থেকে ক্ষমতা ভোগ করা গোষ্ঠীর কোনও হাত আছে কি না।’’
মোদী কোনও নাম না বললেও ইতিমধ্যেই তাঁর কথার সূত্র ধরে পান্ডিয়ানকে নিশানা করেছেন ওড়িশার বিজেপি নেতারা। প্রসঙ্গত, ২০০০ ব্যাচের আইএএস পান্ডিয়ান ময়ূরভঞ্জ এবং গঞ্জামের মতো ওড়িশার দুই পিছিয়ে পড়া জেলার কালেক্টর (জেলাশাসক) থাকার সময়ে প্রান্তিক জনজাতিদের কল্যাণে কাজ করে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেন। নজরে পড়েন মুখ্যমন্ত্রী নবীনের। ২০১১-এ মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে ব্যক্তিগত সচিব পদে নিয়োগ করার পরে ১২ বছর ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয় (সিএমও)-এর শেষ কথা হয়ে উঠেছিলেন জন্মসূত্রে তামিল, বছর পঞ্চাশের ওই আমলা।
অবশেষে আইএএস-এর চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে ২০২৩ সালের কার্তিক পূর্ণিমায় জগন্নাথকে প্রণাম করে শাসকদল বিজেডির সদস্যপদ নেন পান্ডিয়ান। তাঁকে পূর্ণমন্ত্রীর পদমর্যাদায় ‘ফাইভ টি’-র চেয়ারম্যান করে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী নবীন। ২০৩৬-এ শতবর্ষে পা দিচ্ছে ওড়িশা। তার আগে প্রতিটি ক্ষেত্রে রাজ্যকে দেশের প্রথম সারিতে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে নবীন তৈরি করেছেন এই ‘ফাইভ টি’। পাঁচটি ‘টি’ হল ট্রান্সপারেন্সি (স্বচ্ছতা), টেকনোলজি (প্রযুক্তি), টিমওয়ার্ক (দল বেঁধে কাজ), টাইম (নিয়মানুবর্তিতা) এবং ট্রান্সফরমেশন (পরিবর্তন)।
পান্ডিয়ানের স্ত্রী ওড়িশা ক্যাডারের আমলা সুজাতা নবীন সরকারের জনপ্রিয়তার আর এক স্তম্ভ ‘মিশন শক্তি’-র প্রধান। মহিলা কল্যাণে সরকারের প্রকল্পগুলিকে সমন্বিত করে পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে এই সংস্থা। আর্থিক অনগ্রসর মহিলাদের স্বনির্ভর গোষ্ঠী গঠনের মাধ্যমে বিজেডির মহিলা ভোটব্যাঙ্ক অটুট রাখার ক্ষেত্রে ‘মিশন শক্তি’-র ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের মত। এই পরিস্থিতিতে নবীনের উত্তরসূরি হিসাবে তাঁর নাম নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছিল ওড়িয়া রাজনীতিতে। শেষ পর্বের ভোটের আগে তাতে ‘জল ঢেলে দিলেন’ স্বয়ং নবীন।