—প্রতীকী চিত্র।
নীরবতা সম্মতি বা সমর্থনের ইঙ্গিত। নাকি বিদ্রোহের!
চায়ের ঠেকেই নাকি রাজনীতির নাড়ির গতি বোঝা যায়। আঙুলে কালি লাগিয়েই ভোটাররা যে সেই আঙুল মুখে দিয়েছেন চায়ের চুমকে কি ফাঁক হবে সে মুখ? অগত্যা গন্তব্য শহর মেদিনীপুরের এক চায়ের ঠেক। ভোটের নানা কথা সেখানে। কারও মতে, একাংশ বাম সমর্থকের ভোট এ বারও বড়ফুলে যাবে। কারও মতে, ছোটফুলের কিছু ভোটও বড়ফুলে যাবে! আবার কারও মতে, এ বারের ভোটেই মালুম হবে লক্ষ্মীর ভান্ডারের প্রভাব। আড্ডা থেকে তর্ক জুড়ছে। কাকে ভোট দিয়েছেন? পাল্লা কার দিকে ভারী? প্রশ্ন করতেই কিছুক্ষণ চুপ সকলে! সবাই- ই স্পিকটি নট!
কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা ভাঙলেন একজন। বললেন, ‘‘এটা বললে তো হয়েই গেল! দেখুন না, আর তো মাত্র ক’টা দিন।’’ জুড়লেন, ‘‘ধরে নিন, ভোট কোনও একটা ফুলেই দিয়েছি!’’ পাশের একজন বললেন, ‘‘বড়ফুল না ছোটফুল, ওটা এ ভাবে বলা যায় কি! চুপচাপ ফুলে ছাপ দিয়েছি, এটা কিন্তু বলা যায়!’’
চুপচাপ এই ছাপ দেওয়া থেকে কোনও পরিবর্তনের ইঙ্গিত মিলছে কি, চর্চা শুরু হয়েছে। সেদিন মেদিনীপুরে ও ঝাড়গ্রামে এসেছিলেন এক ভোট-সমীক্ষক সংস্থার কর্মী। ভিন্ রাজ্য থেকে। কাজের সূত্রে বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরেছেন তিনি। তাঁর অভিজ্ঞতা, ভোট প্রসঙ্গে এখানকার লোকজন যতটা চুপচাপ, অন্য রাজ্যের লোকজন ততটা চুপচাপ নন। বাংলার সঙ্গে বিহারের তুলনা টেনে তিনি বলছিলেন, ‘‘ভোট নিয়ে কথা বলতে গেলে দেখছি এখানকার ভোটাররা চুপ হয়ে যাচ্ছেন। বিহারে গিয়ে আমার অভিজ্ঞতা অন্য। আমি যা জানতে চেয়েছি, তার থেকেও বেশি বলেছেন ওখানকার ভোটাররা।’’ ভোটারদের এমন নীরবতায় বিস্মিত ভোট-সমীক্ষক সংস্থার ওই কর্মী। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘কিসের জন্য এত চুপচাপ? ভয়ে?’’ অনেকের মতে, অন্যবার কিন্তু এত রাখঢাক-গুড়গুড় করেন না অনেকেই। জেলা বিজেপির মুখপাত্র অরূপ দাসের কথায়, ‘‘মানুষ চুপচাপ পদ্মফুলেই ছাপ দিয়েছেন। মেদিনীপুর আমাদেরই থাকছে।’’ জেলা তৃণমূলের চেয়ারম্যান দীনেন রায়ের দাবি, ‘‘মেদিনীপুর এ বার আমরা পুনরুদ্ধার করছিই।’’
ঝাড়গ্রাম লোকসভা কেন্দ্রটি কি এবারও ধরে রাখতে পারবে বিজেপি? নাকি লক্ষ্মীর ভান্ডারের কল্যাণে এ বার ঝাড়গ্রামে ফুলের পরিবর্তন হবে? এখানেও কূল নাই। কিনার নাই অবস্থা। ঝাড়গ্রাম লোকসভার অন্তর্গত গড়বেতা বিধানসভার চমকাইতলার প্রবীণ তৃণমূল নেতা বদরুদ্দিন গায়েন বহুদিন ভোট পরিচালনা করছেন, এ বারের মতো কখনও হিসেবনিকেশ নিয়ে ব্যস্ত হতে হয়নি তাঁকে। বদরুদ্দিন বলছেন, "মানুষ এবার নিশ্চিন্তে চুপচাপ ভোট দিয়েছেন। তাঁরা খোলসা করছেন না। তাই বুথ ধরে ধরে কত ভোট পাচ্ছি, তার হিসাবটা করতে হচ্ছে।" গড়বেতার বড়মুড়া অঞ্চল দীর্ঘ ২০-২২ বছর বিরোধী শূন্য। পঞ্চায়েতের উপপ্রধান তথা তৃণমূলের সংখ্যালঘু সেলের ব্লক সভাপতি হাবিবুল শেখ বলছেন, "এ বারের ভোট বোঝা যাচ্ছে না, নিশ্চিত হতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।" চন্দ্রকোনা রোডের বিজেপি নেতা গৌতম কৌড়ি ফাইল নিয়ে ঘুরছেন কয়েকদিন ধরেই। তিনি ফাইল খুলে দেখিয়ে বললেন, "এই তো দেখছেন ফাইলে বন্দি সব বুথের ভোটের খবর। আমাদের কনফার্ম এলাকাতেও হিসাব মেলাতে পাচ্ছি না।" ঝাড়গ্রামের এক প্রবীণ তৃণমূল নেতা বলছেন, ‘‘কুড়মি ও জনজাতি ভোট কোনদিকে গিয়েছে সেটাও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না।’’
নেতারা নিজেদের মতো করে হিসেব করছেন। নীরবতার ব্যাখ্যা করছেন। ঝাড়গ্রাম জেলা বিজেপির সভাপতি তুফান মাহাতো বলছেন, ‘‘ভোটাররা এখন অনেক বেশি সচেতন। রাজ্যের শাসকদলের বিরুদ্ধে ভোটাররা তাঁদের প্রতিবাদ নিশ্চুপভাবেই জানিয়েছেন।’’ জেলা তৃণমূলের সভাপতি দুলাল মুর্মুর কথায়, ‘‘এত উন্নয়ন, লক্ষ্মীর ভান্ডার সহ বিবিধ পরিষেবা এসবের কারণে এ বার ঝাড়গ্রাম কেন্দ্রটি আমরা পুনরুদ্ধার করছি।’’ গোপীবল্লভপুর-১ ব্লকের আলমপুর গ্রামের এক মহিলা বলছেন, ‘‘লক্ষ্মীর ভান্ডার পেলেও এটা তো মোদীর ভোট। তাই ভেবে শুনেই ভোট দিয়েছি।’’ বেলপাহাড়ির শুশনিজোবি গ্রামের বাসিন্দা সুষেন সিংও বলছেন, ‘‘এটা দিল্লির সরকার গড়ার ভোট। বিধানসভা ও পঞ্চায়েত ভোটের থেকে আলাদা।’’
বিপুল ভোটের হার। তবে নবীন থেকে প্রবীণ, মুখে কুলুপ এঁটেছেন সকলেই। ভোটারদের এমন নীরবতায় ভোট বিশ্লেষকরাও ভোটারদের মন বুঝতে বেগ পাচ্ছেন। মেদিনীপুর লোকসভা কেন্দ্রের খড়্গপুরের মীরপুরের বাসিন্দা রেলের স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক প্রশান্তকুমার রায় বলেন, “আমার মনে হয় এ বার আমাদের মতো প্রবীণ ভোটার যাঁরা, তাঁরা সকলেই প্রবীণদের জন্য সুযোগ-সুবিধা ও বাড়ির ছেলে-মেয়েদের কর্মসংস্থানের ভাবনা থেকে ভোট দিয়েছি। সেক্ষেত্রে রাজ্য এবং কেন্দ্র দুই সরকারের কারও এই দু’দিকে কোনও ভাবনা দেখা যায়নি।’’ দুই তারকার লড়াইয়ে উত্তাল হয়েছিল যে ঘাটাল সেখানেও এখন থমথমে ভাবে। ঘাটালের প্রবীণ ভোটার তপন দে বলছিলেন, ‘‘সকলেই কোনও না কোনও পক্ষে রয়েছে। জল মাপছে সকলে। কোন ফুলে তাঁর মন তা স্পষ্ট করছেন না কেউ।’’ একেবারে নতুন ভোটার খড়্গপুর কলেজের পদার্থবিদ্যার স্নাতকস্তরের ছাত্র অর্ণব প্রামাণিক বলেন, “যে সরকার আমাদের পড়াশোনার সুবিধা স্কুলজীবনেই সাইকেল, ট্যাব দিয়ে সাহায্য করেছে তার পক্ষে নতুন ভোটাররা ভোট দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে।”
মনে এক। মুখে আরেক। রাজনীতিকদের সম্পর্কে চালু প্রবাদ এটি। কেউ যদি মুখই না খোলেন তবে মন পড়া যাবে কী ভাবে! অনেকে বলছেন, ‘‘নির্বাচকমণ্ডলী ঠেকে শিখেছে। তাই মূকাভিনয় করছে। যে ভাষা এখনও রপ্ত করে উঠতে পারেনি রাজনৈতিক দলের নেতারা।’’
প্রেম হোক বা বিদ্বেষ তা গভীর হলেই তো নীরব হয়।
(তথ্য সহায়তা: কিংশুক গুপ্ত, বরুণ দে, রূপশঙ্কর ভট্টাচার্য, রঞ্জন পাল, দেবমাল্য বাগচী ও অভিজিৎ চক্রবর্তী)