নির্বাচনী জনসভায় প্রধানমন্ত্রী। নিজস্ব চিত্র।
নানা সমস্যায় জর্জরিত বঙ্গের চটশিল্প। বিশেষ করে গঙ্গার দু’পারের দুই জেলায় (উত্তর ২৪ পরগনা ও হুগলি) এই শিল্প অনেক দিন ধরেই ধুঁকছে। রবিবার এই দুই জেলায় নির্বাচনী জনসভায় এসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই শিল্পের দুরবস্থার জন্য দুষলেন বিরোধীদের।
কাঁকিনাড়ায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘ব্যারাকপুর চটশিল্পের হাব ছিল। গঙ্গাপারের এই শিল্পাঞ্চলে শিল্প ফুলেফেঁপে উঠেছিল। এখন চটশিল্পের বেহাল দশা। আমরা শস্য এবং চিনি চটের ব্যাগেই প্যাকিং করার নিয়ম করেছি। যাতে পাটচাষিদের সহযোগিতা হয়।’’ চুঁচুড়া ময়দানের সভায় তিনি বলেন, এক সময় এখানে চটশিল্প অত্যন্ত সমৃদ্ধ ছিল। কিন্তু প্রথমে কংগ্রেস, বাম, তার পরে তৃণমূল মিলে সব শেষ করে দিয়েছে।
তবে, চটশিল্পের দুর্দশায় মোদীকেই পাল্টা একযোগে আক্রমণ শানিয়েছেন বিরোধীরা। অভিযোগের তির প্রধানমন্ত্রীর দিকেই ঘুরিয়ে শ্রীরামপুরের তৃণমূল প্রার্থী তথা বিদায়ী সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া, ‘‘চটশিল্প মার খেয়েছে নরেন্দ্র মোদীর জন্য।’’ কল্যাণের অভিযোগ, পাটের উপরে ভর্তুকি মোদী কমিয়ে দিয়েছেন। গুজরাতের সিন্থেটিক লবির পৃষ্ঠপোষকতায় কেন্দ্রীয় সরকার ব্যস্ত থেকেছে। তাই এই অবস্থা। এ নিয়ে তাঁরা লোকসভায় বার বার সরব হয়েছেন। রাজ্যের সেচমন্ত্রী তথা ব্যারাকপুরের তৃণমূল প্রার্থী পার্থ ভৌমিকের মন্তব্য, ‘‘কেন্দ্র প্লাস্টিকের বস্তার বরাত দিচ্ছে আর মোদী এখানে এসে চটশিল্প-দরদি সাজছেন!’’
প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ তথা প্রবীণ শ্রমিক-নেতা শান্তশ্রী চট্টোপাধ্যায়ের অভিযোগ, পরিবেশবান্ধব চটশিল্পকে ধ্বংস, রুগ্ন করে সিন্থেটিক লবিকে আমদানি করছে মোদী সরকার। খাদ্যশস্য চটের বস্তায় ভরার নির্দেশ ঠিকমতো কার্যকর করা হয়নি। রাজ্যের তৃণমূল সরকারও চটশিল্পের উন্নতিতে কোনও পরিকল্পনা করেনি।
প্রদেশ কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক তথা এআইসিসি সদস্য প্রীতম ঘোষের দাবি, চটশিল্পের সমৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি হয়েছিল কংগ্রেস আমলে। ২০০৪ থেকে ’১৪ পর্যন্ত কেন্দ্র সব থেকে বেশি চটের বস্তার বরাত দিয়েছিল। মোদী সরকার সেই ‘কোটা’ কমিয়ে দেয় কর্পোরেট-স্বার্থে গুজরাতের সিন্থেটিক ব্যাগকে প্রাধান্য দিতে। তাঁর বক্তব্য, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে চটশিল্পের দুর্গতির জন্য তৃণমূলও কিছুটা দায়ী।’’
বিরোধীদের অভিযোগ উড়িয়ে হুগলির বিজেপি প্রার্থী তথা বিদায়ী সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, চটের বস্তার যা চাহিদা, তা জোগাতে পারছে না চটকলগুলি। ব্যারাকপুরের বিজেপি প্রার্থী অর্জুন সিংহের দাবি, ‘‘চটশিল্প টিকে আছে শুধুমাত্র কেন্দ্রের দৌলতে। প্রধানমন্ত্রী চটশিল্পের প্রসার চাইলেও রাজ্য সরকারের হেলদোল নেই।’’
ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে গত দু’দশকে একটু একটু করে চটশিল্প ধুঁকতে শুরু করেছিল। চটকল বন্ধ হয়ে অন্য কারখানার গুদাম হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু করেছিল। ভিন্ রাজ্যের শ্রমিকেরা ফের পরিযায়ী হয়েছেন। চটকলের আধুনিকীকরণ নিয়ে শ্রমিক-মালিক দ্বৈরথেও অনেক ব্যবসা গুটিয়েছে।
খাদ্যশস্যে ১০০ শতাংশই চটের বস্তা বাধ্যতামূলক। সম্প্রতি ‘প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনা’য় ১০ কেজি খাদ্যশস্য বস্তায় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্র। তাতে ছ’মাস অন্তর ২০.৩ কোটি ছোট বস্তা প্রয়োজন হবে। কিন্তু প্রথম দফায় প্লাস্টিকের বস্তার বরাত দিয়েছে খাদ্যমন্ত্রক। চলতি বছরের গোড়ায় ইন্ডিয়ান জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন (আইজেএমএ) কেন্দ্রীয় শিল্প-বাণিজ্য ও বস্ত্রমন্ত্রী পীযূষ গয়ালকে চিঠি দিয়ে এ ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করে।
কেন্দ্রের সংশ্লিষ্ট মহলের দাবি, চাহিদামতো ছোট মাপের বস্তা জোগানোর ক্ষমতা আপাতত নেই চটকলগুলির। চটশিল্পের সঙ্গে জড়িতদের পাল্টা দাবি, যতটুকু ক্ষমতা রয়েছে, নিয়ম মেনে সেটুকু বরাত দিতে আপত্তি কোথায়? তাতে কর্মসংস্থানের সুযোগও বাড়তে পারে। নচেৎ, এই শিল্পে আইনি সুরক্ষা কবচের অর্থ কী?
কয়েক বছর আগে হুগলির রিষড়ায় ওয়েলিংটন জুটমিলে এসে চটশিল্পের দুরবস্থার কথা শুনে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বলেছিলেন, সংসদে আওয়াজ তুলবেন। তার পরে কী হল? কংগ্রেসের দাবি, তিনি সংসদে বিষয়টি উত্থাপন করেছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার শোনেনি।