গণনা চলাকালীন সাংবাদিক বৈঠকে রাহুল গান্ধী। মঙ্গলবার নয়াদিল্লিতে কংগ্রেসের সদর দফতরে। ছবি: পিটিআই।
আসল নেতা কাকে বলে জানেন?
চব্বিশ নম্বর আকবর রোডে কংগ্রেসের সদর দফতরে এক প্রবীণ নেতা প্রশ্ন করে নিজেই উত্তর দিলেন, ‘‘আসল নেতা সে, যে ঘোর প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও ঝড়ের মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। নিজের সিদ্ধান্ত, মতাদর্শ থেকে সরে না। সবাই পাশ থেকে সরে গেলেও মাটি কামড়ে পড়ে থাকে।’’
মাটি কামড়ে পড়ে থেকেই পরপর দু’টি লোকসভা নির্বাচনে ভরাডুবি, তিনটি বাদে বাকি সব রাজ্যে ক্ষমতা হাতছাড়া হওয়ার পরে অবশেষে কংগ্রেসের ঘুরে দাঁড়ানোর আশা দেখালেন রাহুল গান্ধী। কংগ্রেস নিজে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ধারে কাছে পৌঁছতে না পারলেও রাহুল গান্ধী দাবি করলেন, ‘‘গোটা দেশ নরেন্দ্র মোদীকে সাফ বলে দিয়েছে, আমরা আপনাকে চাই না। এই নির্বাচনের এটাই আসল কথা।’’
এ বারের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস একশোর মতো আসনে জিতেছে। সেই সঙ্গে বিজেপির বিরুদ্ধে মুখোমুখি লড়াইয়ে ২৯ শতাংশ আসনে সাফল্য পেল। যেখানে ২০১৯-এ কংগ্রেস বিজেপির বিরুদ্ধে মুখোমুখি লড়াইয়ে মাত্র ৮ শতাংশ আসনে সাফল্য পেয়েছিল। এত দিন কংগ্রেসের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, বিজেপির বিরুদ্ধে মুখোমুখি লড়াইয়ে কংগ্রেস হেরে যায়। সেই তুলনায় আঞ্চলিক দলগুলি বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভাল ফল করে। এই কারণে বিরোধী জোটে কংগ্রেসের নেতৃত্ব নিয়েও প্রশ্নচিহ্ন ছিল। লোকসভায় প্রধান বিরোধী দলের তকমা পেতে গেলে ৫৪৩টি আসনের অন্তত ১০ শতাংশ আসন জিততে হয়। গত দু’টি লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস প্রধান বিরোধী দলের তকমাও পায়নি। এ বার কংগ্রেস একশোর মতো আসনে জিতে প্রধান বিরোধী দলের তকমা পেতে চলেছে। ফলে বিরোধী শিবিরে কংগ্রেসের নেতৃত্ব নিয়েও আর শঙ্কা থাকছে বলেই দলের নেতারা মনে করছে।
এর পুরো কৃতিত্বই যাচ্ছে রাহুল গান্ধীর ঝুলিতে। কংগ্রেসের করুণ দশার মধ্যেও তিনি প্রথমে কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর, তার পরে মণিপুর থেকে মহারাষ্ট্র পর্যন্ত ভারত জোড়ো যাত্রা করেছিলেন। লোকসভা ভোটে ক্ষমতা দখল করতে না পারলেও কংগ্রেস নেতারা মনে করছেন, কংগ্রেসের পুনর্নির্মাণের ভিত তৈরি হয়ে গেল। একই সঙ্গে কংগ্রেসের নেতা হিসেবে তৈরি হয়ে গেল। একই সঙ্গে কংগ্রেসের নেতা হিসেবে রাহুল গান্ধী প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলেন। যিনি দলের প্রতিকূল পরিস্থিতি, ঘনিষ্ঠ নেতাদের দলত্যাগ, প্রবীণ নেতাদের বিদ্রোহ সত্ত্বেও নিজের অবস্থান থেকে নড়েননি। বরং ‘ভারত জোড়ো’ যাত্রায় নরেন্দ্র মোদীর বিদ্বেষের রাজনীতির বিরুদ্ধে ‘মহব্বত কি দুকান’ খোলার কথা বলেছিলেন। প্রবীণ নেতাদের আপত্তি সত্ত্বেও নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে অম্বানী-আদানিদের সম্পর্ক নিয়ে আক্রমণ চালিয়ে গিয়েছেন। শিল্পমহল তাঁর উপরে ক্ষুব্ধ হতে পারে ভেবে পিছু হটেননি।
আজ রাহুল গান্ধী বার্তা দিয়েছেন, তিনি আগামী দিনেও নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে গৌতম আদানির মতো শিল্পপতিদের সম্পর্ক নিয়ে আক্রমণ চালিয়ে যাবেন। আজ রাহুল বলেন, ‘‘আদানির শেয়ার দর দেখেছেন। আমজনতা আদানির সঙ্গে মোদীর সরাসরি সম্পর্ক তৈরি করে ফেলেছেন। শেয়ার বাজার বলছে, মোদী গেলে আদানিও যাবে। অর্থাৎ, সরাসরি সম্পর্ক, দুর্নীতির সম্পর্ক।’’
কংগ্রেস নেতাদের মতে, এ বার দলের সংগঠন মজবুত করার পালা। কারণ মাথায় রাখতে হবে কংগ্রেস শ’খানেক আসনে জিতলেও তার মধ্যে অনেকগুলি আসনে জয় এসেছে উত্তরপ্রদেশে অখিলেশ যাদব, তামিলনাড়ুতে ডিএমকে-র সমর্থনে। কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে মল্লিকার্জুন খড়্গে সংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা সবে শুরু করেছেন। সে দিক থেকে কংগ্রেস ক্ষমতায় না আসায় ভালই হয়েছে বলে রাহুল ঘনিষ্ঠ নেতাদের মত। তাঁদের যুক্তি, কংগ্রেস জোটশরিকদের উপরে নির্ভর করে ক্ষমতায় এলে পুরো নজর সরকারের দিকেই চলে যেত।
সরকারি ভাবে অবশ্য আজই কংগ্রেসের মল্লিকার্জুন খড়্গে, রাহুল গান্ধীরা বিরোধী আসনে বসার কথা বলেননি। উল্টে খড়্গে বলেছেন, এ বার কোনও দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। বুধবার ইন্ডিয়া জোটের বৈঠকে ঠিক হবে, সরকার গঠনের চেষ্টা হবে কি না। কিন্তু রাহুল গান্ধীর সামনে প্রশ্ন হল, তিনি কি আদৌ সরকারে যাওয়ার চেষ্টা করবেন? না বিরোধী আসনে থেকে দলকে মজবুত করার দিকে নজর দেবেন? রাহুল মুখে বলেছেন, বুধবারই উত্তর মিলবে। তবে তাঁর ঘনিষ্ঠেরা বলছেন, রাহুল সংগঠন মজবুত করতেই বেশি আগ্রহী।
আজ সকালে প্রথমে রাহুল, তারপরে সনিয়া গান্ধী দশ জনপথ থেকে পেরিয়ে দিল্লির খান মার্কেটের কাছে প্রিয়ঙ্কা গান্ধীর বাসভবনে চলে যান। সেখানেই মধ্যাহ্নভোজন সেরে ফিরে আসেন তাঁরা। তারপরে খড়্গে, সনিয়া, রাহুল একসঙ্গে কংগ্রেস সদর দফতরে সাংবাদিক বৈঠক করেন। হলুদ শাড়িতে হাসি মুখে প্রিয়ঙ্কা সঙ্গে থাকলেও তিনি সাংবাদিক বৈঠকের মঞ্চে ওঠেননি। রাহুল অবশ্য বলেছেন, প্রিয়ঙ্কা লুকিয়ে থাকলেও উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসের সাফল্যের পিছনে তাঁর বোনের সাফল্যরয়েছে।