—প্রতীকী চিত্র।
কাঁসাই পাড়ের বিধানসভা ডেবরা। একদিকে মুম্বই-কলকাতা জাতীয় সড়ক। অন্যদিকে প্রাণকেন্দ্রের উপরে জীবনরেখা গড়ে দিয়েছে ব্যস্ততম রেলপথ। প্রতিবার ভোটে এলেই কাঁসাই হয়ে ভেসে যায় সেতু গড়া-সহ নানা প্রতিশ্রুতি। এবার লোকসভা নির্বাচনেও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না।
কাঁসাই নদীর উপরে এখনও হয়নি টাবাগেড়িয়া সেতু। বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো বসবাস করছেন চারটি গ্রাম পঞ্চায়েতের মানুষ। বাড়ছে ক্ষোভ। টাবাগেড়িয়া সেতুর দাবি বিদায়ী সাংসদ তথা তৃণমূলের তারকা প্রার্থী দেবের পায়ে কার্যত ‘কাঁটা’ হয়ে বিঁধছে। তাকে হাতিয়ার করেছে বিজেপি। তাদের প্রার্থী হিরণ চট্টোপাধ্যায়কে বলতে শোনা গিয়েছে, “এখানকার বিদায়ী সাংসদ বলেছিলেন টাবাগেড়িয়ার সেতু তৈরি করতে না পারলে নির্বাচনে দাঁড়াবেন না। টাবাগেড়িয়ায় এখনও সেতু হয়নি। কিন্তু উনি প্রার্থী হয়েছেন। এখানকার সাংসদ এত বড় তোলাবাজ যে ভাইপোর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু করেছেন। টাবাগেড়িয়ায় সাঁকো পার করতে স্কুল পড়ুয়াদের থেকে ৫ টাকা করে নিচ্ছেন এখানকার সাংসদ।” দেবকে ‘সেতু চোর’ বলেও কটাক্ষ করেছেন তিনি। দেবকেও টাবাগেড়িয়ায় জনতার সরাসরি প্রশ্নে মঞ্চে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে। ওই সেতু না হওয়ায় ‘ক্ষমা’ও চেয়েছেন তিনি। দেব বলেছেন, “আমরা ২০১৯ সালে কথা দিয়েছিলাম টাবাগেড়িয়া সেতুটা করব। বিশ্বাস করুন আমার চেষ্টার মধ্যে কোনও ত্রুটি ছিল না। আমি চেষ্টা করেছিলাম। আমি কথা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার লোক না। আমি অন্য রাজনৈতিক নেতাদের মতো নই যে ভোটটা নিয়ে পালিয়ে যাব। আমি যেটা বলেছি সেটা মনে থাকবে। আমি ক্ষমাও চাইছি।”
ঘাটাল লোকসভা জিততে ডেবরার ভূমিকাও মনে করিয়ে দিয়েছেন দেব। কর্মিসভায় জানিয়েছিলেন, কেশপুর থেকে এবার প্রত্যাশিত ‘লিড’ নাও আসতে পারে। তাই ভাল ‘লিড’ দিতে হবে ডেবরাকেও। এবার জিতে সংসদের প্রথম বক্তৃতায় টাবাগেড়িয়া সেতুর কথা তুলে ধরবেন বলেও আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। ডেবরাকে পাখির চোখ করেছে বিজেপিও। তিনি সাংসদ হওয়ার পরে এই টাবাগেড়িয়ায় সেতু উদ্বোধন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী করবেন বলে দাবি করেছেন হিরণ। তবে ক্ষোভ যাচ্ছে না সাধারণ মানুষের। ডেবরার ভবানীপুরের বাসিন্দা রাজু অধিকারী বলেন, “কয়েক বছর আগে প্রসব যন্ত্রণায় কাতর আমার বোনকে টাবাগেড়িয়ার নদীর উপরের অস্থায়ী রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। মাটি ধ্বসে গাড়ি নদীতে পড়ে যায়। বড় বিপদ থেকে বেঁচেছিলাম। বহু প্রতিশ্রুতি শুনেছি। কাউকে ভরসা হয় না। গত দশ বছরে অনেক আশা করেছিলাম।”
ডেবরা একসময়ে ছিল বাম দুর্গ। পরিবর্তন হয়েছে তবে উন্নয়নের দাবি মেটেনি। বাম জমানায় শুরু হওয়া লোয়াদা সেতুর অবশিষ্ট কাজ শেষ করা ছাড়া তৃণমূল নতুন করে সেতু প্রকল্পের বাস্তবায়ন করতে পারেনি। বালিচক রেলগেটের যানজট ঠেকাতে উড়ালপুলের ঘোষণা হয়। গত ৬ বছর ধরে চলছে তার নির্মাণ কাজ। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে এই বিধানসভায় প্রায় ৪ হাজার ভোটে পিছিয়ে ছিল তৃণমূল। অনেকেই মনে করেন, অনুন্নয়নের সঙ্গে তৃণমূলের চরম গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কারণেই সেবার ‘লিড’ পেয়েছিল বিজেপি। পরে অবশ্য বিধানসভা ভোটে ফের জোড়াফুল ফোটে ডেবরায়। জেতেন তৃণমূলের হুমায়ুন কবীর। তবে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব পিছু ছাড়েনি।
শোনা যায়, ডেবরার বিধায়ক, প্রাক্তন পুলিশ আধিকারিক হুমায়ুনকে ঘিরে নতুন করে কোন্দল বেড়েছে তৃণমূলে। খড়্গপুরে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৈঠকেও সেই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের আঁচ মিলেছে। তৃণমূল সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই বৈঠকে অভিষেকের সামনেই তৃণমূলের ডেবরা ব্লক সভাপতি প্রদীপ কর অভিযোগ করেন, প্রচারে বিধায়কের সাড়া মিলছে না। যদিও প্রদীপ কর এখন প্রকাশ্যে বলছেন, “দলের অভ্যন্তরীণ বৈঠকে কী হয়েছে তা সংবাদমাধ্যমে বলব না। আমাদের দলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নেই। আমরা এবার বিপুল ভোটের ব্যবধানে ডেবরায় এগিয়ে যাব। কারণ উন্নয়নের কাজ হয়েছে। টাবাগেড়িয়া সেতুরও পরিকল্পনা হয়েছে। বিজেপি ডেবরায় নেই।’’ তিনি জুড়ছেন, ‘‘এ বার শুধু দেখব গেরুয়ার ভিতরটায় কতটা লাল রয়েছে।”
ঘাটাল কেন্দ্রে সিপিআই প্রার্থী তপন গঙ্গোপাধ্যায়ের সমর্থনে ডেবরায় প্রচার করছে সিপিএম। ডেবরার বাসিন্দা, সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য সুমিত অধিকারী বলছেন, “প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আমাদের কিছু ভোট বিজেপিতে চলে গিয়েছিল। সেটা আমরা অস্বীকার করছি না। কিন্তু গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে ডেবরায় আমাদের ভোট অনেকটা ফিরেছে। এবার আরও এগিয়ে যাব। তৃণমূলের অবস্থা আরও খারাপ হবে। দুর্নীতি ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে ক্ষয়িষ্ণু তৃণমূল এখন গ্রেফতারের আশঙ্কায় বিজেপির দিকে সরে যাচ্ছে।”