কেন্দ্রীয় অর্থসচিব টি ভি সোমনাথন। ছবি: সংগৃহীত।
বাজেটে পশ্চিমবঙ্গ-সহ পূর্ব ভারতকে দেশের বৃদ্ধির নতুন চালিকাশক্তি করে তোলার কথা বলা হয়েছে। তার রূপরেখা থেকে শুরু করে দেশে লগ্নি ও চাকরির অভাব— সব নিয়েই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি কেন্দ্রীয় অর্থসচিব টি ভি সোমনাথনের মুখোমুখি প্রেমাংশু চৌধুরী।
প্রশ্ন: অন্তর্বর্তী বাজেটে বলা হয়েছে, মোদী সরকার পশ্চিমবঙ্গ-সহ পূর্বাঞ্চলকে আর্থিক বৃদ্ধির নতুন চালিকাশক্তি করে তোলার দিকে নজর দেবে। কিন্তু বাজেটে কোনও প্রকল্প ঘোষণা বা অর্থ বরাদ্দ করা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী অনেক দিন ধরেই পশ্চিম ও পূর্ব ভারতে আর্থিক অসাম্যের কথা বলছেন। এখন নতুন করে পূর্ব ভারতে কী ভাবে নজর দেওয়া হবে?
উত্তর: পূর্ব ভারতে এমনিতেই অনেক প্রকল্পের কাজ চলছে। যেমন, যে সব অনগ্রসর জেলাকে চিহ্নিত করে কেন্দ্রীয় প্রকল্পের ১০০ শতাংশ লক্ষ্য পূরণের চেষ্টা হচ্ছে, সেই জেলাগুলির ৬০ শতাংশ পূর্ব ভারতে। এটা পূর্ব ভারতকে অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রমাণ। সম্প্রতি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি পূর্ব ভারতে বিপুল লগ্নি করছে।
যেমন, সার কারখানা হয়েছে, গ্যাসের পাইপলাইন বসেছে। রেল আমেরিকার সংস্থা জিই (জেনারেল ইলেকট্রিক)-কে বিহারে লোকোমোটিভ তৈরির জন্য লগ্নি করতে বলেছে।
প্রশ্ন: পূর্ব ভারতে আরও বেসরকারি লগ্নি টানার কি চেষ্টা করা হবে?
উত্তর: অবশ্যই। ভবিষ্যতে এ বিষয়ে রূপরেখা স্পষ্ট হবে।
প্রশ্ন: কিন্তু গত দু’তিন বছর ধরে সারা দেশেই তো নতুন লগ্নিতে ভাটার টান! বাজেটে ফের শিল্পমহলকে লগ্নি করার বার্তা দেওয়া হয়েছে। এ বার কি নতুন লগ্নি আসবে?
উত্তর: আমি ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি না। কারণ, শিল্পমহল লাভের অঙ্ক কষে লগ্নি করে। তবে আমি আশাবাদী। কারণ, এখন গড়ে কারখানাগুলির উৎপাদন ক্ষমতার ৭০ শতাংশ ব্যবহৃত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে তার থেকে বেশি। সাধারণত চালু কারখানার উৎপাদন ক্ষমতার এতখানি ব্যবহার হলে, সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা শিল্প নতুন কারখানা তৈরি কিংবা চালু কারখানার সম্প্রসারণে লগ্নি করে। কিছু বাস্তব উদাহরণও রয়েছে। বিমান পরিষেবা সংস্থাগুলি এক হাজার নতুন বিমানের বরাত দিয়েছে। এত বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং, রক্ষণাবেক্ষণ, এ সবের জন্য নতুন লগ্নি হবে। অনেকের চাকরি হবে। এটা ঠিক, গত দু’তিন বছরে লগ্নির ক্ষেত্রে খারাপ পরিস্থিতি ছিল। প্রথমে কোভিড, তার পরে ইউক্রেনে যুদ্ধ। জ্বালানির দাম বেড়েছিল। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাধা এসেছিল। রফতানি কমেছিল। এখন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি অনেকখানি সহজ হয়েছে। লগ্নির পরিস্থিতিও ভাল হবে।
প্রশ্ন: আপনি চাকরি বা কাজের সুযোগ তৈরির কথা বলবেন। দেশে ভাল মানের চাকরি তৈরি হচ্ছে না বলে অভিযোগ। শুধু ডেলিভারি-বয়, ট্যাক্সিচালকের মতো অস্থায়ী চাকরি। বাজেটে কর্মসংস্থানের দিকে কতখানি নজর দেওয়া হয়েছে?
উত্তর: কেন্দ্রের নজর ভাল মানের চাকরি তৈরির দিকে। শুধু একশো দিনের কাজের প্রকল্পে রোজগার দেওয়া নয়। এগুলো আদতে ভর্তুকি। এমন চাকরির সুযোগ তৈরি করা দরকার, যাতে জীবনের মানোন্নয়ন নয়। প্রথমত, উচ্চপ্রশিক্ষিত কর্মী তৈরি করতে আইআইটি, আইআইএম, কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, এমস-এর মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিপুল অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, গবেষণা, আবিষ্কারে উৎসাহ দেওয়ার জন্য ১ লক্ষ কোটি টাকার তহবিল তৈরি হয়েছে। এত দিন বিদেশ থেকে উন্নত মানের প্রযুক্তি আমদানির প্রবণতা ছিল। এখন সরকার মনে করছে, ভারতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে উৎসাহ দেওয়া জরুরি। যে প্রযুক্তি বাণিজ্যিক ভাবে ব্যবহার করা যায়। প্রথমে প্রযুক্তি, গবেষণা ক্ষেত্রে কর্মী নিয়োগ হবে। তার পরে সেই প্রযুক্তি ভিত্তিক শিল্প হলে সেখানেও কর্মসংস্থান হবে। তৃতীয়ত, পরিকাঠামোয় বরাদ্দ ১১ শতাংশ বেড়েছে। বিশেষত, সড়ক, সেতু, টেলি-যোগাযোগের মতো ক্ষেত্রে জোর দেওয়া হচ্ছে। কারণ, এখানে অপ্রশিক্ষিত থেকে শুরু করে উচ্চ প্রশিক্ষিত কর্মীদের পর্যন্ত বিপুল কর্মসংস্থান হয়।
প্রশ্ন: নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাজারে চাহিদার অভাব একটা সমস্যা। বিশেষত গ্রামে। বলা হচ্ছে, গ্রামের মানুষের আয় তেমন বাড়ছে না। বাজারে তেমন কেনাকাটা নেই। আপনি একমত?
উত্তর: পুরোপুরি একমত নই। গ্রাম, দ্বিতীয়-তৃতীয় সারির শহরেও এখন নতুন নতুন ক্ষেত্রে খরচ বাড়ছে। চিরাচরিত পণ্যের চাহিদা না বাড়লেও অনলাইন গেমিং, অনলাইন বিনোদনে মানুষ খরচ করছেন। সরকারি পরিসংখ্যান এমন কোনও কথা বলছে না যে, গ্রামের আয় বাড়ছে না। বরং কর আদায়ের পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায়, বড় শহরের মতো গ্রামেও অনলাইন গেমিং, অনলাইন বিনোদনে মানুষ খরচ করছেন।
প্রশ্ন: স্বাস্থ্য, শিক্ষা, মিড-ডে মিলের ক্ষেত্রে খরচ ছাঁটাই হয়েছে। কেন?
উত্তর: খরচ ছাঁটাই হয়নি। নানা সরকারের অনেক মন্ত্রক পুরো বরাদ্দ খরচ করতে পারেনি। সেই অর্থ আগামী বছরের বরাদ্দে যোগ হয়েছে। জিডিপি-র তুলনাতেও সামাজিক উন্নয়নে কম খরচ হয়নি। অনেকে যেটা বলছেন, মোট খরচের অনেক কম অংশ স্বাস্থ্য, শিক্ষায় খরচ হয়েছে। কারণ পরিকাঠামোয় বেশি খরচ হচ্ছে।
প্রশ্ন: কেন্দ্র কি তা হলে ধার কম করে, পরিকাঠামোয় বেশি খরচ করে, সামাজিক উন্নয়নে কম খরচের নীতি নিয়েই চলবে?
উত্তর: এমন কোনও নীতিগত লক্ষ্য নেই। ভর্তুকির ক্ষেত্রে কাউকে বঞ্চিত না করে, অপচয় বন্ধ করে ভর্তুকির খরচ কমানোর লক্ষ্য রয়েছে। মোট খরচের মধ্যে সামাজিক উন্নয়নে খরচের হার কমবে না। পরিকাঠামোয় খরচ গত দু’তিন বছরে লাফিয়ে বেড়েছে। গতবার ৩০ শতাংশের বেশি বরাদ্দ বেড়েছিল। এ বারও বাজেটে ১১ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। তবে এই হারে প্রতি বার পরিকাঠামোয় খরচ বাড়ানো সম্ভব নয়।
প্রশ্ন: ন্যূনতম কতখানি খরচ পরিকাঠামোয় ধরে রাখা দরকার?
উত্তর: এখন যেমন আছে, মোটামুটি সে রকম। জিডিপি-র ৩.৪ শতাংশ।
প্রশ্ন: কেন্দ্রের ঘাড়ে এখন দেনার উপরে সুদের বিপুল বোঝা। এই বাজেটে বাজার থেকে ঋণ কমানো হয়েছে। এতে কি কেন্দ্রীয় সরকারের ঋণে সুদের বোঝা কমবে?
উত্তর: ভবিষ্যতে সুদের বোঝা বৃদ্ধির গতি কমবে। তবে কম হারে হলেও সুদের বোঝা বাড়বে। কারণ, কোভিডের সময়ে বিপুল ঋণ করতে হয়েছে। এখনও প্রতি বছর সরকারকে ঋণ করতে হচ্ছে।
প্রশ্ন: দেশের সরকারি বন্ড আন্তর্জাতিক সূচকে জায়গা পেয়েছে। বিদেশ থেকে টাকায় ঋণ মিলবে। এতে কী লাভ হবে?
উত্তর: এতে ভাল-খারাপ দু’দিকই রয়েছে। জে পি মর্গ্যান সরকারি বন্ড সূচকে ভারতের সরকারি ঋণপত্র জায়গা পেয়েছে। ফলে বিদেশি লগ্নিকারীরা আমাদের সরকারি ঋণপত্রে লগ্নি করবেন। এর দরুন কেন্দ্র, রাজ্য, এমনকি বেসরকারি ক্ষেত্রও কম সুদে ঋণ পাবে। কিন্তু তেমনই আন্তর্জাতিক যে কোনও ঘটনায় সেই লগ্নি বিদায় নিতে পারে। তাতে আমাদের নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। আমাদের কাজ হবে, বিদেশ থেকে সরকারি ঋণপত্রে লগ্নি আয়ত্তের মধ্যে রাখা। যাতে অতিরিক্ত বিদেশি লগ্নি এসে কোনও উথালপাথাল পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারে।