প্রস্তুত ডিসিআরসি, আজ এখান থেকেই ভোটের সামগ্রী নিয়ে ভোট কেন্দ্রে যাবেন ভোট কর্মীরা, জলপাইগুড়িতে। ছবি - সন্দীপ পাল।
উনিশে এপ্রিল খুলবে প্রথম পরীক্ষার প্রশ্নপত্র। ঠিক এ ভাবেই প্রথম দফার ভোটকে বর্ণনা করলেন কোচবিহার শহরের এক চা-দোকানি। সাগরদিঘির কাছেই তাঁর দোকান। রোজ দু’বেলা দোকানের আড্ডায় এখন মাঝে মাঝেই ভোট-আলোচনা। শুনতে শুনতে তিনি বলেন, ‘‘পরীক্ষার আগে সবাই কি সমান ভাবে তৈরি?’’
কতকটা যেন তাঁর কথারই সুর ঘোরাফেরা করছে রাজনৈতিক দলগুলির শিবিরে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের কথায়, প্রধান দলগুলির নেতা-নেত্রীদের মিটিং-মিছিলেই সেই ছবিটা অনেকাংশে স্পষ্ট। তৃণমূল নেত্রী যেমন ময়নাগুড়ির প্রচার সভা থেকে সরাসরি প্রশ্ন করেছেন, তাঁরা এত কাজ করা সত্ত্বেও কেন বার বার বিজেপিকেই ভোট দিচ্ছেন উত্তরবঙ্গের মানুষ? সেই টনের্ডোর পর থেকে তিন দফায় তিনি কার্যত মাটি কামড়ে রয়েছে উত্তরবঙ্গে। উল্টো দিকে, প্রস্তুতি থেকে প্রচার, একাধিক বার এসেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও। আসার আগে প্রতি বার তিনি নিজের ‘এক্স হ্যান্ডল’-এ বাংলায় বার্তা দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষের জন্য।
পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০১৯-এ জলপাইগুড়িতে লোকসভা ভোট ঘোষণার মাসখানেক আগে প্রধানমন্ত্রী এসেছিলেন সরকারি কর্মসূচি এবং দলীয় জনসভা। মুখ্যমন্ত্রী সে বার প্রচার-সভা করেন দু’টি। তৃণমূলের সর্ব ভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় একটি। ২০২১-এ বিধানসভা ভোটের আগে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী বিজেপির যোগী আদিত্যনাথ এবং সে দলের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি সভা করেন। মমতা করেছিলেন তিনটি সভা, অভিষেক দু’টি।
২০২৪-এর লোকসভা ভোটের আগে মুখ্যমন্ত্রী চারটি সভা এবং একটি পদযাত্রা, অভিষেক দু’টি সভা করেছেন এবং একটি পদযাত্রা করেছেন। প্রথম দফা ভোট যে এলাকায় হবে, সেখানে মোদী করেছেন তিনটি প্রচারসভা (তার বাইরেও গৌড়বঙ্গে তিনি এর মধ্যে আরও দু’টি সভা করেছেন। যদিও সেখানে ভোটগ্রহণ ২৬ এপ্রিল)। পাশাপাশি, অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তীর রোড-শো এবং রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর একাধিক সভা হয়েছে।
হঠাৎ এই আসনগুলিতে এত জোর কেন? রাজনৈতিক মহলের মতে, গত লোকসভা ভোট থেকে গোটা এলাকা ‘বিজেপিপন্থী’। সেই ভোটব্যাঙ্ক টিকিয়ে রাখতে চাইছে কেন্দ্রের শাসক দল, যাতে পুরভোট এবং পঞ্চায়েত ভোটের ছাপ লোকসভায় না পড়ে। আবার তৃণমূল চাইছে গত দু’বছরের ‘সাফল্য’ দিল্লির ভোটেও নিয়ে আসতে।
কোচবিহার সদরে রাসমেলার মাঠে সভা করেন মোদী এবং মমতা। মুখ্যমন্ত্রী এ বারে কোচবিহার জেলায় চারটি সভা করেছেন। তার মধ্যে তিনটি কোচবিহার লোকসভার মধ্যে। বাকি একটি আলিপুরদুয়ার লোকসভার অংশ তুফানগঞ্জে। অভিষেক তিন দিন এসেছেন কোচবিহারে। সিতাইয়ে দলের মিছিল, কোচবিহার উত্তরে সভা করেন তিনি। প্রচারে এসেছেন ঘাটালের সাংসদ দেব, মন্ত্রী শশী পাঁজাও।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর দলের হয়ে প্রচার সভা করেছেন তিনটি। কোচবিহারের রাসমেলার মাঠ ছাড়াও শিলিগুড়ি সংলগ্ন কাওয়াখালি এবং জলপাইগুড়ির ধূপগুড়িতে। তিনটি সভা করেছেন শুভেন্দুও। প্রচারে এসেছিলেন মিঠুন চক্রবর্তী, দলের অন্যতম কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক সুনীল বনসল, দলের রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। পক্ষান্তরে, পাঁচ বছর আগে কোচবিহারে মোদী, মমতা সভা করলেও অন্য নেতা এবং তারকা প্রচার ছিল তুলনামূলক ভাবে কম। তখন অবশ্য শুভেন্দু তৃণমূলে ছিলেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, বিজেপির নিশীথ প্রামাণিক কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হওয়ায় আসনের গুরুত্ব বেড়েছে। তৃণমূলের একাংশ মনে করে, গত বার ‘গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব’ তাদের ডুবিয়েছিল। তাই নিশীথকে টক্কর দিতে প্রচারের তীব্রতা বাড়ানো হয়েছে।
গত লোকসভা নির্বাচনে আলিপুরদুয়ার শহরের প্যারেড গ্রাউন্ডে জনসভা করেছিলেন অমিত শাহ। এ বারেও বিজেপির জেলা নেতৃত্ব চেয়েছিলেন, শাহ তো বটেই, মোদীও তাঁদের জেলায় সভা করুন। কিন্তু তাঁদের কেউই নির্বাচনী প্রচারে আলিপুরদুয়ারে আসেননি। ফলে, কিছুটা ‘হতাশ’ বিজেপির নিচু তলার নেতা-কর্মীদের একটা বড় অংশ। গত লোকসভা ভোটে তিনটি জনসভা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, একটি অভিষেক। এ বারেও সংখ্যাটা একই আছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে অভিষেকের পদযাত্রা। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষদের মতে, দলের জোর কম বলে আলিপুরদুয়ারকে বাড়তি গুরুত্ব দিয়েছে তৃণমূল।
‘‘বাকিটা পরীক্ষকদের হাতে,’’ বললেন এক তৃণমূল নেতা। পরীক্ষক কে? তাঁর কথায়, ‘‘কেন, জনতা জনার্দন!’’