Lok Sabha Election 2024

মোচপোলের স্মৃতি এখনও টাটকা, ভোলাতে চায় শাসকদল

দিন ঘোষণা হতেই ঢাকে কাঠি পড়েছে ভোটের। কিন্তু প্রতিশ্রুতি পূরণ? বাজি কারখানায় বিস্ফরণের ঘায়ে গ্রাম হাতছাড়া হবে না তো?

Advertisement

প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায় ও চন্দন বিশ্বাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০২৪ ০৪:৩৩
Share:

ভগ্নাবশেষ: মোচপোলের সেই বিস্ফোরণস্থলে এখনও পড়ে রয়েছে ধ্বংসাবশেষ। ছবি: সুদীপ ঘোষ।

গ্রামের সঙ্কীর্ণ পথ ধরে পুকুরপাড় পেরোলেই চোখে পড়বে বিধায়কের নাম লেখা বড় বড় পোস্টার। সে সব ছাড়িয়ে কয়েক পা এগোলেই শাসকদল তৃণমূলের দলীয় কার্যালয়। যেটি সদ্য তৈরি করা হয়েছে। সন্ধ্যা নামলেই সেই দলীয় কার্যালয় জমজমাট। বিধায়ক ফিতে কেটে দিয়ে যাওয়ার পরে আপাতত গ্রামের মেজো-সেজো নেতারা পার্টি অফিসে বসে মোর্চা সামলাচ্ছেন। দলের হুকুম, পাশাপাশি দু’টি গ্রাম যেন কোনও ভাবে হাতছাড়া না হয়। লোকসভা ভোট আসছে।

Advertisement

গ্রামের নাম মোচপোল পশ্চিমপাড়া। তার পাশেই বেরোনান পুকুরিয়া। গত বছর অগস্টের এক সকালে খবরের শিরোনামে উঠে এসেছিল বারাসত লোকসভা কেন্দ্রের অধীন এই মোচপোল। বাজি তৈরির বেআইনি কারখানায় ভয়াবহ বিস্ফোরণে একাধিক মৃত্যু হয়েছিল এই গ্রামে। যে বাড়িতে ছিল সেই কারখানা, সেটির আশপাশের বাড়িগুলিও ভেঙে চৌচির হয়ে যায় বিস্ফোরণের অভিঘাতে। ওই বাজি কারখানার অংশীদার বলে অভিযোগের আঙুল ওঠে শাসকদলের এক স্থানীয় নেতার বিরুদ্ধে। গ্রামের খবর, ওই ঘটনার পর থেকে বহু দিন গ্রামের বাইরে ছিলেন সেই নেতা। সম্প্রতি বাড়ি ফিরেছেন। তাঁর বাড়ির সামনেই খোলা হয়েছে দলীয় কার্যালয়টি। যদিও বাজি কারখানার শ্রমিকদের কয়েক জন যাঁর বাড়িতে ভাড়া থাকতেন, আইএসএফের সমর্থক রমজান আলি নামে সেই ব্যক্তিকেই শুধু গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। তিনিও সম্প্রতি ছাড়া পেয়ে গ্রামে ফিরেছেন। গ্রামের খবর, লোকসভা নির্বাচনের আগে বাসিন্দাদের ক্ষোভ প্রশমিত করতে এবং ওই বিস্ফোরণ নিয়ে তাঁদের মুখ বন্ধ রাখতে ইতিমধ্যেই সব রকম চেষ্টা শুরু হয়েছে।

ভোটের আগে কি মানুষ বিস্ফোরণ নিয়ে কথা বলছেন?

Advertisement

দু’বছরের একরত্তি নাতিকে কোলে নিয়ে এক দৃষ্টিতে ভাঙা বাড়ি সারাইয়ের কাজ দেখছিলেন আসুরা বিবি। একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললেন, ‘‘বাড়িটার দিকে যখনই তাকাই, তখন আর চুপ করে থাকতে পারি না। বিস্ফোরণে বাড়ি ধসে চাপা পড়েছিলাম। কানের পর্দা বিকল হয়ে গিয়েছে। নাতিটার সারা গা থেকে সে দিন রক্ত বেরোচ্ছিল। পুরো বাড়িটা নতুন করে তৈরি করতে গিয়ে সব সঞ্চয় শেষ হয়ে যাচ্ছে। কোনও সাহায্য পাইনি।’’ বিস্ফোরণস্থলের পাশেই আসুরাদের দোতলা বাড়ি ছিল। উল্টো দিকের বাড়ির বাসিন্দা তাজমিরা বিবি নিজের ঘরে বসে চোখ মুছে বলেন, ‘‘১৫ হাজার টাকা পেয়েছিলাম। বোমা ফেটে পুরো বাড়িটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ১৭ দিন মাত্র বাড়িটা ভোগ করতে পেরেছিলাম। ছেলে শখ করে একটা বক্স খাট কিনেছিল। এখন বাড়ি ফিরে মেঝেতে বিছানা পেতে ঘুমোয়।’’ ওই দু’টি বাড়িই বিস্ফোরণে কার্যত ধ্বংস হয়ে যায়।

কিন্তু বেআইনি ভাবে বাজি তৈরি বন্ধ করা গিয়েছে কি?

মোচপোলের ভিতরের খবর, বাজির পুরনো কারবারিরা আবার ধীরে ধীরে সক্রিয় হচ্ছেন। চোরাগোপ্তা বাজি তৈরিও হচ্ছে। তবে বিস্ফোরণের পরে সিংহভাগ ব্যবসা বন্ধ বলেই জানাচ্ছেন গ্রামের মানুষ। সেখানকার বাসিন্দাদের থেকেই সন্ধান পেয়ে যাওয়া হয়েছিল মোচপোলের অদূরে নারায়ণপুরে, যেখানে এক সময়ে বাজির শিল্পাঞ্চল ছিল। শোনা গিয়েছিল, সেখানেও নাকি বাজি তৈরি বন্ধ। কিন্তু গাড়ি নিয়ে নারায়ণপুর মোড় থেকে সামান্য ভিতরে ঢুকে বাজির খোঁজ করতেই এক যুবক এগিয়ে এসে বললেন, ‘‘কী বাজি নেবেন? শেল চাই? আমার কাছে পাবেন।’’ এক বৃদ্ধা এগিয়ে এসে জানালেন, বাবুসোনা নামে এক জনের কাছে বাজি পাওয়া যেতে পারে। সেই মহল্লায় ঢুকে দেখা মিলল বাবুসোনার। তিনি জানালেন, বাজি তৈরি ছেড়ে আপাতত তিনি কারখানায় চাকরি করছেন। বিস্ফোরণের পরে পঞ্চায়েত থেকে বাজি তৈরির ছাড়পত্র জোগাড় করলেও ব্যবসা প্রশাসন বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু ব্যবসা করা সত্ত্বেও বিস্ফোরণের আগে কেন বাজির ছাড়পত্র নেননি? বাবুসোনার কথায়, ‘‘তার আগে এখানে বেশির ভাগেরই কোনও ছাড়পত্র ছিল না।’’

তা হলে বাজির ব্যবসা রমরমিয়ে চলত কী করে? বেরোনান পুকুরিয়ার খাঁ খাঁ ইটভাটায় বাচ্চাকে খেলাতে নিয়ে এসেছিলেন এক ব্যক্তি। ওই ইটভাটায় বাজির গুদাম ছাড়াও ছিল রাসায়নিক মেশানোর ল্যাবরেটরি। ওই ব্যক্তির কথায়, ‘‘গ্রামের মানুষ তো পুলিশের কাছে একাধিক বার অভিযোগ করেছিলেন। পুলিশ কেন ব্যবস্থা নেয়নি, সে তো সবাই জানে।
রাজনৈতিক প্রশ্রয় না থাকলে কি আর এ সব করা সম্ভব ছিল? কেন মুখ খুলতে বলছেন? বেশি কথা বললে অন্য সমস্যা হবে।’’

মোচপোল নিয়ে তেমন কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি বারাসতের বিদায়ী সাংসদ তথা এ বারের প্রার্থী কাকলি ঘোষদস্তিদার। তিনি বলেন, ‘‘এটা একেবারে স্থানীয় বিষয়। ওই এলাকার মানুষের রুজি-রোজগার ছিল বাজি শিল্প। এক জন লোক নিয়ম না মানায় ওই দুর্ঘটনা ঘটে। তার পরে রাজ্য প্রশাসন তো হস্তক্ষেপ করেছে। আমরাও দুঃখ প্রকাশ করেছি।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement