মধ্যপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কমল নাথ। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হচ্ছে। স্পষ্ট ইঙ্গিত, তৃতীয় বারের জন্য সরকার গড়তে চলেছে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট। কিন্তু গত দু’বারের মতো এই ফলে ‘স্বস্তি’ নেই বিজেপির। তারা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে এ বার বেশ খানিকটা পিছিয়ে। সরকার গড়তে এনডিএ-র শরিক দলের উপর ভরসা করতে হবে মোদীকে। দেশ জুড়ে যখন গণনার এই ‘ট্রেন্ড’ মোটামুটি স্পষ্ট, তখনও কিন্তু বিজেপির স্বস্তি একটাই— মধ্যপ্রদেশ। এই রাজ্যের ২৯টি আসনেই একতরফা জয়ী বিজেপি প্রার্থীরা। এমনকি, নিজের ‘গড়’ ছিন্দওয়াড়াও হারিয়ে ফেললেন রাজ্যের প্রাক্তন কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রী কমল নাথ।
মধ্যপ্রদেশে মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ বিপুল ভোটে জিতেছেন। বিদিশা কেন্দ্রে তাঁর ব্যবধান আট লক্ষের বেশি, যা দেশের মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ। গুনা কেন্দ্রে জ্যোতিরাদিত্য শিন্ডে জিতেছেন ৫.৪০ লক্ষ ভোটে। শিন্ডে বংশের অন্যতম ‘গড়’ গোয়ালিয়রে বিজেপি জিতেছে ৭০ হাজারের বেশি ভোটে। এ ছাড়া, রাজধানী শহরের কেন্দ্র ভোপালেও পাঁচ লক্ষের বেশি ভোটে জিতেছে বিজেপি। কমল নাথ এ বার ভোটে দাঁড়াননি। তাঁর কেন্দ্রে দাঁড়িয়েছিলেন পুত্র নকুল নাথ। তিনি হেরে গিয়েছেন। নির্বাচন কমিশনের পরিসংখ্যান বলছে, ছিন্দওয়াড়াতে বিজেপি জিতেছে ১.১৩ লক্ষ ভোটে।
২৯টি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যপ্রদেশে বরাবর আলোচনায় থেকেছে বিজেপি-কংগ্রেসের দ্বিমুখী লড়াই। গত দু’টি লোকসভা নির্বাচনে এই রাজ্য ‘পদ্মের ঝড়’ দেখেছে। যার দাপটে খড়কুটোর মতো উড়ে গিয়েছে কংগ্রেস। ২০১৪ সালে দু’টি এবং ২০১৯ সালে মাত্র একটি আসন এই রাজ্য থেকে পেয়েছিল প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কমলের দল। তবে ভোটের ফলাফল যা-ই হোক, মধ্যপ্রদেশ কখনও রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু থেকে সরে যায়নি। তার অন্যতম কারণ এখানকার রাজনীতির চমকে দেওয়া স্বভাব। জ্যোতিরাদিত্যের বিজেপি-যোগ, কংগ্রেস সরকারে আচমকা ভাঙন— উত্থানপতন লেগেই আছে মধ্যপ্রদেশে।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
২৩০ আসনের বিধানসভায় ১৬৫টিতে জিতে ২০১৩ সালে মধ্যপ্রদেশে সরকার গড়েছিল বিজেপি। ২০১৮ সালেই তাদের ধাক্কা দেয় কংগ্রেস। বিএসপি এবং নির্দলদের সমর্থনে সে বার সরকার গড়ে ‘হাত’ শিবির। শিবরাজ সিংহ চৌহানের পরিবর্তে মুখ্যমন্ত্রী হন কমল নাথ। যদিও সেই কংগ্রেস সরকার দু’বছরের বেশি টেকেনি। ২২ জন বিধায়ককে সঙ্গে নিয়ে ২০২০ সালে জ্যোতিরাদিত্য বিজেপিতে যোগ দেওয়ায় পাশা পাল্টে যায় মধ্যপ্রদেশ রাজনীতির। কংগ্রেস সরকার পড়ে যায়। আবার মুখ্যমন্ত্রী হন শিবরাজ। পরে ২০২৩ সালের নির্বাচনে রাজ্যে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় বিজেপি। তবে আর শিবরাজ নয়, নতুন মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মধ্যপ্রদেশে মোহন যাদবকে দায়িত্ব দেন নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহেরা। দীর্ঘ ১৬ বছর মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলেছেন শিবরাজ। সেই কুর্সি ছেড়ে আসার পর তাঁকে এ বার লোকসভার লড়াইয়ে পাঠিয়েছিল বিজেপি। সুষমা স্বরাজের পুরনো কেন্দ্র বিদিশা থেকে ভোটে দাঁড়ান প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। পদ্মের অন্দরে গুঞ্জন, দল ক্ষমতায় এলে তাঁকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী করা হতে পারে। আলাদা করে এই কেন্দ্রের দিকে তাই নজর ছিল। বিধানসভার অঙ্ক মধ্যপ্রদেশের লোকসভার সমীকরণেও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করেছিলেন অনেকে।
২০১৪ সালের বিজেপি ঝড়ের মধ্যেও গুনা এবং ছিন্দওয়াড়া দখলে রেখেছিল কংগ্রেস। জয়ের নেপথ্যে ছিলেন দুই কারিগর— জ্যোতিরাদিত্য এবং কমল নাথ। মধ্যপ্রদেশের রাজনীতির ক্ষেত্রেও এই দুই কেন্দ্র আলাদা ‘তাত্পর্য’ বহন করে। ২০১৯ সালে ছিন্দওয়াড়া ধরে রাখলেও কংগ্রেসের হাত থেকে বেরিয়ে যায় শিন্ডের গুনা। তার পরের বছরই ‘হাত-ছাড়া’ হন শিন্ডে স্বয়ং। বর্তমানে তিনি কেন্দ্রের অসামরিক বিমান পরিবহণমন্ত্রী। এ বারও গুনা থেকেই তাঁকে প্রার্থী করেছিল বিজেপি। জিতেছেন বড় ব্যবধানেই।
গোয়ালিয়র রাজপরিবারের সদস্য শিন্ডে। বংশ পরম্পরায় গুনা কেন্দ্রে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এসেছেন তাঁরা। তবে তাঁর পরিবারের অন্দরেই বিজেপি এবং কংগ্রেসের স্পষ্ট বিভাজন ছিল। শিন্ডের পিতামহী তথা গোয়ালিয়রের রাজমাতা বিজয়া রাজে শিন্ডে জনসঙ্ঘের সঙ্গে জন্মলগ্ন থেকে যুক্ত ছিলেন। যেখান থেকে বিজেপির উৎপত্তি। জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তিনি। আজীবন বিজেপিতেই ছিলেন। তাঁর কন্যা বসুন্ধরা রাজে শিন্ডেও মধ্যপ্রদেশ বিজেপির শীর্ষস্থানীয় মুখ। রাজস্থানের দু’বারের মুখ্যমন্ত্রী তিনি। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও হয়েছিলেন। কিন্তু বিজয়ার পুত্র মাধবরাও ১৯৮০ সালে কংগ্রেসে যোগ দেন। গোয়ালিয়র রাজ পরিবার রাজনীতির মতপার্থক্যে দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়। জ্যোতিরাদিত্যও বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে কংগ্রেসি রাজনীতি করেছেন দীর্ঘ দিন। তবে ২০১৯ সালে কংগ্রেসের টিকিটে গুনায় তিনি হেরে যান। পরের বছর যোগ দেন বিজেপিতে। জ্যোতিরাদিত্যের দলবদলের পর বর্তমানে গোয়ালিয়র রাজপরিবারে রাজনীতির ভাগাভাগি প্রায় নেই বললেই চলে। সম্পূর্ণ সমর্থন বিজেপির দিকে চলে এসেছে। মধ্যপ্রদেশের ইতিহাস বলছে, গোয়ালিয়র এবং গুনা আসনে এখনও শেষ কথা বলে শিন্ডে বংশই। তাই এই পরিবারের রাজনৈতিক সমীকরণ রাজ্যের নির্বাচনী ফলাফলেও বিস্তর প্রভাব ফেলে। যা দেখা গিয়েছিল গত দু’টি লোকসভা ভোটেও।
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কমল নাথের ‘দুর্গ’ ছিন্দওয়াড়া। ২০২৩-এর বিধানসভা নির্বাচনে মধ্যপ্রদেশ জুড়ে যখন ‘কমল’ ফুটছে, ছিন্দওয়াড়ায় বিপরীত স্রোত ধরে রেখেছিলেন কংগ্রেসের কমল। নিজের কেন্দ্রে জয় পান তিনি। তবে লোকসভায় আর দাঁড়াননি। ওই আসন থেকে কংগ্রেসের টিকিটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন তাঁর পুত্র নকুল নাথ। গত ফেব্রুয়ারিতে কমলের বিজেপিতে যোগ দেওয়ার বিষয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছিল। পুত্রকে নিয়ে দিল্লিতে পৌঁছেও গিয়েছিলেন তিনি। এমনকি, নকুল সমাজমাধ্যমে নিজের নামের পাশ থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন কংগ্রেসের নাম। পিতা-পুত্রের কংগ্রেস ত্যাগের জল্পনা তাতে আরও জোরদার হয়। তবে শেষ পর্যন্ত তাঁরা ‘হাত’ ছাড়েননি।
ভোপালে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী দিগ্বিজয় সিংহকে হারিয়ে ২০১৯ সালে সাংসদ হন প্রজ্ঞা ঠাকুর। নানা সময়ে নানা মন্তব্যের কারণে বিতর্কে জড়িয়েছেন তিনি। এ বার আর তাঁকে টিকিট দেওয়া হয়নি। বদলে রাজধানী শহরের কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী করেছিল অলোক শর্মাকে। তাই আলাদা করে নজর ছিল এই কেন্দ্রের দিকেও। এ ছাড়াও মধ্যপ্রদেশে এ বার জবলপুর, সাগর, দমোহ-সহ আরও ১১টি কেন্দ্রে প্রার্থী বদল করেছিল বিজেপি। তাঁরা দলের ভরসার প্রতি সুবিচার করতে পারেন কি না, সেটাই ছিল দেখার।