—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
রাত নামলেই হাতির ভয়। রাত ফুরোলে পানীয় জলের চিন্তা। অযোধ্যাপাহাড়কে ঘিরে পর্যটনের বিকাশ ঘটলেও নিত্যদিনের এমনই নানা সমস্যায় জেরবার বাঘমুণ্ডি বিধানসভার বাসিন্দারা। তাঁদের দাবি, পাথর, জঙ্গল থেকে সুবর্ণরেখার বালি— প্রাকৃতিক সম্পদের অভাব নেই। অথচ কর্মসংস্থান নেই। লোকসভা ভোটের মুখে এই সব প্রশ্নে সরগরম ঝাড়খণ্ড ঘেঁষা এই জনপদ।
ঝালদা বাসস্ট্যান্ডের কাছে তেলেভাজার দোকানে জটলায় যুবক নিখিল স্বর্ণকারের আক্ষেপ, ‘‘প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর ঝাড়খণ্ডে কত কারখানা, ঝাঁ চকচকে রাস্তা, ঘরে ঘরে পানীয় জল... কত কি। আর কয়েক কিলোমিটার দূরে ঝালদা শহরের বাসিন্দারা পানীয় জলের জন্য কলতলায় ঝগড়া করছেন। কি লজ্জা!’’
বামফ্রন্টের সময় কোটশিলার মুরগুমা জলাধার থেকে পাইপে ঝালদা শহরে পানীয় জল আনার ব্যবস্থা করা হয়। পরে শহরে জনসংখ্যা বাড়ায় এখন মুরগুমার জলে আর কুলোচ্ছে না। বাসিন্দাদের অভিযোগ, গত কয়েক বছর ধরে পুরসভা দখল করা নিয়ে তৃণমূল ও কংগ্রেসের লড়াইয়ে সুবর্ণরেখা থেকে জল উত্তোলনের প্রস্তাবিত প্রকল্প যেন ধামাচাপা পড়ে গিয়েছে। অযোধ্যাপাহাড়ের হিলটপ থেকে আড়শার সমতল এলাকাতেও জলের সমস্যা মেটেনি।
এক সময় বাঘমুণ্ডি বিধানসভা তথা সাবেক ঝালদা বিধানসভায় দাপট ছিল ফরওয়ার্ড ব্লকের। এখান থেকে সত্যরঞ্জন মাহাতো মন্ত্রী হন। তাঁর দাদা চিত্তরঞ্জন মাহাতোও সাংসদ ছিলেন। পরে কংগ্রেসের নেপাল মাহাতো টানা চার বারের বিধায়ক। ২০২১ সালে বিধায়ক হন তৃণমূলের সুশান্ত মাহাতো। ঝালদা শহরও তেমন কংগ্রেস, বামফ্রন্ট থেকে তৃণমূলের হাতবদল হয়েছে। বাসিন্দাদের প্রশ্ন, বারবার বিভিন্ন দলের জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হয়নি। গড়ে ওঠেনি শিল্পও। রুজির সন্ধানে পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে ভিন্ রাজ্যে কাজে যাওয়াই যেন ভবিতব্য, মনে করেন এলাকার যুবকেরা।
ঝাড়খণ্ড থেকে আসা হাতির হানায় মৃত্যু, ফসলের ক্ষতি— চিন্তা বাড়িয়েছে বাসিন্দাদের। গত বছর হাতির হানায় মৃত্যু হয় বাঘমুণ্ডির টিকরটাঁড় গ্রামের ধুমনাথ সরেনের। তাঁর ছেলে ভিখুরামের প্রশ্ন, ‘‘আর কত প্রাণ গেলে হাতির আসা আটকাতে উদ্যোগী হবেন নেতারা?’’
চলছে রাজনৈতিক চাপান-উতোর। বিদায়ী সাংসদ তথা বিজেপি প্রার্থী জ্যোতির্ময় সিং মাহাতোর অভিযোগ, ‘‘তৃণমূল পরিচালিত রাজ্য সরকারের অপদার্থতা আর সদিচ্ছার অভাবেই উন্নয়ন এখানে থমকে। কেন্দ্রের পাঠানো জল জীবন মিশনের টাকাও নয়ছয় করা হয়েছে।’’ পাল্টা তৃণমূল প্রার্থী শান্তিরাম মাহাতোর দাবি, ‘‘যিনি পাঁচ বছরে সাংসদ হিসাবে এলাকার মানুষের জন্য কিছুই করেননি, তাঁর মুখে এ সব কথা মানায় না।’’ বাঘমুণ্ডির তৃণমূল বিধায়ক সুশান্ত মাহাতোর আশ্বাস, সুবর্ণরেখা জল প্রকল্পের রূপায়ণ শুধু সময়ের অপেক্ষা।
বাম-কংগ্রেসের জোট প্রার্থী নেপাল মাহাতোর অভিযোগ, ‘‘কেন্দ্র এবং রাজ্য দুই সরকারই এলাকার উন্নয়নে সমান উদাসীন। বিধায়ক থাকাকালীন সাধ্যমতো এখানে প্রচুর কাজ করেছি। মানুষ তা জানেন। উন্নয়নের থেমে যাওয়া চাকা সচল করতে মানুষ আমাকেই আশীর্বাদ করবেন।’’
উন্নয়নের প্রশ্নের বাইরে রাজনৈতিক ভাবেও বাঘমুণ্ডি কেন্দ্রের গুরুত্ব কম নয়। গত পঞ্চায়েত ভোটে শাসকদলের মদতে প্রশাসনের বিরুদ্ধে গণনায় কারচুপির অভিযোগে এই এলাকা থেকেই একাধিক মামলা হয় হাই কোর্টে। তা সত্ত্বেও পঞ্চায়েতের তিনটি স্তরেই বিরোধীরা ফলাফলে নিজেদের অস্তিত্ব বুঝিয়েছে।
অন্য দিকে, ঝালদা পুরসভা নিয়ে শহর তৃণমূলের দ্বন্দ্ব ভোটের মুখেও নেতৃত্বকে স্বস্তিতে রাখছে না। ভোটের প্রচারেও দ্বন্দ্বের ছাপ সামনে এসেছে। সম্প্রতি জেলায় এসে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও এ নিয়ে সতর্ক করেছেন। এক পক্ষের তরফে পুরপ্রধান তৃণমূলের সুরেশ আগরওয়ালের দাবি, ‘‘শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশ মতোই প্রচার চলছে।’’ অন্যপক্ষের তরফে প্রাক্তন পুরপ্রধান শীলা চট্টোপাধ্যায় মন্তব্য করতে চাননি। তবে জেলা তৃণমূল সভাপতি সৌমেন বেলথরিয়ার দাবি, ‘‘কোনও দ্বন্দ্ব নেই। সমস্যা যা ছিল, আলোচনায় মিটে গিয়েছে।’’
অন্য দিকে, বাঘমুণ্ডি কংগ্রেসের পুরনো গড় বলেও পরিচিত। ফলে বামেদের সমর্থন নিয়ে ঝালদা ১ ব্লকের ইচাগের বাসিন্দা নেপাল এখানে কতটা ভোট নিজের ঝোলায় ভরেন, সে দিকেও নজর অনেকের। আবার বিদায়ী সাংসদ জ্যোতির্ময়ও ঝালদা ১ ব্লকেরই পাতরাডির ছেলে। আদিবাসী কুড়মি সমাজের প্রার্থী অজিতপ্রসাদ মাহাতোর বাড়ি এই বিধানসভার আড়শা ব্লকের হেঁটগুগুই পঞ্চায়েত এলাকায়। সংগঠনের হয়ে ভোট টানার সম্ভাবনা তাঁরও রয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। ফলে ঘরের ছেলে, উন্নয়ন-অনুন্নয়ন, তৃণমূলের দ্বন্দ্ব— নানা সমীরণ নিয়ে জল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বাঘমুণ্ডি বিধানসভা।