মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
বাংলার শাসক দলের ভূমিকায় থাকলেও তৃণমূল দোষ করলে তাকে শাস্তি দেওয়ার অধিকার জনতার আছে। আরামবাগের সভা থেকে এমনই বললেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বললেন, ‘‘বিজেপি এবং সিপিএম বড় গুণ্ডা। ওদের থেকে বাঁচতে পারবেন না। কিন্তু তৃণমূল দু’টো ভুল করলে তাদের থাপ্পড় মেরে সমঝে দেওয়ার অধিকার আপনাদের আছে।’’ একই সঙ্গে মমতা জানিয়েছেন, যাঁরা তৃণমূলে দোষ করেছিল, যাঁদের নিয়ে ক্ষোভ ছিল তাঁদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করেছে তৃণমূল নেতৃত্বও। মমতার কথায়, ‘‘ আপনারা দেখেছেন, একটা-দু’টো যা ক্ষোভ ছিল, আমরা তাতে অ্যাকশনও নিয়েছি। কারণ আমি চাই মানুষের স্বার্থে মানুষের কাজ করতে। আমি আর কারও কোনও স্বার্থ বুঝতে চাই না।’’
জয়রামবাটি কামারপুকুরের প্রশংসা করছিলেন মমতা। বলছিলেন, ওঁরা মানুষের জন্য অনেক কাজ করে। হঠাৎই বললেন, ‘‘ তবে সব সাধু তো সমান হয় না! অনেকে আবার করেও না। আমাদের মধ্যেও কি সবাই সমান? না। এই তো বহরমপুরের একজন মহারাজ আছেন। আমি শুনেছি অনেকদিন ধরে কার্তিক মহারাজ। ভারত সেবাশ্রম সংঘকে আমি খুব শ্রদ্ধা করতাম। দীর্ঘদিন ধরে ওঁদের প্রতি আমার সম্মান ছিল। কিন্তু যে লোকটা বলে আমি তৃণমূল কংগ্রেসের এজেন্ট বসতে দেব না, সেই লোকটাকে আমি সাধু বলে মনে করি না। তার কারণ তিনি সরাসরি রাজনীতি করছেন। দেশের সর্বনাশ করছেন। আমি চিহ্নিত করেছি কে কে করেছেন।
আসানসোলে একটা রামকৃষ্ণ মিশন আছে। আমি রামকৃষ্ণ মিশনকে কোন সাহায্যটা করিনি। সিপিএম যখন আপনাদের খাবার বন্ধ করে দিল। আমি আপনাদের অস্তিত্ব নিয়ে স্বাধীকার নিয়ে আমি পুরো সমর্থন করেছিলাম। মা-বােনেরা আসত। তরকারি কেটে দিত। আর সিপিএম আপনাদের কাজ পর্যন্ত করতে দিত না।
কিন্তু আমি জানি কয়েকজন। সবাই তো নয়। যেমন আমি শুনলাম আসানসোলের একটি মিশন আছে। ইস্কোনো। মনে রাখবেন ৭০০ একর জমি দিয়েছি। নদিয়াতেও ইস্কনকে সাহায্য করেছি। জানতে পারি দিল্লি থেকে সব ফোন আসে আর বিজেপিকে ভোট দেওয়ার জন্য বলতে বলে। কেন করবে সাধু-সন্তরা এই কাজ?
মনে রাখবেন স্বামী বিবেকানন্দের বাড়িটাই থাকত না আপনাদের এই মেয়েটি যদি বেঁচে না থাকত। রাত ১২টার সময় ফোন এসেছিল আমার কাছে। বিবেকানন্দের বাড়ি দখল করতে এসেছে বলে। সেই বাড়ি পরের দিন মেয়রকে দিয়ে আমি নিয়েছিলাম। বলেছিলাম, যত টাকা লাগে লাগুক, ওই বাড়ি স্বামী বিবেকানন্দেরই থাকবে। আর কারও থাকবে না। ’’
সিস্টার নিবেদিতার বাড়ি দু’বার বাঁচিয়েছি। সারদা মায়ের বাড়ি হচ্ছিলই না। আমি সবার সঙ্গে কথা বলে করিয়ে দিয়েছিলাম।
মমতা বললেন, ‘‘এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। বাংলা দেশ স্বাধীন করেছিল। এ বারও বাংলা দেশকে পথ দেখাবে। মোদীকে সরাতে হবে। মনে রাখবেন, এই নির্বাচনে যদি ওরা জেতে, আর সংবিধান থাকবে না। ভোট হবে না। আপনাদের অধিকার থাকবে না। তাই বুঝেশুনে নিজের ভোট দেবেন।’’
মমতা বললেন, ‘‘এরা সব চাকরিখেকো। দশ লক্ষ চাকরি আমি প্রস্তুত রেখেছি, সিপিএম-কংগ্রেস করতে দিচ্ছে না।’’
মমতার প্রশ্ন, ‘‘এ বার যদি ওরা জিতবেই তবে কেন অমিত শাহ বলবেন, ‘শেয়ারে টাকা জমাও। পরে লাভ পাবেন।’ আসলে শেয়ার সব ধসে গিয়েছিল। এখন নিজেদের টাকা দিয়ে শেয়ার ঠিক করছে। ওই শেয়ারে যারা টাকা জমাবে, তাদের সব ধসে যাবে। কেউ জমাবেন না।’’
মমতা বললেন, ‘‘অমিত শাহ নির্বাচন চলাকালীন এ কথা বলতে পারেন না। এটা পরিষ্কার আদর্শ আচরণবিধি লঙ্ঘন হচ্ছে। শেয়ারে টাকা ঢালবেন কি ঢালবেন না, এটা সম্পূর্ণ আপনাদের ব্যাপার। আমি বুঝি না। কিন্তু এটা জেনে রাখুন মোদী এ বার আসছেন না।’’
মমতা বললেন, ‘‘বাংলায় কোনও জোট নেই। এখানে শুধু কংগ্রেস-সিপিএমের মহাঘোঁট আছে। দিল্লিতে আমরা ‘ইন্ডিয়া’র সঙ্গে আছি। মনে রাখবেন ‘ইন্ডিয়া’ নামটা আমারই দেওয়া। ওই জন্য মোদী বাবু ভারতের সংবিধান থেকেই ‘ইন্ডিয়া’ নামটা সরিয়ে দিলেন। এরপর যদি ভোটে জেতে সংবিধানটাই আর থাকবে না। কেন্দ্রে ‘ইন্ডিয়া’ সরকার আসছে, ‘ইন্ডিয়া’ সরকার আমরা গড়ব। কিন্তু এখানে একটা ভোটও সিপিএম-কংগ্রেসকে দেবেন না। এখানে ওদের ভোট দেওয়া মানে বিজেপিকে ভোট দেওয়া। কেন্দ্রে ‘ইন্ডিয়া’ সরকার গড়ার জন্য এখানে আমরা একাই একশো।’’
সন্দেশখালি নিয়ে মমতা বললেন, ‘‘মা-বোনেদের দিয়ে কী লিখিয়ে নিয়েছে কেউ জানেনও না। সন্দেশখালির কলঙ্ক আজীবন মানুষ মনে রাখবে। এরা চক্রান্ত করে। দেখবেন মাঝেমধ্যেই এরা মন্দির থেকে একটা পুতুল সরিয়ে দেয়। পুতুল মানে ওদের পুতুল, আমাদের ঠাকুর-দেবতা। আমরা সে সব সরাই না। আমরা সম্মান করি। সে যে দেবতাই হোক। ওরা সরাতে পারে।’’
মমতা বললেন, ‘‘সমস্ত জেলা প্রশাসনকে বলব মন্দিরগুলো খেয়াল রাখুন, সন্দেশখালি ব্যর্থ হওয়ার পরে ওদের প্ল্যান ওরা মন্দিরে মন্দিরে গিয়ে নতুন অশান্তি করতে পারে। সেগুলো করতে দেবেন না। কোনও জায়গায় যেন অশান্তি না হয়। যেখানে অশান্তি হবে, সেখানকার প্রশাসনকে দায়িত্ব নিতে হবে। তাই খেয়াল রাখুন। যেখানে যেখানে কিছু সরাবে, সেখানে নতুন মূর্তি এনে দেবেন। আমরা ওদের মতো নই। আমরা মন্দির থেকে মূর্তি সরাই না।’’
‘‘বাঙালিরা তোমাদের পছন্দ করে না’’, মোদীকে তোপ মমতার। বললেন, ‘‘ওরা বিজ্ঞাপনে প্রচুর টাকা খরচ করে। অথচ গরিবদের দেওয়ার টাকা নেই। টাকা খরচ করে মন পাওয়া যায় না। এটা হৃদয় দিয়ে হয়। ’’
আরামবাগের সভায় মমতা বললেন, ‘‘তৃণমূল দোষ করলে দুটো থাপ্পড় মারবেন, সমঝে নেবেন সেই অধিকার আছে আপনাদের। কিন্তু সিপিএম যে বড় ধরনের গুণ্ডা, বিজেপি যে বড় ধরনের গুণ্ডা, ওদের হাত থেকে বাঁচতে পারবেন না। আপনারা দেখেছেন, একটা-দু’টো যা ক্ষোভ ছিল, আমরা তাতে অ্যাকশনও নিয়েছি। আমি চাই মানুষের স্বার্থে মানুষের কাজ করতে। আমি আর কারও কোনও স্বার্থ বুঝতে চাই না। আমি একটাই স্বার্থ বুঝি। সেটা হচ্ছে মানুষের স্বার্থ।’’
পুরনো স্মৃতি বলছেন মমতা। বললেন, গোঘাটের কাছেই গোপীনাথপুর শিহরে আমরা এসেছিলাম। সিপিএম সেখানে গ্রাম দখল করে নিয়েছিল। সবাইকে ঘর থেকে বের করে মেরে কেটে খুন করে লাশ ভাসিয়ে দিয়েছিল। আমি যখন কিছু বলি তার প্রমাণ থাকে। আমার সঙ্গে সে দিন ছিলেন এক সাংবাদিক। মেদিনীপুরেও ছিলেন। আমরা রাত ১টার সময় বেরিয়েছিলাম। সুদীপদা (বন্দ্যোপাধ্যায়) আমাদের বলল, ‘এত রাতে তুমি ঝুঁকি নিচ্ছ’! কিন্তু আমি বলেছিলাম, মানুষ বিপদে পড়লে কী করব। আমরা বেরোলাম। রাত ১টায়। গা ছম ছম করছিল। দেখলাম পুকুরের মধ্যে কাদায় মানুষজন সব গলা পর্যন্ত ডুবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমাকে বলছে, দিদি আমরা এখানে লুকিয়ে আছি। না হলে মেরে দেবে। আর দেখছি চারপাশে মদের ফোয়ারা আর মাংস রান্না হচ্ছে। সে দিন যারা সিপিএমের হার্মাদ ছিল, আজ তারাই বিজেপির হার্মাদ।ওই সাংবাদিক, এখান থেকে ফিরে তার পরের দিন একটি লেখা লিখেছিলেন, শিহরে গেলে শিহরিয়া যাই। আমার আজও মনে আছে। প্রমাণ আছে। সেদিন যারা ওখানে ঘর হারিয়েছিল, তারা জয়রামবাটি কামারপুকুরে আশ্রয় নিয়েছিল। সেখান থেকেই তাঁদের খাবার দেওয়া হচ্ছে। এখানে এসে তাই সেই জয়রামবাটি কামারপুকুরের কথা মনে করব না তো কাকে মনে করব। ওঁদের প্রতি তাই আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ। ওঁরা অনেক কাজ করেন। অনেকেরই আজ আর মনে নেই। তাই মনে করিয়ে দিলাম।
কামারপুকুর-জয়রামবাটিতে তাঁর আসার ইতিহাস আশ্চর্যের ঘটনা, জানালেন মমতা। বললেন, আরামবাগ থেকে একটা রাস্তা আছে গরবেতা আর চমকাইতলা পর্যন্ত। ওখানে একটা সুড়ঙ্গ করেছিল সিপিএম। মেরে সুড়ঙ্গ দিয়ে ভাাসিয়ে দিত জলে। আমি চমকাইতলায় পার্টির মিটিং করতে এসেছিলাম। আমার সঙ্গে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অজিত পাঁজা ছিলেন। আমি তখন রেলমন্ত্রী। আমাদের প্যান্ডেল, বাস ভেঙে দেওয়া হল। অজিত পাঁজাকে আমি ছুটে এসে উদ্ধার করে নিয়ে গিয়েছিলাম। দেখছি তখন শুধু গুলি চলছে। আমার সে দিন থাকার জায়গা ছিল না। জয়রামবাটি-কামারপুকুর থেকে বলে দিয়েছিল কোথায় থাকতে হবে। আমি সে দিনের জন্য কৃতজ্ঞ। ওঁদের কাছে কৃতজ্ঞ।
আরামবাগের রাস্তা এবং অন্য সংস্কারের কাজ হয়ে গেলে কামারপুকুর এবং জয়রামবাটিও উন্নত হবে। পর্যটন বাড়বে। বললেন মমতা। মন্দির পর্যটন বাড়বে। বললেন মমতা। তীর্থ পর্যটন প্রসঙ্গে টেনে আনলেন দিঘার জগন্নাথ মন্দিরের প্রসঙ্গও। বললেন, ‘‘অনেক কাজ করেছি।’’
আরামবাগে সভা শুরু মমতার। বললেন, আরামবাগের এই অঞ্চলে প্রচুর মন্দির আছে। আর আছে টেরাকোটা। তাই পর্যটনের জন্য অনেক কিছু করা হয়েছে। আরও হচ্ছে। পর্যটন বাড়লে আরও উন্নতি হবে। ৮৯০ কোটি টাকার প্রকল্প উদ্বোধন করে গিয়েছি। নতুন রাস্তার প্রকল্পে উত্তরবঙ্গ এবং দক্ষিণবঙ্গ জুড়বে। তাতে পর্যটনের নতুন ক্ষেত্র খুলে যাবে।