—প্রতীকী চিত্র।
কানোরিয়া জুট মিল থেকে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম। এই সময়কাল জুড়ে যে কোনও আন্দোলন মঞ্চে গাওয়া হত তাঁর গান। নিপীড়িত-প্রতিবাদীরা গাইতেন, শ্রমিকেরাও গাইতেন। গাইতেন দোলা সেন থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। “যত হামলা করো সব সামলে নেব, চ্যালেঞ্জ তোমার যদি মারতে পারো”— হয়ে উঠেছিল যে কোনও গণআন্দোলনের থিম সং। নিজের কথায়-সুরে গাওয়া এই গানের সুবাদেই এখন তাঁর পরিচিতি গণ-কবিয়াল নামে। সেই নীতীশ রায় অনেক দিন পর নিজের কথা ও সুরে গান বাঁধলেন লোকসভা ভোট নিয়ে।
পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের পক্ষ থেকে প্রকাশিত স্টুডিয়ো রেকর্ডিং-এ ভোট প্রচারের দুইখানি গান ইতিমধ্যেই কিছু মঞ্চে শোনাও যাচ্ছে। সমবেত ভাবে গেয়েছেন সরিৎ চক্রবর্তী, বাবুনী মজুমদার এবং নীতীশ রায় নিজেই। আদতে নবদ্বীপের মানুষ নীতিশ রায়। তাঁর গান রচনা শুরুর প্রেক্ষিত ছিল— ১৯৭৮ সালে চাপড়ায় হওয়া সাম্প্রদায়িক হিংসা। তিনি তখন নবদ্বীপের ইউনাইটেড কালচারাল সার্কেলের সদস্য। সিপিআইএমএল(লিবারেশন)-এর সক্রিয় নীতীশ রায় পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের সঙ্গে জন্মলগ্ন থেকে যুক্ত। ওই মঞ্চ থেকেই তাঁর অধিকাংশ গানের পরিচিতি।
ভোট প্রচারে ভোটারের মন মজাতে গান বা ছড়ার ব্যবহার শতবর্ষের পুরনো রীতি। বঙ্গদেশে এই ব্যাপারে পথিকৃৎ হলেন দাদাঠাকুর। সময়টা ১৯২৩ সাল। দেশের আইনসভার নির্বাচনে লড়ছে স্বরাজ্য দল। দিল্লিতে স্বরাজ্য দলের নেতা মতিলাল নেহরু, বাংলায় চিত্তরঞ্জন দাশ। কলকাতা উত্তর-মধ্য নির্বাচনী ক্ষেত্রে স্বরাজ্য দলের প্রার্থী হয়েছেন বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির কোষাধ্যক্ষ নির্মলচন্দ্র চন্দ। ঐতিহাসিক প্রতাপচন্দ্র চন্দের পিতৃদেব। সে বার মুসলিমদের সঙ্গে পাওয়ার জন্য মতিলাল-দেশবন্ধু ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ নামে এক চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। যা মোটেই ভাল ভাবে নেননি সে কালের গোঁড়া হিন্দুরা। তাঁরা নির্মলচন্দ্রের বিরুদ্ধে অভিনব প্রচার শুরু করলেন।
লরির লম্বা মিছিল। প্রতিটি লরির উপর একটি গরু। গলায় ঝোলানো বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড। কোনওটায় লেখা— ‘স্বরাজ্য দল মুসলমানদের সঙ্গে প্যাক্ট করেছে, গো-হত্যায় বাধা দেবে না।’ কোনওটায় বা লেখা— ‘স্বরাজ্য দলকে ভোট না দিয়ে, আমায় রক্ষা করুন’ ইত্যাদি। এমন প্রচারে ত্রাহি মধুসূদন রব স্বরাজ্য দলের অন্দরে। তাঁরা শরণাপন্ন হলেন দাদাঠাকুরের।
প্রতাপচন্দ্র চন্দ এই প্রসঙ্গে তাঁর ‘স্মৃতিকথা’য় লিখছেন— “সকলের বিশ্বাস দাদাঠাকুর ওই মিছিলের প্রতিবাদ করে একটা জম্পেশ প্যারোডি লিখে দিলে মিছিল করে তা প্রচার করা যাবে। জুতসই জবাব দেওয়া যাবে বিরোধীদের।” দাদাঠাকুর এর জবাবে কী গান বেঁধেছিলেন, তার হদিস অবশ্য দিতে পারেননি
প্রতাপচন্দ্র। তবে সে কালের ভোট দাদাঠাকুরের গানে কী ভাবে ভরে উঠত, তার নমুনা তিনি পেশ করেছেন। “আমি ভোটের লাগিয়া ভিখারি সাজিনু,ফিরিনু গো
দ্বারে দ্বারে” বা “আয় ভোটার আয় ভোট দিয়ে যা” তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিল সে কালে।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে, বিশেষ করে, বামপন্থীদের প্রচারে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে গান। কিংবদন্তী সুরকার, গীতিকার সলিল চৌধুরীর ‘ঢেউ উঠছে, কারা টুটছে’-সহ অজস্র গান চুটিয়ে ব্যবহার করতে দেখা গিয়েছে ভোটের প্রচারে। বিগত দুই দশক যাবৎ প্রচারে সমাজমাধ্যমের বাড়বাড়ন্তের সঙ্গে সঙ্গে গানের ব্যবহার ক্রমশ কমে গিয়েছে। তবে গানের আবেদন এখনও একেবারে হারিয়ে যায়নি।
এই পরিস্থিতিতে গণ-কবিয়াল নীতিশ রায় অনেক দিন পর ভোটের গান লিখে রেকর্ড করলেন। তিনি বলেন, “গান বাঁধা নিয়মিত হচ্ছে, গাওয়াও। কিন্ত এ ভাবে স্টুডিয়ো ব্যবহার করে অনেক দিন পরে গান হল। গান দু’টি বোধ হয় পছন্দ হয়েছে শ্রোতাদের। রোজই ফোন পাচ্ছি, যাঁরা গানগুলি গাইতে চাইছেন। তাঁদের বলেছি, অনুমতি অবাধ।”
নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিক কানোরিয়া জুট মিলের আন্দোলন ঘিরে রাজ্য-রাজনীতি তোলপাড়। তখন তাঁর গানের পরিচয় পাল্টে দিয়েছিলেন কানোরিয়ার আন্দোলনকারীরা। পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের সদস্যদের নিয়ে কানোরিয়া জুট মিলে গাইতে গিয়ে এক বিচিত্র পরিস্থিতিতে পড়ার কথা জানাচ্ছিলেন নীতীশ রায়। “সে দিন সবাই অনুরোধ করছিল আগে ‘চ্যালেঞ্জ গান’
গাইতে হবে। আমি ও গান জানি না বলতে সবাই খুব হতাশ হলেন। এক জন বলেই ফেললেন, ‘তবে যে শুনেছি ও গান আপনার লেখা ও সুর করা।’ আমি কিছু বুঝতে না পেরে খানতিনেক গানের পর— যত হামলা করো সব সামলে নেব, চ্যালেঞ্জ তোমার যদি মারতে পারো, ধরতেই অমনি হইহই করে উঠলেন সকলে। বলে উঠলেন, ‘তবে যে বললেন চ্যালেঞ্জ গান জানেন না!’ আসলে ওঁরা গানের আলাদা নামকরণ করেছিলেন, সেটা আমি জানতাম না।”
এ বার তাঁর একটি গানের প্রথম লাইন— ‘বুলডোজারের রাজ ভাঙতে হবে আজ।’ এ গান কোনও নতুন নাম পাবে কিনা, সময় বলবে।