অমেঠীতে প্রিয়ঙ্কা গান্ধী বঢরা। —নিজস্ব চিত্র।
“প্রিয়ঙ্কাদিদি লড়লে অন্তত এক লক্ষ ভোটে কংগ্রেস জিতত।”
আফশোসের সুর অমেঠীর অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী রেণু যাদবের গলায়। অমেঠীর তিলোই মহকুমায় প্রিয়ঙ্কা গান্ধী বঢরার মহিলা সম্মেলন সবে শেষ হয়েছে। প্রয়াত কংগ্রেস নেতা শিব প্রতাপ সিংহের বাড়ির উঠোনে গোটা তিলোইয়ের মহিলাদের ভিড় তখনও হালকা হয়নি।
চল্লিশ ডিগ্রি গরমে ঘামতে ঘামতে প্রিয়ঙ্কা বক্তৃতা করছিলেন। দু’তিন বার মাইক্রোফোনের সমস্যা হল। প্রিয়ঙ্কা মঞ্চ থেকে নেমে সোজা মহিলাদের সামনে চলে এলেন। এবং অমেঠীর ভোটারদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অনুযোগ করলেন, “আপনারা গত লোকসভা ভোটে আমার দাদাকে হারিয়ে দিয়েছেন।”
বারবার গোলাপি সালোয়ার-কামিজের ওড়নায় ঘাম মুছতে হচ্ছিল। সভা শেষ করার আগে প্রিয়ঙ্কা বললেন, “আগামী ২০ মে শুধু ভোটযন্ত্রে কংগ্রেসের হাত চিহ্নের পাশে বোতাম টিপলেই চলবে না! ভোট পড়ল কি না, তা ভোটযন্ত্রের আওয়াজ শুনে নিশ্চিত হতে হবে। সেই ভোট কংগ্রেসের ঝুলিতেই গেল কি না, তা ভিভিপ্যাট যন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসা কাগজে দেখে নিশ্চিত হতে হবে।”
রেণু যাদব বলছিলেন, এত কিছু নিয়ে ভাবতেই হত না যদি প্রিয়ঙ্কা নিজে প্রার্থী হতেন। তিনি স্মৃতি ইরানিকে অন্তত এক লক্ষ ভোটে হারতেন।
আর এখন? ‘কাঁটে কা টক্কর’!
দেশের অন্যতম ভিভিআইপি লোকসভা কেন্দ্র অমেঠীর ধুলো ওড়া রাস্তা, সরু সরু খানাখন্দে ভরা অলিগলি, মাছি ভনভন করা ‘পিয়োর ভেজ’ ধাবার গুলতানি বলছে, অমেঠীতে এ বার ‘কাঁটে কা টক্কর’। বিজেপির স্মৃতি ইরানি বনাম কংগ্রেসের কিশোরীলাল শর্মার লড়াই সমানে সমানে।
গত লোকসভা নির্বাচনে গান্ধী পরিবারের গড় বলে খ্যাত এই অমেঠীতেই স্মৃতি রাহুল গান্ধীকে হারিয়ে দিয়েছিলেন। ভোটের ব্যবধান ছিল ৫৫ হাজারের বেশি। এ বার জাতপাতের অঙ্কে আবার দাঁড়িপাল্লা কিছুটা কংগ্রেসের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। কংগ্রেস গত চল্লিশ বছর ধরে অমেঠী-রায়বরেলীতে গান্ধী পরিবারের দূত, সনিয়া গান্ধীর সংসদীয় প্রতিনিধি কিশোরীলাল শর্মাকে প্রার্থী করেছে। কিশোরীলাল ব্রাহ্মণ। অমেঠীতে প্রায় ৮ শতাংশ ব্রাহ্মণ ভোট রয়েছে। তাঁদের বড় অংশ বিজেপির উপরে ক্ষুব্ধ। কারণ জাতে ঠাকুর যোগী আদিত্যনাথের রাজত্বে ব্রাহ্মণরা নাকি সম্মান পাচ্ছেন না! এর সঙ্গে ২৬ শতাংশ দলিত ভোট এবং প্রায় ২০ শতাংশ মুসলিম ভোট কংগ্রেসের ঝুলিতে যোগ হতে পারে। আসন সমঝোতায় সমাজবাদী পার্টির নিজস্ব যাদব ভোটও কংগ্রেসে আসবে। এর উপরে প্রিয়ঙ্কা নিজে দাঁড়ালে নিজস্ব ‘ক্যারিশ্মা’তেই আরও ভোট পেতেন। গান্ধী পরিবারের পুরনো ভোটব্যাঙ্কে যে ভাঙন ধরেছিল, তা-ও ফিরে আসত।
দিনভর খান দশেক জনসংযোগ কর্মসূচি, আধ ডজন জনসভায় প্রিয়ঙ্কা অমেঠীর সঙ্গে গান্ধী পরিবারের পুরনো সম্পর্কই বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন। সেচের জলে অমেঠীর চাষের খেত এখন সবুজ। বাবা প্রধানমন্ত্রী হলেও অহঙ্কারী ছিলেন না। কোনও কাজ মন মতো না হলে বাবাকে অমেঠীর মা-দিদিরা কত বার বকে দিয়েছেন। বাবা বলতেন, অমেঠীর মানুষের সেই অধিকার রয়েছে।”
যাঁকে নিয়ে কটাক্ষ, সেই স্মৃতি ইরানি শুধু অমেঠীতে জাঁকিয়ে বসেননি। অমেঠীর জেলা সদর গৌরীগঞ্জে নিজের বাড়ি বানিয়ে ফেলেছেন। ভোটের আগেই পুজোআচ্চা করে গৃহপ্রবেশ হয়েছে। ঘরে ঘরে মোদী সরকারের গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনার বিনামূল্যে রেশন, বছরে পিএম-কিসানের ৬ হাজার টাকা পৌঁছচ্ছে। আবাস যোজনা থেকে উজ্জ্বলা— সব কৃতিত্ব আঁচলে করে কুড়িয়ে নিচ্ছেন স্মৃতি। এই সরকারি প্রকল্পের সুবিধাপ্রাপ্ত ‘লাভার্থী’ তাঁর ভোটব্যাঙ্ক। আর গান্ধী পরিবারের দিকে চোখা প্রশ্ন, “গত পাঁচ বছরে গান্ধী পরিবারের কোন সদস্য কত বার অমেঠীতে এসেছেন, সেই হিসেব কে দেবেন?” কংগ্রেসের নেতারা মানছেন, এই ‘লাভার্থী ভোটব্যাঙ্ক’ কঠিন চ্যালেঞ্জ। প্রিয়ঙ্কাকে তাই বলতে হচ্ছে, ‘‘রেশন দিচ্ছে, ভাল কথা। কিন্তু সেই রেশনের গ্যারান্টি দিতে খাদ্য সুরক্ষা আইন ইউপিএ-সরকারের তৈরি। আর শুধু রেশন দিলে তো হবে না! রোজগার কোথায়? রেশন না রোজগার, কোনটা বাছবেন?’’ সব প্রতিশ্রুতি পূরণ না হলেও অমেঠীর মানুষ এখনও স্মৃতি ইরানির উপরে ক্ষুব্ধ নন। তাঁর চ্যালেঞ্জ বিজেপির বাইরে নয়, অন্দরমহলে। স্মৃতির চারপাশে এখন বিজেপির যে সব নেতা ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তাঁদের নিয়ে বিজেপির মধ্যেই ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।
রেণু যাদব কংগ্রেসের গ্যারান্টি কার্ড হাতে বাড়ি ফেরার আগে বলে গেলেন, “প্রিয়ঙ্কাদিদি ভোটে লড়লে জয় নিশ্চিত ছিল। কিন্তু..!” অমেঠীর আফশোসটা থেকেই গেল।