হাওড়া স্টেশনে পরিযায়ী শ্রমিকেরা। —ফাইল চিত্র।
দুপুরের হুহু মরু-হাওয়ায় ফোনের ওপারে কথাগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছিল— ‘ভোটের দিন যাওয়া হবে কী করে...কম সে কম পাঁচ-ছ’টা দিন ছুটি লাগবে তো...পাসপোর্ট তো আটকে রাখস্যে!’
গলায় এখনও পদ্মা-ঘেঁষা গাঁয়ের মুর্শিদাবাদি টান। ঘর, আবাদ, বাপ-মা দু’টো বোন আর বউ—আবাল্য বেড়ে ওঠা ডোমকলের গ্রামে বাকিটুকু ফেলে রেখে আড়াই বছর আগে ঘর ছেড়েছিলেন তিনি। ‘মোটর মিস্ত্রি’ হওয়ার স্বপ্নে বুক বেঁধে আতিকুর বিশ্বাস উড়ে গিয়েছিলেন আরব আমীরশাহী। ঠিকাদারের জিম্মায় পাসপোর্ট রেখে তিনি এখন পাকাপাকি মেষপালক আর পার্ট-টাইম ‘রোয়াকি’ (খেজুর পাতা ঝাড়ার কাজ)। দৈনিক খোরাকি, ৫৫ দিরহাম (ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ১২৪৬ টাকা)।
উপার্জনের সেই অমোঘ টানে পরবাসী হয়ে গত বিধানসভা কিংবা পঞ্চায়েত কোনও ভোটেই আর ঘরে ফেরা হয়নি তাঁর। নদিয়া, মুর্শিদাবাদ কিংবা মালদহের এমনই অজস্র আতিকুর পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে এ বারও সরে থাকছে আরবের নানান মরু প্রান্তরে।
সংখ্যাটা প্রায় ২৯ হাজার, তথ্য দিচ্ছে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের পৃষ্ঠপোষকতায় চলা স্বশাসিত সংস্থা ‘ইন্টারন্যশনাল ইন্সটিটিউট ফর পপুলেশন সায়েন্স’ (আইআইপিএস)। ইন্সটিটিউটের ‘মাইগ্রেশন অ্যান্ড আর্বান স্টাডিজ়’ বিভাগ থেকে সদ্য অবসর নেওয়া অধ্যাপক রামবাবু ভগত বলছেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু প্রভাবিত এই জেলাগুলি থেকে ফি বছর রুজির টানে আরব দেশগুলিতে হারিয়ে যায় কয়েক হাজার মানুষ। হ্যাঁ, ‘হারিয়ে’ শব্দটা ঝুঁকি নিয়েই ব্যবহার করলাম। কারণ এঁদের অনেকেরই পরবর্তী কালে আর খোঁজ মেলে না। ঠিকাদারের হাতেই থেকে যায় এদের প্রাণভোমরা, পাসপোর্ট! ঠিকাদার বদলে গেলে মাঝে মধ্যেই এক দেশ থেকে আর অন্য দেশে হারিয়ে যায় তারা। আর, পাকাপাকি ভাবে পরিযায়ী হয়ে যাওয়া এই শ্রমিকদের কাছে নির্বাচন তাই অলীক হয়েই থেকে যায়।’’
দেশের পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে প্রায় দেড় দশক কাজ করছেন পুণে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ভাস্কর মাত্রে। তাঁর পর্যবেক্ষণ, ‘‘করোনা-কাল পেরিয়ে পরিযায়ী শ্রমিকেরা বুঝি আরও মরিয়া হয়ে উঠেছেন। রাজমিস্ত্রি থেকে কাঠের কাজ, জাহাজের নাবিক থেকে মুটে-মজুর, নিতান্তই অসংগঠিত ক্ষেত্রে তাঁরাই এখন পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া কিংবা আরব দেশগুলির সুলভ শ্রমিক। তাঁদের চাহিদাও যথেষ্ট। যাঁদের সংখ্যা যে ঠিক কত লক্ষ, তার স্পষ্ট হিসেব সরকারের কোনও মন্ত্রকের কাছে নেই। বছরের পর বছর এই সংখ্যক দেশবাসীর সিংহভাগ কিন্তু ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন না।’’
এ দেশের চৌহদ্দির মধ্যে থেকেও ভোটের সকালে গ্রামের বুথে ফিরতে পারেন না বহু পরিযায়ী। ওড়িশার গঞ্জাম জেলার সুরাদা গ্রামের কার্ত্তিক নায়েককে এ বারও কেরলের এর্নাকুলমের কাছে এক নতুন জনপদে রাজমিস্ত্রির কাজেই ব্যস্ত থাকতে হবে। কার্ত্তিকের কথায়, ‘‘১৮০০ কিলোমিটার উজিয়ে ভোট দিতে গেলে এখানকার কাজটা খোয়াতে হবে যে! লকডাউনের দিনগুলো দেখেছি, বাড়ির লোকগুলোকে আর অভুক্ত রাখতে চাই না!’’
ভোটাধিকার প্রয়োগের প্রশ্নে মালিকপক্ষ তো সবেতন ছুটি দিতে বাধ্য?
রামবাবু জানান, অসংগঠিত ক্ষেত্রে সে সব নিয়ম নিছক 'কেতাবেই লেখা থাকে, মান্যতা দেওয়ার রেওয়াজ নেই!' পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত আর ভোটবাক্স পর্যন্ত পৌঁছতে পারেননি এক কোটিরও বেশি পরিযায়ী শ্রমিক।