—প্রতীকী চিত্র।
তৃণমূলের এক সময়ের শক্ত ঘাঁটি বনগাঁ উত্তর বিধানসভা কেন্দ্রে ২০১৯ সালের লোকসভা ভোট থেকে পদ্মফুলের দাপট শুরু হয়েছে। সে বার এখানে লিড পেয়েছিলেন বিজেপি প্রার্থী শান্তনু ঠাকুর। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে জয়ী হয়েছিলেন রাজনীতিতে কার্যত অপরিচিত, বিজেপির অশোক কীর্তনিয়া। রাজনৈতিক মহলের অনেকেই মনে করেন, ২০১৯ সালের লোকসভা এবং ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের ভরাডুবির কারণ ছিল দলের গোষ্ঠীকোন্দল এবং তৃণমূলের কিছু নেতার অহঙ্কার, দাম্ভিকতা। জনসংযোগও কমে গিয়েছিল বলে দলের অন্তর্তদন্তে উঠে এসেছিল বলে তৃণমূলের একটি সূত্রের খবর।
এ বার কী সেই ক্ষত মেরামত করতে পারবে তৃণমূল? প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে নানা মহলে।
তৃণমূল প্রার্থী বিশ্বজিৎ দাসের দাবি, ‘‘২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে বনগাঁ উত্তর কেন্দ্র থেকে যে ভোটে মানুষ আমাকে জয়ী করেছিলেন, এ বার লোকসভা ভোটে মানুষ তাঁদের ভূমিপুত্রকে আরও বেশি ব্যবধানে জয়ী করবেন।’’ সে বার বিশ্বজিৎ জিতেছিলেন ৩৩,১৯২ ভোটে।
তৃণমূল নেতৃত্বকে আশার আলো দেখাচ্ছে কিছু তথ্য-পরিসংখ্যান। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপি প্রার্থী শান্তনু ঠাকুর বনগাঁ উত্তর কেন্দ্র থেকে ২৮,৩৭০ ভোটে লিড পান। কিন্তু ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে এই কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী অশোক কীর্তনিয়া জয়ী হয়েছিলেন ১০,৪৮৮ ভোটে। বিধানসভা ভোটে তৃণমূল হারের ব্যবধান অনেকটাই কমিয়ে এনেছিল।
বিধানসভা ভোটে পরাজিত হওয়ার পরে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেন। বনগাঁ পুরসভার প্রশাসকের পদ থেকে শঙ্কর আঢ্যকে সরিয়ে দেওয়া হয়। পুরপ্রধান করা হয় গোপাল শেঠকে। তাঁকে সামনে রেখেই তৃণমূল গত পুরভোটে লড়াই করে ২২টি ওয়ার্ডের মধ্যে একক ভাবে পায় ১৯টি আসনে জয়ী হয়। নির্দল, কংগ্রেস এবং বিজেপি একটি করে আসন পেয়েছিল। পুরপ্রধান করা হয় গোপালকে।
২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের পরে বিশ্বজিৎ তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে চলে গিয়েছিলেন। গোষ্ঠীকোন্দলই তার কারণ ছিল বলে দলের অনেকের মত। গত বিধানসভা ভোটে বিশ্বজিৎ বাগদা কেন্দ্র থেকে বিজেপির হয়ে দাঁড়িয়ে জয়ী হয়েছিলেন। পরে ফেরেন তৃণমূলে। দল তাঁকে পুরভোট পরিচালনার বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছিল।
গত পঞ্চায়েত ভোটে এই বিধানসভার অন্তর্গত ৭টি গ্রাম পঞ্চায়েত দখল করে তৃণমূল। তবে বিরোধীরা দাবি করেছিল, পুরসভা ও পঞ্চায়েত ভোটে মানুষের রায়ের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটেনি। ভোট লুট, সন্ত্রাস, বুথ দখল করে ছাপ্পা ভোট দিয়েছিল তৃণমূল। গণনায় হিংসা, কারচুপির অভিযোগ তোলে তারা। সে কথা স্বভাবতই মানেনি শাসক শিবির।
ইতিমধ্যে প্রাক্তন পুরপ্রধান শঙ্কর আঢ্য রেশন দুর্নীতি মামলায় ইডির হাতে গ্রেফতার হয়েছেন। বিরোধীরা এই বিষয়টিকে প্রচারে তুলে আনছে। দলের অন্দরে গোষ্ঠীকোন্দলের চোরা স্রোত এখনও ভোগাচ্ছে বলে জনান্তিকে মানেন তৃণমূলের অনেকেই। প্রচারে নেতা-কর্মী এবং জনপ্রতিনিধিদের একাংশের সক্রিয়তার অভাব দেখা যাচ্ছে। তৃণমূল সূত্রের খবর, নেতা-কর্মীদের সকলকে সক্রিয় করতে ইতিমধ্যেই তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব হস্তক্ষেপ করেছেন।
বিশ্বজিৎ বনগাঁ উত্তরের দু’বারের বিধায়ক ছিলেন। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর নিজস্ব কিছু ভোট এখানে আছে। তবে তাঁর তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে চলে যাওয়া এবং ফিরে আসা তৃণমূলেরই অনেকে ভাল চোখে দেখেননি। বিশ্বজিৎ অবশ্য গোষ্ঠীকোন্দলের কথা অস্বীকার করেছেন। গোপাল বলেন, ‘‘আমরা পুরসভার পক্ষ থেকে শহরবাসীকে যে ভাবে নাগরিক পরিষেবা দিচ্ছি, তাতে মানুষ সন্তুষ্ট। আমরা আশাবাদী, এ বার আমরা ভাল ফল করব।’’
প্রধান বিরোধী বিজেপিরও চিন্তার কারণ গোষ্ঠীকোন্দল। দলের অন্দরে গুঞ্জন, সকলে এখনও সক্রিয় ভাবে প্রচারের ময়দানে নামেননি। কেউ কেউ আবার নিজেদের এলাকায় সময় না দিয়ে বাইরের এলাকায় গিয়ে প্রচার করছেন। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সভায় যাচ্ছেন। তবে বিজেপির বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার সভাপতি দেবদাস মণ্ডল দিনরাত এক করে প্রচারে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। বিরোধীদের আক্রমণে তিনিই প্রধান মুখ হয়ে উঠেছেন। শান্তনু বনগাঁ শহরে নিজের মতো জনসংযোগ করছেন। পথচলতি মানুষের সঙ্গে কথা বলছেন। চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছেন। এরই মধ্যে রাম নবমী উপলক্ষে বিজেপি শহরে বিশাল মিছিল করে নিজেদের জনসমর্থন যাচাই করেছে।
দেবদাস বলেন, ‘‘বনগাঁ উত্তর কেন্দ্রের ফলাফলে এ বার ইতিহাস তৈরি হয়ে যাবে। মানুষ পঞ্চায়েত ও পুরভোটে ভোট লুটের জবাব দিতে তৈরি।’’
২০১১ সালের পর থেকে সিপিএম এখানে ক্রমশ দুর্বল হয়েছে। দলের বহু কর্মী বিজেপি-তৃণমূলে নাম লিখিয়েছেন। কংগ্রেসের অবস্থা আরও খারাপ। সর্বত্র কর্মী খুঁজে পেতে কালঘাম ছুটছে। এ বার বাম-কংগ্রেস আসন সমঝোতা হয়েছে এখানে। প্রার্থী হয়েছেন কংগ্রেসের প্রদীপ বিশ্বাস। কংগ্রেস নেতা দেবব্রত চৌধুরী এবং সিপিএম নেতা পীযূষকান্তি সাহা বলেন, ‘‘পুরসভা এবং পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূলের সন্ত্রাসের সাক্ষী মানুষ। তাঁরা নিজেদের ভোট দিতে পারেননি। সন্ত্রাস, ভোট লুট, রিগিংয়ের প্রভাব এ বার ভোট বাক্সে পড়বে।’’ এরই মধ্যে বনগাঁ শহরে বাম-কংগ্রেসের বিশাল মিছিল হয়েছে। যা দেখে আশাবাদী দু’দলের কর্মী-সমর্থকেরা।